সৎকারের খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণে মৃত ব্যক্তির পরিবার, বন্ধু বা অন্য কেউ লাশের দাবি করছে না।
Published : 19 May 2024, 12:24 PM
প্রিয়জন মারা গেলে তাকে মর্যাদার সঙ্গে শেষ বিদায় জানানোর চিরায়িত রীতি কানাডার কয়েক প্রদেশে হোঁচট খেয়েছে অর্থাভাবে; মৃত্যুর পর দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও লাশ নিতে আসছেন না স্বজনরা, মিলছে না দাবিদারও।
কানাডার কিছু প্রদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দাবি-দাওয়াহীন এমন লাশের সংখ্যা খুবই বেড়ে গেছে বলে রয়টার্স জানিয়েছে।
স্বজনরা বলছেন, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণে প্রিয়জনদের মরদেহের দাবি নিয়ে মর্গে যাচ্ছেন না তারা। এ পরিস্থিতিতে কানাডার একটি প্রদেশে লাশ সংরক্ষণের জায়গা বাড়ানোর কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে।
‘অজ্ঞাত লাশ’ সৎকারে তহবিল সংগ্রহ করে চলা সংগঠন বা সংস্থার সংখ্যাও বেড়েছে অনেক।
লাশ দাফনের বিষয়টি বেশির ভাগ দেশে ধর্মীয় রীতিতে করা হয়। এটি বোঝাতে বেশি ব্যবহৃত কয়েকটি শব্দের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-‘দাফন’, ‘সৎকার’, ‘সমাহিতকরণ’।
রয়টার্স লিখেছে, কানাডায় ১৯৯৮ সালে মৃতদেহ সৎকারের খরচ ছিল ৬ হাজার ডলার। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৮০০ ডলারে।
দেশটির সবচেয়ে জনবহুল অন্টারিও প্রদেশে অপঘাতজনিত মৃত্যুর তদন্তকারী প্রধান কর্মকর্তা ডার্ক হুয়ার বলেন, ২০১৩ সালে স্বজনদের দাবি-দাওয়া নেই এমন লাশের সংখ্যা ছিল ২৪২টি। গত বছর (২০২৩) সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ১৮৩টিতে।
রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মৃত ব্যক্তির স্বজনদের খুঁজে পাওয়া যায় কিন্তু নানা কারণে তারা লাশ নিতে চান না; যার মধ্যে প্রধান কারণ হল লাশ সৎকারের বিশাল খরচ। আর্থিক কারণে ২০২২ সালে লাশের দাবি করা হয়নি, এমন হার ছিল ২০ শতাংশ। কিন্তু পরের বছর তা বেড়ে হয় ২৪ শতাংশ।
এমন চিত্র ‘হতাশাজনক’ মন্তব্য করে ডার্ক হুয়ার বলেন, একজন ব্যক্তির মৃত্যুর পর তার লাশের কী হবে, সে ব্যাপারে তার পরিবার, বন্ধুবান্ধব বা অন্য কেউ থাকছে না।
রয়টার্স লিখেছে, অন্টারিওতে লাশ হস্তান্তরের কিছু নিয়ম আছে। এ প্রদেশে সাধারণত কারও মৃত্যুর ২৪ ঘণ্টা পার হলে, লাশটি ‘অজ্ঞাত’ বলে ধরা হয়। ব্যক্তির মৃত্যুর কারণ তদন্তে নিয়োজিত কর্মকর্তারা কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত স্বজনদের খোঁজ করেন।
যদি কোনো স্বজনকে পাওয়া যায় এবং তারা যদি লাশ না নিতে চান, তখন স্থানীয় পৌরসভা সৎকারে নিয়োজিত কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করে তা সমাহিতের ব্যবস্থা করে। এর আগে পর্যন্ত লাশ রাখা হয় কোনো মর্গ বা তাপনিয়ন্ত্রিত সংরক্ষণাগারে।
টরন্টোভিত্তিক অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পাদনকারী কোম্পানি ম্যাককিনন ও বোয়েসের মালিক অ্যালান কোল বলেন, “মরদেহ সৎকারে বাড়তি সহযোগিতা প্রয়োজন এমন পরিবার সবসময়ই ছিল। তবে বর্তামানে যে বিপুল পরিমাণ পরিবার লাশের দাবি করছে না, তা আমি কখনই দেখিনি।”
কানাডার কিউবেকে ২০১৩ সালে দাবি-দাওয়াহীন লাশের সংখ্যা ছিল ৬৬টি, ২০২৩ সালে যা ১৮৩টিতে দাঁড়িয়েছে। আলবার্তায় ২০১৬ সালে এমন লাশ ছিল ৮০টি, আর ২০২৩ সালে পৌঁছেছে ২০০টিতে।
নিউফাউন্ডল্যান্ড অ্যান্ড ল্যাব্রাটর প্রদেশের সেন্ট জন’স হেলথ সায়েন্সেস সেন্টারে ’দাবি না করা’ এমন লাশের স্বজনের খোঁজে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করার ইতিহাস নেই বলে রয়টার্সকে বলেন সেখানকার হেলথ সার্ভিসেসের একজন মুখপাত্র।
তবে দাবি না করা লাশ এখন হাসপাতালের বাইরে তাপনিয়ন্ত্রিত যন্ত্রে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। মরদেহগুলো সংরক্ষণের স্থায়ী ব্যবস্থা করতে সংরক্ষণাগার নির্মাণ করছে প্রদেশ কর্তৃপক্ষ।
প্রদেশটির বিরোধীদলীয় নেতা নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টির জিম ডিন বলেন, “লোকজন লাশ দাবি করছে না, কারণ তারা বুঝেছে লাশ সৎকারের খরচ সামলাতে পারবে না। এজন্য বিশাল মর্গ তৈরি করতে হবে, বিষয়টি এমনও নয়।
“এমন ঘটনার কারণ বা যে বিপত্তিগুলো আছে, সেগুলোর সমাধান করতে হবে, যাতে মানুষ মর্যাদার সঙ্গে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পাদন করতে পারে।”
সমাহিতের স্থানও একটা বিষয়
লাশ সৎকারে কানাডার নামি সংস্থা ‘মাউন্ট প্লিজান্ট গ্রুপ’। অন্টারিও, টরন্টোসহ দেশটির বিভিন্ন স্থানে তাদের সমাধিক্ষেত্র রয়েছে এবং অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া, দাফনসহ কবরের স্থান বিক্রি বা ভাড়া দিয়ে থাকে। এ গ্রুপের কোনো সাধারণ সমাধিক্ষেত্রে একটি কবরের স্থানের জন্য খরচ পড়ে ২ হাজার ৮০০ ডলার।
তবে সমাধিক্ষেত্রটি যদি হয় টরন্টো শহরের মধ্যের কোনো স্থানে, তখন খরচটি আর সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে থাকে না। গ্রুপের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, টরন্টো শহরের মধ্য এলাকার কোনো সমাধিক্ষেত্রে একটি করবের স্থান পেতে ৩৪ হাজার ডলার পর্যন্ত খরচ দিতে হয়।
কবর খোঁড়া, কফিন ও কবর ঢেকে দেওয়া এবং করসহ অন্যান্য সব ব্যয় ওই ৩৪ হাজার ডলারের বাইরে আলাদা দিতে হয়।
ফিউনেরাল সার্ভিসেস অ্যাসোসিয়েশন অব কানাডার সভাপতি জেফ ওয়েফার বলেন, একটি লাশ সৎকারে গড়ে ২ হাজার ১২ হাজার ডলার খরচ হওয়ার কথা। ১৯৯৮ সালে গড়ে যা ছিল ১ হাজার ৮০০ ডলার, সেখান থেকে তা বাড়তে বাড়তে এখন এসে দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৮০০ ডলারে।
গণমানুষের কাছ থেকে তহবিল সংগ্রহের (ক্রাউডফান্ড) প্রতিষ্ঠান ‘গোফান্ডমি’র ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, লাশ সৎকারের দাতব্য সংস্থার সংখ্যা ২০১৩ সালে যেখানে ছিল মাত্র ৩৬টি, বর্তমানে তা ১০ হাজার ২৫৭টিতে এসে ঠেকেছে।
লাশ সৎকারে বেড়ে চলা ব্যয় সংকুলানে চাহিদা অনুযায়ী সহযোগিতা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে কানাডা সরকারও। অবশ্য এপ্রিলে সরকার পেনশন পরিকল্পনার আওতায় কোনো নাগরিকের মৃত্যুতে ডেথ বেনিফিট হিসেবে আড়াই হাজার কানাডীয় ডলারের সঙ্গে অতিরিক্ত আড়াই হাজার ডলার দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।
কানাডার অর্থমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ডের প্রেস সেক্রেটারি ক্যাথেরিন কাপলিনস্কা ইমেইল বার্তায় রয়টার্সকে বলেছেন, “আপনার প্রিয় জীবনসঙ্গী বা স্বামী-স্ত্রীকে হারানোর ঘটনা পরিবারের বড়দের জন্য বিপর্যয়কর পরিস্থিতি ডেকে আনে। জীবনভর হাড়হাড্ডি পরিশ্রম করার পর কারও মৃত্যু প্রচণ্ড আর্থিক বোঝাও বয়ে আনতে পারে।
“যে কারণে আমরা কানাডার পেনশন পরিকল্পনা শক্তিশালী করছি, যাতে মৃত্যুর পর নাগরিককে ডেথ বেনিফিটের অর্থের সঙ্গে অতিরিক্ত আড়াই হাজার করে ডলার দেওয়া যায়।”
জেফ ওয়েফার যদিও বলছেন, এ পরিমাণ অর্থ যথেষ্ট নয়।
“কানাডীয়দের জন্য এটি মর্যাদাপূর্ণ শেষ বিদায় নয়”: অক্ষেপ করে তিনি বলেন, “ব্যক্তির মরদেহ দাবি না করার বিষয়টি নির্ভর করে ব্যয়ভার বহন করায় তার পরিবারের সক্ষমতার ওপর।”