গত কয়েকদিন এখানে কী তাণ্ডব বয়ে গেছে তার খানিকটা আভাস পাওয়া যায় ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়া প্রাঙ্গণগুলো থেকে।
Published : 01 Jul 2023, 06:51 PM
ফ্রান্সজুড়ে এখন যে ভয়াবহ অস্থিরতা টগবগ করে ফুটছে, তার সামগ্রিক ধারণা পেতে নঁতেয়াই সবচেয়ে ভালো জায়গা।
এমন ধারণাই দিয়েছেন বিবিসির এক সাংবাদিক, যিনি প্যারিসের ওই শহরতলীর পরিস্থিতি দেখতে শুক্রবার সেখানে ছুটে গিয়েছিলেন; তার তিন দিন আগেই ওই এলাকায় পুলিশের গুলিতে এক কিশোর নিহত হয়েছিল, যার প্রতিক্রিয়ায় গোটা ফ্রান্স এখন জ্বলছে।
বিবিসির ওই সাংবাদিক প্রথমে লু ৩৫ ক্যাফের বাইরে একদল তরুণের সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলেন; দলটির অনেক সদস্যের মুখে দাঁড়ি ছিল, একজনের বডি বিল্ডারে মতো পেটানো শরীর।
কিন্তু তাদের প্রতিক্রিয়া ছিল মারমুখী, আক্রমণাত্মক কটূবাক্যর তুবড়ি ছুটিয়ে আর আঙুল তুলে সাংবাদিককে ওই এলাকা ছাড়তে বলে তারা।
যে স্থানে পুলিশ মঙ্গলবার আলজেরীয় বংশোদ্ভূত ১৭ বছর বয়সী কিশোর নাহেল এমকে গুলি করেছিল, সেখানে মাথায় মুসলিম কায়দায় কাপড় পরা একদল নারীকে চলন্ত গাড়ি থেকে পুলিশ ও গণমাধ্যমের উদ্দেশ্যে বিষোদগার করতে দেখা যায়।
ক্যামেরা কিংবা নোটবুক ছাড়া, রাস্তায় ইতস্তত ঘুরে বেড়ালে, গত কয়েকদিন এ এলাকাটিতে কী তাণ্ডব বয়ে গেছে তার খানিকটা আভাস পাওয়া যেতে পারে পোড়া গাড়ি আর ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়া প্রাঙ্গণগুলো থেকে।
নিজেদের অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকের বাইরে একটি বেঞ্চে বসে কৃষ্ণাঙ্গ এক পুরুষ বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলেন তিন মধ্যবয়সী শ্বেতাঙ্গ নারী লুসিল, ম্যারি আর জেন।
নঁতেয়ার অন্যান্য অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকের মতো এই অংশটাও বুনো, চারপাশ বাগানে ঘেরা।
এ নারীরা তাদের ছবি তুলতে দিতে রাজি হলেন না, তাদের ভয় তাদের ছেলেমেয়েদের পরিচয় প্রকাশ হয়ে গেলে তারা আক্রমণের লক্ষ্য হতে পারে। তবে কথা বলতে তাদের আপত্তি নেই।
“গত তিন রাত ছিল স্তম্ভিত করার মতো। মধ্যরাত থেকে ভোর ৪টা পর্যন্ত জানালার বাইরে হট্টগোল চলছিল। কেউ ঘুমাতে পারেনি। মনে হচ্ছিল, আমি অন্য কোনো গ্রহে বাস করছি,” বলেন লুসিল।
নঁতেয়ারই এক কিশোর পুলিশের চেক পোস্টে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে, এ কারণে দাঙ্গাকারীদের যে ক্ষোভ, তা কি এই নারীরা অনুধাবন করতে পারছেন না?
“যা ঘটেছে তার সঙ্গে দাঙ্গা সহিংসতার কোনো সম্পর্ক নেই। অবশ্যই, ওই কিশোরকে হত্যা করা ঠিক হয়নি। কিন্তু সকাল ৮টায় কেন তার লাইসেন্স ছাড়া আনন্দভ্রমণে বের হওয়া লাগবে? যখন অন্য শিশুরা স্কুলে যাচ্ছে?,” বলেন লুসিল।
ফ্রান্সে দাঙ্গা দমনে মোতায়েন ৪৫ হাজার পুলিশ, সাঁজোয়া যান
ফ্রান্সে দাঙ্গার সময় দোকান ভাঙার চেষ্টা, ছাদ থেকে পড়ে মৃত্যু
বাস স্টপে একটি গ্রাফিতি দেখছিলেন মেরি, যেখানে লেখা ‘এক পুলিশ, এক বুলেট’।
“এখানে কী লেখা রয়েছে দেখছেন আপনি? আমি পুরোপুরি এর বিরুদ্ধে। আমি মনে করি না পুলিশ বর্ণবাদী। সব গোষ্ঠীর মধ্যেই ভালো-খারাপ আছে,” বলেন তিনি।
নিহত কিশোরের মা মোনিয়ার জন্যও তাদের সমবেদনা তেমন দেখা গেল না। মোনিয়া বৃহস্পতিবার নাহেলের স্মরণে হওয়া এক শোক মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন।
“মিছিলে ছাদখোলা ভ্যানে কী করছিলেন তিনি? এটা অসম্মানজনক। এটা শোকের মিছিল নয়। তিনি এ নিয়ে রাজনীতি করছেন। ছেলেটি কোনো কিছুর জন্যই পরিচিত ছিল না। ছিল কেবল আগ্রাসী কিশোর,” মেরির কথায় অন্যদেরও মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতে দেখা যায়।
এই নারীদের সঙ্গে যেখানে কথা হয়, তার চেয়ে খুব বেশি দূরে নয় সারি সারি প্লেন গাছ লাগানো অ্যাভেনিউ জর্জ ক্লেমোসু। এখানে স্থানীয় কর কার্যালয়ের সামনের অংশের ক্ষয়ক্ষতি পর্যালোচনা করতে এসেছিলেন ওদু সেন বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তা।
“শোচনীয়, দুঃখজনক,” ক্ষয়ক্ষতি দেখার পর বলেন তিনি।
ভবনটি লক্ষ্য করে বিক্ষোভকারীদের ছোড়া রকেট উপরের তলার জানালাগুলোতে যত গর্ত সৃষ্টি করেছে, সেগুলোর মাঝে ফাঁক খুঁজে পাওয়াই মুশকিল। রাস্তা বরাবর থাকা সব কাঁচের দরজা-জানালা ভারী যন্ত্রপাতির আঘাতে চুরমার হয়ে আছে।
যারা ক্ষয়ক্ষতি দেখছিলেন তাদের মধ্যে কর পরিদর্শক সিরিলও ছিলেন, যিনি নঁতেয়াই বসবাস করেন, তিনি ছবি তুলতে দিতে আপত্তি জানান।
“ভারি দুঃখ হচ্ছে। এই কর কার্যালয় নঁতেয়ের লোকজনকেই সেবা দিত। এখান থেকে যে অর্থ আসতো, তা তাদেরই কাজে লাগানো হতো। এখানে আক্রমণের অর্থ কী? এটা পুরোপুরি সামঞ্জস্যহীন প্রতিক্রিয়া,” বলেছেন তিনি।
তবে এই কর্মকর্তা মোটাদাগে মঙ্গলবারের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানানো বিক্ষোভকারীদের প্রতি সহানুভূতিশীল।
“বর্ণবাদী পুলিশ কথাটা ঠিক আছে কিনা, আমি নিশ্চিত নই। শুধু বলতে পারি, তাদের ব্যবহার আগ্রাসী। এখানকার সব শিশু কিশোরই পুলিশের খারাপ আচরণের মুখোমুখি হয়েছে, এর কারণে তারা (শিশুকিশোররা) প্রায়ই উদ্ভট কিছু করতো।
“কিন্তু দেখুন। সে (নাহেল) ছিল কিশোর আর পুলিশের কর্মকর্তাটি প্রাপ্তবয়স্ক। তার কাছেই অস্ত্র ছিল। তারই দায়িত্ব ছিল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা, কিন্তু সে পারেনি,” বলেছেন সিরিল।
অবশ্য নাহেলের স্মরণে হওয়া কর্মসূচিগুলোতে অংশ নেওয়া স্থানীয়দের অনেকের দৃষ্টিভঙ্গি তার চেয়েও কড়া।
যেমনটা বাকারির। তিনি দাঙ্গার পক্ষে নন, কিন্তু কেন হচ্ছে তা বুঝতে পারছেন।
“অনেকেই সহিংসতার প্রতিক্রিয়া সহিংসতার মাধ্যমে দেখাতে চায়। নাহেলের হত্যাকাণ্ডে আমি বিস্মিত নই, আমাদের সবারই পুলিশের সঙ্গে বাজে অভিজ্ঞতা আছে। সবখানেই ভালো-খারাপ আছে, কিন্তু পুলিশের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠই বর্ণবাদী,” বলেছেন তিনি।
একই মত ইয়াসমিনারও।
“আমি ফরাসী পুলিশকে পুরোপুরি ঘৃণা করি। আমি তাদের জন্য সবচেয়ে খারাপটাই প্রত্যাশা করি। পুরো সিস্টেমটাই পদ্ধতিগত বর্ণবাদী মতাদর্শপ্রসূত দুর্নীতিপরায়ণ।
“নাহেল আমারও ছোট ভাই হতে পারতো। এটা ভেবে আমার মন খারাপ হয়ে যায় যে, এরকম বাচ্চাকাচ্চারা বোকার মতো ভুল করতেই পারে, যে কেউ করতে পারে। কিন্তু এর জন্য সে মারা যেতে পারে না,” বলেছেন তিনি।
অনেকের মনে হতে পারে, নঁতেয়া বুঝি ফরাসী সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো শহর। অথচ এটি প্রশস্ত, পরিষ্কার একটি এলাকা আর কমিউটার ট্রেনে প্যারিসের কেন্দ্রস্থলের আখ দ্যা থিয়ুফ থেকে মাত্র দুটি স্টেশন দূরে।
নঁতেয়া থেকে লা দি ফঁসা বিজনেস ডিস্ট্রিক্টের টাওয়ারগুলো পাথর ছোড়া দূরত্বে। এখানে নাট্যশাল আছে, আছে ন্যাশনাল অপেরা ডান্স স্কুল, বিশাল একটি পার্ক আছে।
তাও মনে হবে এখানে বুঝি দুটি আলাদা আলাদা জগত একে অপরের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত।
একদিকে দেখা যাবে, উদার ফরাসী রাষ্ট্রের সব উপকরণ। তিন রঙের পতাকা উড়ছে, কর্মকর্তারা তাদের আওতাধীন এলাকা পর্যবেক্ষণ করছেন। মেট্রো ট্রেনগুলো হুইসেল বাজিয়ে ছুটছে, লা দি ফঁসার বড় বড় টাওয়ারগুলোতে থাকা বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার কামাচ্ছে।
অথচ ওই একই ভৌগোলিক জায়গার মধ্যে অনেকে আছেন যারা নিজেদের পুরো সিস্টেম থেকে বিচ্ছিন্ন ভাবছেন। যাদের দেখা সহজেই মিলবে, বৈরিতা অনুভূত হবে। যারা বলবে এই জায়গা আমাদের; আঙুল তুলে গণমাধ্যমের মতো অবাঞ্ছিত, বহিরাগতদের চলে যেতে বলবে।
কর কার্যালয়ের কাছে পেট্রল স্টেশনে অভিজ্ঞ আলোকচিত্রী এরিক হাজের সঙ্গে দেখা, যিনি তার ক্ষতবিক্ষত গাড়ির বিভিন্ন অংশ খতিয়ে দেখছিলেন এবং বিমা দাবির ফর্ম প্রস্তত করছিলেন।
“বৃহস্পতিবার শোক মিছিলের সময়ে আমরা এখানে এসেছিলাম। দীর্ঘদেহী কয়েকজন এসে আমাদের চলে যেতে বলে। আর জানায়, তাদের কথা না শুনলে আমাদের পরিণতি খুব খারাপ হবে। আজকে এখানে ফিরে এসে দেখি গাড়িটি চুরমার হয়ে আছে,” বলেন তিনি।
এ আলোকচিত্রী জীবনে অনেক দাঙ্গা দেখেছেন, কিন্তু কোনোটিই এবারের মতো নয়।
“খুব খারাপ পরিস্থিতি। ২০০৫ সালের চেয়েও খারাপ,” বলেন তিনি।
তার মতো সবার মনের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে দেড় যুগ আগেকার ওই দাঙ্গার স্মৃতি, যা সপ্তাহ তিনেক ফ্রান্সের অনেক এলাকাকে অশান্ত রেখেছিল। এবারের অস্থিরতা কতদিন চলে তা নিয়েও অনেকে ভীত।
“এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আছে, যা দাঙ্গাবাজদের বেশ সুবিধা দিচ্ছে। সবকিছুর ওপরে, এবারের দাঙ্গা আগেরগুলোর চেয়ে বেশি সহিংস। তাদের কাছে রকেট আছে। এগুলোর ক্ষেত্রে যা যা বাধাস্বরূপ ছিল, তা তুলে নেওয়া হয়েছে,” বলেছেন হাজ।
লিঁওর সাবেক সোশালিস্ট মেয়র ও প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর অধীনে একসময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা জেহা কুলুম্ব তার ধারাল কথাবার্তার জন্য সুপরিচিত ছিলেন।
২০১৮ সালে তিনি যখন দায়িত্ব ছাড়েন তখন তিনি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যকার বিভক্তি নিয়ে তার উদ্বেগের কথা জানিয়েছিলেন।
“আজ আমরা পাশাপাশি আছি। কাল আমরা একে অপরের মুখোমুখি হবো, এমন ভয় হয় আমার,” বলেছিলেন তিনি।
নঁতেয়াতে আজ ফ্রান্সের এক অংশ অন্য অংশের মুখোমুখি।