আফগানিস্তানে যুদ্ধে জয়লাভের পর এখন দেশের পুনর্গঠন, নানা উপদলের ঐক্যের ভিত্তিতে একটি সরকার গঠনসহ নানা সংকটে জর্জরিত দেশ শাসনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে তালেবান।
Published : 04 Sep 2021, 01:27 AM
কাবুল বিমানবন্দর থেকে যেদিন শেষ বিদেশি সেনাটি আফগানিস্তান ছেড়ে গেল তার মিনিট কয়েক পরই দীর্ঘ আফগান যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের বিব্রতকর পরাজয় আর আফগানিস্তানের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে চলে আসার আনন্দ গুলি ছুড়ে, উল্লাস করে উদযাপন করেছে তালেবান।
২০০১ সালে তালেবানের হাতে দেশের যতটুকু অংশের নিয়স্ত্রণ ছিল এখন তার চেয়েও বেশি অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে। তালেবানের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ এখন মূলত টিকে আছে কাবুলের উত্তরের পানশির প্রদেশে।
সেটিও করায়ত্ব করার জন্য তালেবানের লড়াই জারি আছে। তার মধ্যেই আফগানিস্তানের শাসনকার্য পরিচালনার ভার রয়েছে তাদের কাঁধে। শনিবারই তালেবান নতুন সরকার ঘোষণা করতে পারে বলে শোনা যাচ্ছে।
কিন্তু, দারিদ্র, খাবার সংকট, বহির্বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্নতা, আইএস এর মতো জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর হামলার হুমকি এবং গভীর রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকটে জর্জরিত একটা দেশকে টেনে তুলে সামনে এগিয়ে যাওয়া তালেবানের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাছাড়া, সরকার গঠন নিয়েও তালেবান চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে।
তালেবান যত দ্রুত একের পর এক প্রদেশ কব্জা করে আফগানিস্তান দখল করেছে তাতে অন্যরা তো বটেই খোদ তালেবান গোষ্ঠীও ততটাই হতবাক হয়েছে। এমন অবিশ্বাস্য জয়ের কারণে তালেবানের সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য আগে থেকে প্রস্তুতিও ছিল না।
তার মধ্যে সে সময়কার প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনির পলায়নে আলোচনার মধ্য দিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তর কিংবা কোনও ধরনের অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের আশাও শেষ হয়ে যায়। ফলে তখন আফগানিস্তান কী করে চালানো যাবে তা নিয়ে গোপন আলোচনা শুরু করেন নেতারা।
তালেবান আফগানিস্তানে কোনও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা রাখতে অস্বীকৃতি জানায় এবং সবার অংশগ্রণমূলক একটি সরকার গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে আলোচনায় বসে। এই আলোচনায় সামিল রয়েছেন সাবেক আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইসহ আরও অনেকে। তারপরও নতুন প্রশাসন গড়তে লেগে গেছে কয়েক সপ্তাহ। আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসা এখনও বাকী।
কট্টরপন্থি ইসলামী গোষ্ঠী তালেবানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা হায়বাতুল্লাহ আখুনজাদার অধীনে এই গোষ্ঠীর সহ-প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা আবদুল গনি বারাদারের নেতৃত্বে আফগানিস্তানের নতুন সরকার ঘোষিত হতে চলেছে বলে খবর পাওয়া গেছে। কিন্তু তালেবান এখন নানা অংশ বা উপদল নিয়ে গঠিত। যাদের স্বার্থ এবং অগ্রাধিকারের মধ্যে সমন্বয় করতে হবে।
তালেবান বিষয়ক এক পাকিস্তানি বিশেষজ্ঞ জাহিদ হুসেইন বলেছেন, ১৯৯০ এর দশকের প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা ওমরের মতো একক গ্রুপ কমান্ড এখন আর তালেবান গোষ্ঠীতে নেই। মোল্লা ওমরের সর্বময় ক্ষমতা ছিল। তিনি যা বলতেন সেই নির্দেশ শোনা প্রত্যেকের জন্যই ছিল মূলত বাধ্যতামূলক। কিন্তু এখন তালেবানের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক এবং সামরিক কার্যক্রম আছে, যার মধ্যে সমন্বয় করা জরুরি।
তাছাড়া, তালেবানের রাজনৈতিক কার্যালয় কাতারের দোহায় আন্তর্জাতিক শক্তিধর দেশগুলোর সঙ্গে বছরের পর বছর যে নেতারা কাটিয়েছেন, তাদেরকে এখন কাজ করতে হবে বয়সে তরুণ কমান্ডারদের সঙ্গে, যারা যুদ্ধে লড়েছে এবং এই যোদ্ধারা এখন শান্তি প্রক্রিয়ায় তাদের মতামত থাকুক এমনটি আশা করতে পারে, সেটিও তালেবান নেতৃত্বের জন্য একটি ভেবে দেখার মতো বিষয়।
তালেবানের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কমান্ডার বলেছেন, তালেবানের কান্দাহার এবং জাবুল উপদল আগে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় বেশি প্রভাবশালী ছিল। কিন্তু এখন হাক্কানি গ্রুপ কাবুল দখল করায় তাদের আধিপত্যই এক্ষেত্রে আরও বেশি বেড়ে গেছে। পাকিস্তান সীমান্ত সংলগ্ন এই দলটি খুবই প্রভাবশালী।
তাছাড়া, কাবুলের পতনের পর আনাস হাক্কানির মতো নতুন নতুন তালেবান নেতারও উদয় হচ্ছে। আনাস হচ্ছেন, হাক্কানি নেটওয়ার্কের এক সহপ্রতিষ্ঠাতার ছেলে। “তারা একক কমান্ডের অধীনে চলেন না, এমনকী নিজ দলেও না”, বলেছেন ওই অঞ্চলের দীর্ঘ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এক পশ্চিমা কূটনীতিক।
কাবুলের পতনের পরদিন থেকে ক্রমেই রাজনৈতিক ভূমিকায় দৃশ্যমান হতে দেখা যাচ্ছে আনাস হাক্কানিকে। তালেবানের উপনেতা ভাই সিরাজুদ্দিন হাক্কানির ছায়া থেকে উদীয়মান হচ্ছেন তিনি।
তালেবানের মধ্যে এমন বিভাজনের সুযোগকে অনেকবছর ধরেই কাজে লাগাতে চেয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী এবং আফগানিস্তানের পশ্চিমা সমর্থিত সরকার। যদিও তালেবানে তারা ভাঙন ধরাতে পারেনি।
আফগানিস্তানের বাইরে যে দেশগুলো তালেবানের এই নতুন ধারা বোঝার চেষ্টা করছে তারা বলছে, দেশ পরিচালনায় সামনে নানা চ্যালেঞ্জ বাড়তে থাকার এ সময়ে ভিন্ন ভিন্ন এই গ্রুপগুলো একটি অভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে চলতে পারে কিনা সেটিই এখন নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণে রাখা হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আঞ্চলিক কূটনীতিক বলেছেন, রাজস্ব আয় এবং অর্থনীতিকে চাঙ্গা করাটাই এখন তালেবানের জন্য হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ আফগানিস্তানে ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসনের পর তৎকালীন তালেবান সরকারের পতন ঘটলে বিপুল বৈদেশিক সহায়তা আসতে শুরু করেছিল, যা এতদিন চলেও এসেছে। কিন্তু গত ১৫ অগাস্ট তালেবান ক্ষমতা দখলের পর অনেক দেশই আফগানিস্তানকে সহায়তা দেওয়া বন্ধ করেছে
আফগানিস্তানে চলমান প্রকল্পগুলোতে সর্বশেষ তহবিল স্থগিত করেছে বিশ্ব ব্যাংক। এর আগে আরেক ঋণদাতা সংস্থা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) আফগানিস্তানে সব ধরনের সহযোগিতা স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছিল।
তাছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রে আফগান সেন্ট্রাল ব্যাংকের রিজার্ভও জব্দ হয়েছে। ফলে এই ব্যাংকের ৯শ’ কোটি ডলার রিজার্ভের বেশিরভাগই আটকা পড়ে আছে। যুক্তরাষ্ট্র তালেবানকে সেখান থেকে কোনও অর্থ তুলতে দিচ্ছে না। বিশ্বের কয়েকটি দেশও আফগানিস্তানে ত্রাণ সহায়তা বন্ধ করেছে। এর মধ্যে আছে জার্মানি, ফিনল্যান্ড এবং সুইডেন।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) আফগানিস্তানে উন্নয়ন সহায়তা তহবিল (ওডিএ) বন্ধ করে দিচ্ছে। তবে বলেছে, তারা সেখানে মানবিক সহায়তা বাড়িয়ে দিতে পারে। আফগানিস্তানে ২০২১ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ১৪০ কোটি ডলারের ওডিএ তহবিল দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল ইইউ।
এছাড়া, গতবছর নভেম্বরে এক আন্তর্জাতিক দাতা সম্মেলনে আফগানিস্তানে আগামী চার বছরের জন্য মোট ১২শ’ কোটি ডলার সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আফগানিস্তানের বর্তমান সংকটে সেই প্রতিশ্রুতির কী হবে তাও জানা নেই।
এই অর্থ সংকট তালেবান নেতৃত্বাধীন সরকারকে বিপর্যয়ে ফেলতে পারে। সরকারের সামনে বড় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠতে পারে কর্মীদের বেতন-ভাতা দেওয়া এবং বিদ্যুৎ-পানি-যোগাযোগের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলো সচল রাখার বিষয়টি।
তাছাড়া, ইতোমধ্যে আফগানিস্তানে খাবারের সংকট ও খরা দেখা দেওয়ায় জাতিসংঘ দেশটিতে মানবিক বিপর্যয়ও ঘনিয়ে আসতে চলেছে বলে সতর্ক করে দিয়েছে।
সেইসঙ্গে ইসলামিক স্টেটের মতো জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো থেকে হামলার আশঙ্কার কারণে তালেবানের সামনে দেশের নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে আরেক বড় চ্যালেঞ্জ তো আছেই।
আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ সরকারের জন্য আরেক বড় সংকট হয়ে দেখা দিতে পারে দক্ষ জনবলের ঘাটতি। তালেবান যোদ্ধারা কাবুল দখলের পর থেকেই ৩১ আগস্টের সময়সীমার মধ্যে আফগানিস্তান থেকে বিদেশি সেনা ও তাদের হয়ে কাজ করা বহু আফগানকে সরিয়ে নেওয়ার কাজ চালায় যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্ররা।
ওই সময় তালেবান শাসনের ভয়ে মরিয়া হয়ে যে আফগানরা দেশ ছেড়েছেন তাদের মধ্যে ছিল বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার অনেক প্রশিক্ষিত, দক্ষ, শিক্ষিত বিষেশজ্ঞ ও মেধাবী মানুষ। অর্থনীতিতে এই দক্ষ জনবলের দেশ ছাড়ার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে তালেবানকে হিমশিম খেতে হবে।
আগেরবার আফগানিস্তানের ক্ষমতায় থাকাকালে কূটনীতি থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন ছিল তালেবান। এবার তালেবান আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে আগ্রহী। কিন্তু অনেক দেশই এরই মধ্যে কাবুলে কূটনৈতিক মিশন বন্ধ করেছে।
তালেবান এ পর্যন্ত চীন, ইরান রাশিয়ার মতো আঞ্চলিক প্রভাবশালী কিছু দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও এখনও কারও স্বীকৃতি পায়নি। পশ্চিমা দেশগুলোও তালেবানকে এখন পর্যন্ত স্বীকৃতি দেওয়ার আগ্রহ দেখায়নি।
আস্থাসংকট:
তালেবান এবার ক্ষমতাদখলের পরই নারী অধিকার এবং মানুষের অবাধে চলাফেরার অধিকারসহ কিছু ক্ষেত্রে উদার দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরার চেষ্টা করেছে। কিন্তু তাদের দেওয়া আশ্বাস নিয়ে দেশের ভেতরে এবং বাইরে অনেকেই সন্দিহান।
তছাড়া, তালেবান শান্তির বার্তা দিয়েও বরাবরই বলে এসেছে শরিয়া আইন মতোই সব চলবে। মুখে তালেবান ভাল কথা বললেও মাঠ পর্যায়ে নিরীহ মানুষের ওপর তাদের অত্যাচারের ভিন্ন পরিস্থিতিই নজরে আসছে।
সরকার গঠন নিয়ে সাবেক প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইয়ের মতো নেতাদের সঙ্গে তালেবান আলোচনা চালাচ্ছে। কিন্তু নতুন সরকার ব্যবস্থায় তারা গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীপদগুলোতে প্রবীণ যেসব তালেবান কমান্ডার নিয়োগ করেছে তাতে সরকারে তাদের উদার দৃষ্টিভঙ্গি কতটা থাকবে সেটি প্রশ্নসাপেক্ষ।
তাছাড়া, পারসি-ভাষী তাজিক এবং শিয়া হাজারার মতো জাতিগত দলগুলোর সঙ্গে তালেবান কেমন আচরণ করবে সেটিও স্পষ্ট নয়। আফগানিস্তানের প্রধানত পশতুন জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন তালেবানকে নিয়ে আফগানদের আনেকের মধ্যেই সংশয় আছে।
ঘরে-বাইরে অনেকেই বলছেন, তারা তালেবানের কথা নয়, কাজ দেখতে চান। তাই আস্থার ঘাটতি দূর করতে হলে কেবল কথায় চিড়ে ভিজবে না, কাজও করে দেখাতে হবে তালেবানকে।
আরও পড়ুন-