Published : 22 Jul 2021, 11:38 AM
বুধবার ইসরায়েলের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের বরাতে ব্রিটিশ সংবাদপত্র দ্য গার্ডিয়ান জানায়, দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, বিচার মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সামরিক গোয়েন্দা বিভাগ ও জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে এই টাস্ক ফোর্স গঠন করা হয়েছে।
ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ানসহ ১৬টি সংবাদপত্রের অনুসন্ধানের মধ্য দিয়েই পেগাসাস কেলেঙ্কারি প্রকাশ্যে এসেছে। বলা হচ্ছে, এনএসও গ্রুপ থেকে এই স্পাইওয়্যার কিনে নিজের দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ওপর নজরদারি চালিয়ে আসছে ‘কর্তৃত্ববাদী’ সরকারগুলো।
পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক কর্মকর্তার বরাতে মঙ্গলবার রাতে ইসরায়েলের সংবাদ মাধ্যমগুলো জানায়, এই টাস্ক ফোর্স খাতিয়ে দেখবে স্পর্শকাতর সাইবার সরঞ্জামাদি বিক্রির ক্ষেত্রে কোনো ধরনের ‘নীতি পরিবর্তন’ দরকার আছে কিনা।
গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘কর্তৃত্ববাদী’ সরকারগুলোর কাছে পেগাসাস স্পাইওয়্যার বিক্রির খবর ফাঁসের পর ইসরায়েলের উপর কূটনৈতিক চাপ বেড়েছে।
ছবি: ফরবিডেন স্টোরিস
মঙ্গলবার ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেনি গানৎজ বলেন, এনএসওর পেগাসাস প্রকল্পের কথা জানাজানি হওয়ার পর তাদের সরকার বিষয়টি ‘খতিয়ে’ দেখছে।
“আমরা সাইবার পণ্য রপ্তানির অনুমোদন দিয়েছি শুধু বিভিন্ন দেশের সরকারের কাছে বিক্রি করতে এবং শুধু আইনসম্মতভাবে তা ব্যবহারের জন্য।”
পেগাসাস স্পাইওয়্যার কোথাও বিক্রির ক্ষেত্রে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় তথা সরকারের অনুমোদন নিতে হয়। অপরাধীদের উপর নজরদারি চালাতে তা শুধু সরকারি কোনো সংস্থার কাছেই বিক্রি করা হয়। আর তার আগে সংশ্লিষ্ট দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি খতিয়ে দেখে ইসরায়েল সরকার।
তেল আবিব ইউনিভার্সিটিতে একটি সাইবার সম্মেলনে বক্তৃতায় গানৎজ আরও বলেন, “যেসব দেশ এ ধরনের ব্যবস্থা কিনেছে, তাদের অবশ্যই ব্যবহারবিধি মেনে চলতে হবে।”
পেগাসাস প্রকল্পের এহেন গোমর ফাঁস হওয়ার পর অন্য ইসরায়েলি কোম্পানিগুলোর ব্যবসায় এর কী প্রভাব পড়বে এবং ইসরায়েলের সর্বাধুনিক প্রযুক্তির সাইবার অস্ত্র শিল্পখাতের ভবিষ্যৎ কোন দিকে যাবে তা নিয়ে আশঙ্কায় রয়েছেন কর্মকর্তারা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা ইসরায়েলের মারিভ নিউজকে বলেন, “এটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ... আমরা এখনও এর পরিপূর্ণ গুরুত্ব উপলব্ধি করার চেষ্টা করছি।”
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একজন মুখপাত্রের সঙ্গে গার্ডিয়ানের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে তিনি টাস্ক ফোর্স গঠনের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
ছবি: এনএসও গ্রুপের ওয়েবসাইট থেকে
ফাঁস হওয়া একটি ডেটাবেইসে এই ফোন নম্বরগুলো প্রথমে পায় প্যারিসভিত্তিক সংস্থা ফরবিডেন স্টোরিজ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, পরে তারা গার্ডিয়ান, দ্য অয়্যারসহ ১৬টি সংবাদ মাধ্যমকে তা জানায়। তারা সবাই মিলে এই অনুসন্ধানের নাম দিয়েছে ‘পেগাসাস প্রজেক্ট’।
ডেটাবেইসের ওই তালিকায় এই ফোন নম্বরগুলো থাকার মানে এটা নিশ্চিত নয় যে ওই স্মার্টফোনটি পেগাসাস দিয়ে হ্যাক করা হয়েছে। তবে ‘পেগাসাস প্রজেক্ট’ এটা দৃঢ়ভাবে মনে করে যে এনএসওর গ্রাহক সরকারগুলোর লক্ষ্যবস্তু ছিল ওই নম্বরগুলো।
এই নম্বরগুলোর কিছু ফোনের ফরেনসিক পরীক্ষায় অর্ধেকের বেশিগুলোতে পেগাসাস ম্যালওয়্যারের উপস্থিতি পাওয়া গেছে বলে গার্ডিয়ান জানিয়েছে।
একাধিক বিবৃতিতে এনএসও অস্বীকার করেছে যে ওই তালিকাটি শুধু নজরদারির জন্যই ব্যবহার করা হতো। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, তালিকার নম্বরগুলো একটি বৃহত্তর তালিকার অংশ যেখানে এনএসওর কর্মীরা তাদের গ্রাহকদের সঙ্গে অন্যান্য কাজেও যোগাযোগ করে থাকতে পারেন।
তবে তালিকা পর্যালোচনা করে এটা বিশ্বাস করার মতো যথেষ্ট কারণ রয়েছে, যে যেসব ব্যক্তির ফোন নম্বর চিহ্নিত করা গেছে তাদের বিষয়ে এনএসওর গ্রাহক সরকারগুলোর আগ্রহ রয়েছে। এদের মধ্যে ওইসব ব্যক্তিও রয়েছেন যাদের ফোনের ফরেনসিক পরীক্ষায় এনএসওর ফোন-হ্যাকিং স্পাইওয়্যারের উপস্থিতি শনাক্ত হয়েছে।
পেগাসাস প্রজেক্টের বিস্তৃত তদন্তে দেখা গেছে ইসরায়েল রাষ্ট্রের সঙ্গে এনএসওর নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে, এবং ২০১৭ সালে ইসরায়েলের সরকার কোম্পানিটিকে বিশেষ অনুমতি দেয় তাদের হ্যাকিং টুল সৌদি আরবের কাছে বিক্রির চেষ্টা করার জন্য, যে বিক্রয় চুক্তির মূল্য কমপক্ষে সাড়ে ৫ কোটি ডলার হতে পারতো বলে ধারণা পাওয়া গেছে।
ভারত, হাঙ্গেরিসহ যে ১০টি দেশ এসএসওর স্পাইওয়্যার ব্যবহার করেছে বা করছে বলে ফরেনসিক বিশ্লেষণে প্রমাণ মিলেছে, তাদের সবার সঙ্গেই ইসরায়েলের বাণিজ্যিক বা কূটনৈতিক সম্পর্ক আছে এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে। কোন কোন দেশের সরকারের কাছে এনএসও তাদের প্রযুক্তি বিক্রি করেছে তা নিশ্চিত না করলেও কোম্পানিটি জানিয়েছে ইসরায়েলের সরকারের সামরিক বাহিনী, গোয়েন্দা বিভাগ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা সংস্থার সযত্ন অনুমোদনের পরই তারা প্রযুক্তি বিক্রির পথে আগায়।
পেগাসাস প্রজেক্টের সংবাদ প্রচারের ফলে ইসরায়েলে প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেটের নবগঠিত জোট সরকার শুরুতেই একটি কূটনৈতিক সংকটে পড়েছে। এই অনুসন্ধানের বেশিরভাগই তার পূর্বসূরি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকারের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
মঙ্গলবার জানা গেছে ফ্রান্সের পরিবেশ বিষয়ক মন্ত্রী ফ্রাঁসোয়া দে রুগির আইফোনেও পেগাসাস স্পাইওয়্যারের উপস্থিতি শনাক্ত হয়েছে।
তবে এসএসওর একজন মুখপাত্র দাবি করেছেন, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ, মন্ত্রী দে রুগি এবং অন্যান্য ফরাসি মন্ত্রীরা, যাদের ফোন নম্বর ওই ডেটাবেজে পাওয়া গেছে, কখনই পেগাসাসের লক্ষ্য ছিলেন না।
“এটা এনএসওর গ্রাহকদের টার্গেট বা সম্ভাব্য টার্গেটদের তালিকা নয়,” দাবি করেন তিনি।
পেগাসাস প্রজেক্ট প্রকাশ হওয়ার পর একমাত্র প্রকাশ্য মন্তব্যে এনএসওর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী শালেভ হুলিও বলেন, ফাঁস হওয়া তথ্যউপাত্তের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে তিনি সংশয় জানিয়ে যাবেন এবং ‘এর সঙ্গে এনএসওর কোন সংশ্লিষ্টতা নেই’ বলে দাবি জানানো অব্যাহত রাখবেন।
তবে তিনি এটাও জানিয়েছেন, যে খবরগুলো প্রকাশ হয়েছে তা নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন এবং প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এসব ঘটনা তদন্ত করে দেখবেন।