ইউক্রেইন যুদ্ধ প্রায় ১০০০ দিনে গড়াতে চলেছে। এ সময়টি ছোট্ট একটি শিশু আর তার পরিবারের জন্য কতটা চ্যালেঞ্জ হয়ে ছিল- সেকথা বর্ণনা করেছেন এক ইউক্রেইনীয় নারী।
Published : 15 Nov 2024, 08:09 PM
প্রায় তিন বছর আগে চতুর্থ সন্তানের জন্ম দিতে হাসপাতালে যাওয়ার পথে ইউক্রেইনের নাগরিক লিউডমিলা রোডচেঙ্কো রাস্তায় কাপড় দিয়ে মোড়ানো সাধারন মানুষের মৃতদেহ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকতে দেখেছেন।
তার সন্তান ইয়েভহেন স্তেপানেঙ্কোর জন্মের ঠিক একদিন পর ওই হাসপাতালের বাইরে রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর একটি ট্যাংক দাঁড় করানো ছিল।
আক্রমণকারী রাশিয়ান বাহিনী ইউক্রেইনের রাজধানী কিইভের পাশে রোডচেঙ্কোর নিজ শহর বুচা দখল করে নেওয়ায় ৪২ বছর বয়সী ওই নারী তড়িঘড়ি তার নবজাতক পুত্রকে একটি কম্বলে জড়িয়ে আর তার অন্য সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে মধ্য পোলতাভা অঞ্চলের তুলনামূলক নিরাপদ আশ্রয়ে পালিয়ে যান।
রোডচেঙ্কো বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, "খুব অনিশ্চয়তা নিয়েই হাসপাতাল থেকে বেরিয়েছিলাম সেদিন। পরের দিনের কথা বাদই দিলাম, পরের এক বা দুই-তিন ঘণ্টায় আমাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে তাও জানা ছিল না।”
“আমার সন্তানের বয়স তখন মাত্র তিন দিন। সেই সময়ে তাকে কঠিন এক যাত্রাপথ পাড়ি দিতে হয়েছে। সে কম্বলে জড়ানো ছিল, তার মুখও দেখা যাচ্ছিল না। প্রচন্ড ঠান্ডা, তুষারপাতসহ নানা প্রতিকূলতা মাথায় নিয়েই আমি ওদের নিয়ে গিয়েছিলাম।”
রয়টার্সের কাছে সেই ভয়াবহ সময় পার করার কাহিনী বর্ণনা করে রোডচেঙ্কো বলেন, তার শিশুর জন্য বেবি ফর্মুলা বানাতে চেকপয়েন্টে সেনাদের কাছ থেকে গরম পানি সংগ্রহ করতে হয়েছিল।
দুঃসহ সময়ে জন্ম নেওয়া সেই শিশু ইয়েভহেন ইউক্রেইনের পূর্ণ-মাত্রার যুদ্ধে জন্ম নেওয়া হাজার হাজার শিশুরই একজন, যে যুদ্ধ আজ প্রায় ১০০০ দিনে গড়াতে চলেছে। এ সময়টা যে ঐটুকু শিশু আর তার পরিবারের জন্য কত বড় চ্যালেঞ্জ ছিল, তা আর দুটো সাধারণ পরিবার ধারণাও করতে পারবে না।
জন্মের পর থেকে শিশুটির শৈশবের স্মৃতি জুড়ে আছে শুধু আতংক। যদিও ওই মূহুর্তে ভয়বহতা বাড়ার আগেই রোডচেঙ্কো ও তার সন্তানরা বুচা থেকে পালাতে সক্ষম হয়েছিলেন।
শহরটিতে রুশ বাহিনীর বর্বরতা কতটা তা স্পষ্টতই চোখে পড়েছিল তাদের। কয়েক ডজন সাধারন মানুষের মৃতদেহ রাস্তার পাশে পড়ে থাকতে দেখেছিল তারা। যদিও রাশিয়া যুদ্ধে সাধারন মানুষ হত্যার কথা অস্বীকার করে আসছে বরাবরই। তাদের দাবি, বুচার বর্বরতা সম্পূর্ণ বানোয়াট।
যুদ্ধের বাস্তবতা ধীরে ধীরে গেঁড়ে বসার কারণে অন্যান্য ইউক্রেইনীয়দের মতো রোডচেঙ্কোও কিছুটা স্বাভাবিক জীবন যাপনের চেষ্টা নিয়েছেন।
ইউক্রেনজুড়ে প্রায় প্রতিদিনই রুশ ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার সতর্কবার্তার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমি তার (ইয়েভহেন) স্বাভাবিক শৈশব নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছি। বিমান হামলার শব্দের দিকে সে যাতে মনোযোগ না দেয় সেদিকে খেয়াল রেখেছি।”
“কিন্তু যখন আমি আমার ফোনে বিমান হামলার নোটিফিকেশন পাই, তখন সে বলে ওঠে: “মা, ভয় পাচ্ছি, আমি ভয় পাচ্ছি।” যখন অল-ক্লিয়ার শোনায়, তখন সে বলে: 'ক্লিয়ারড!', যদিও আমার ধারণা সে এর অর্থ পুরোপুরি বুঝতে পারে না।”
রোডচেঙ্কোর আশঙ্কা, এ লড়াই বছরের পর বছর ধরে চলতে পারে। ইউক্রেইনের পূর্বাঞ্চলে গ্রামের পর গ্রাম রাশিয়ার সেনারা দখল করে নিচ্ছে।
ওদিকে, যুক্তরাষ্ট্রে নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প শিগগিরই হোয়াইট হাউজে তার আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু করবেন। তিনি দায়িত্ব গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গেই ইউক্রেনীয়রা যুদ্ধে তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিত্রকে হারাতে পারে বলে আশঙ্কা করছে।
রোডচেঙ্কো বলেন, “আমি খুবই চাই যুদ্ধটা এবার শেষ হোক। আমি চাই আর পাঁচটা সাধারণ শিশুর মত আমার সন্তানরা সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন যাপন করুক। আমার সন্তানদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ হোক।”
তিনি আরও বলেন, ক্রমাগত আক্রমণের হুমকি তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর কী প্রভাব ফেলবে তা ভেবে আমরা খুবই শঙ্কিত। লাখ লাখ মানুষ তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে গেছে, তাদের মধ্যে অনেক নারী ও শিশুও রয়েছে যারা বিদেশে চলে গেছে। রোডচেঙ্কো বলেন, তিনি দেশ ছাড়ার কথা ভেবেছিলেন, কিন্তু সেটি খুব কঠিন এবং ব্যয়বহুল।
বুচা’র একটি ডে কেয়ার সেন্টারে ইয়েভহেন সহ অন্যান্য শিশুদের দেখাশোনা করা নাতালিয়া তাতুশেঙ্কো বলেন, “দুই বছর বয়সী এই শিশু ও তার সঙ্গেকার অন্যান্য শিশুরা যুদ্ধের আগে জন্ম নেওয়া শিশুদের চেয়ে বেশি সংবেদনশীল। তারা তাদের মায়ের কাছ থেকে আলাদা হতে খুব ভয় পায়, কারণ তারা সেখানেই সম্ভবত নিরাপদ বোধ করে।”
তাতুশেঙ্কো আরও বলেন, “এখন তারা ছোট তাই এখনও কিছুটা শিশুদের মতো আচরণ করে। কিন্তু যখন তারা একটু বড় হবে তখন চাপের পরিস্থিতিতেও শান্ত হয়ে থাকতে পারবে।”