যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান দলীয় প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ট্রাম্প ও তার উপদেষ্টাদের অনেকে ভ্যান্সের রূপান্তরকে ‘খাঁটি’ হিসেবেই বিবেচনা করেন।
Published : 17 Jul 2024, 03:48 PM
আট বছর আগে ডনাল্ড ট্রাম্পের কট্টর সমালোচক ছিলেন জে. ডি. ভ্যান্স, তখন ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে আর ভ্যান্স বলছেন, “আমি কখনোই ট্রাম্পের পক্ষে নই। আমি কখনোই তাকে পছন্দ করি নাই।”
প্রকাশ্যে রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকে নিয়ে করা মন্তব্যে তিনি বলেছেন, “হায় ঈশ্বর, কি নির্বোধ।”
ট্রাম্পকে ‘নিন্দার যোগ্য’ বলতেও ছাড়েননি তিনি। আড়ালে ট্রাম্পকে অ্যাডলফ হিটলারের সঙ্গে তুলনা করতেন তিনি।
কিন্তু আট বছর পরে ওহাইওর স্থানীয় বাসিন্দা ভ্যান্স ট্রাম্পের প্রবল সমর্থকে পরিণত হন, যখন রিপাবলিকান দলের স্বনামধন্য নেতারা ট্রাম্পের পাশে দাঁড়াতে অস্বীকার করেন তখন ভ্যান্স দৃঢ়ভাবে তার পাশে দাঁড়ান। সোমবার সেই ভ্যান্সকেই নিজের রানিং মেট হিসেবে ঘোষণা করেছেন ট্রাম্প।
‘কখনও ট্রাম্পার হবেন না’ এমন ঘোষণা দিলেও জেমস ডেভিড ভ্যান্স রূপান্তরিত হয়ে পুরোপুরি ট্রাম্পের অনুগত একজনে পরিণত হয়েছেন। এর ফলে ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠজনদের মধ্যে তুলনামূলক অস্বাভাবিক ব্যক্তিত্ব হয়ে রয়েছেন তিনি, জানিয়েছে রয়টার্স।
ডেমোক্র্যাটরাতো অবশ্যই এমনকী কিছু রিপাবলিকানও প্রশ্ন তুলেছিলেন, বেস্টসেলার স্মৃতিকথা ‘হিলবিলি এলিজি’ লিখে খ্যাতিমান হয়ে ওঠা আর এখন ওহাইও থেকে মার্কিন সেনেটর হওয়া ভ্যান্স কী আদর্শের চেয়ে সুবিধাবাদ দিয়েই বেশি চালিত হয়েছেন কি না।
কিন্তু শনিবার পেনসিলভেইনিয়ার নির্বাচনী সমাবেশে হত্যা চেষ্টা থেকে অল্পের জন্য বেঁচে ফিরে আসা ট্রাম্প ও তার উপদেষ্টাদের অনেকে ভ্যান্সের রূপান্তরকে ‘খাঁটি’ হিসেবেই বিবেচনা করেন।
বিবিসি লিখেছে, ওহাইও রাজ্যে প্রথমবারের মতো সিনেটর হওয়া ভ্যান্সই এখন ট্রাম্পের ভাইস প্রেসিডেন্ট রানিং মেট হিসেবে নভেম্বরের নির্বাচনে লড়তে যাচ্ছেন। সবকিছু পরিকল্পনা মতো হলে ২০২৮ সালে তিনি রিপাবলিকান দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হওয়ার সুযোগ পাবেন। কারণ ট্রাম্প আর তখন দাঁড়াতে পারবেন না।
আসলে ভ্যান্স নিজের অভ্যাসের কিছু পরিবর্তন এনেছে। কঠোর শাসনে বেড়ে ওঠা এই ব্যক্তি কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির সর্বোচ্চ স্তরে উঠলেন, সেই প্রশ্ন এখন সামনে আসছে।
খ্যাতি আনে স্মৃতিকথা
ওহাই রাজ্যের মিডলটাউনে জন্মগ্রহণকারী ভ্যান্সের ছোটোবেলায় নাম ছিল জেমস ডেভিড বোম্যান নামে। তার মা মাদকাসক্তি থেকে বের হয়ে আসার জন্য লড়াই করছিলেন আর ভ্যান্সের ছোটোবেলাতেই তার বাবা তাদের পরিবার ছেড়ে চলে যান।
তিনি বেড়ে ওঠেন দাদা-দাদির কাছে, যাদেরকে তিনি ‘মামা’, ‘পাপা’ বলে ডাকতেন। দাদা-দাদির কথা সহানুভূতির সঙ্গে ভ্যান্স তার স্মৃতিকথায় তুলে ধরেছেন।
মিডলটাউন যদিও ওহাইও রাজ্যের রাস্ট-বেল্ট অঞ্চলে অবস্থিত, কিন্তু ভ্যান্স তার পরিবারের শেকড় খুঁজে পান অ্যাপালাচিয়ার খানিক দক্ষিণে। বিশাল এই পার্বত্যাঞ্চল ডিপ সাউথ থেকে শুরু করে শিল্পাঞ্চল মিডওয়েস্ট পর্যন্ত বিস্তৃত। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি দরিদ্রতম এলাকা আছে।
বিবিসি লিখেছে, ভ্যান্স তার বইয়ে বন্ধু ও পরিবারের সদস্যদের কারণে কষ্টভোগ, নিদারুণ পরিশ্রম ও বাজে সিদ্ধান্তের কথা নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন। বইয়ে সেই স্বজন-বন্ধুদের কঠোর অপব্যয়ী হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, যারা কল্যাণ তহবিলের ওপর নির্ভরশীল এবং বেশিরভাগই নিজের চেষ্টায় দাঁড়াতে ব্যর্থ হয়।
ভ্যান্স লিখেছেন, তিনি অ্যাপালাচিয়ানদের ‘খারাপ পরিস্থিতিতে সবচেয়ে খারাপ উপায়ে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করতে’ দেখেছিলেন।
তিনি লিখেছে, “সত্য কঠিন এবং পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে কঠিন সত্য হচ্ছে তাদের কথা তাদেরকেই বলতে হবে।”
স্মৃতিকথায় বিশেষ করে ‘অভিজাত’ সমাজের প্রতি ভ্যান্সের ঘৃণা ফুটে উঠেছে। সেই সঙ্গে যাদের সঙ্গে তার বেড়ে ওঠা- একক প্রচেষ্টায় বেড়ে উঠতে ব্যর্থদের বিপরীতে তিনি নিজেকে তুলে ধরেন।
বইটি প্রকাশ হওয়ার সময় ভ্যান্স তার নিজের এলাকা মিডলটাউন থেকে অনেক দূরে ছিলেন। প্রথমে নৌবাহিনীর চাকরি ও ইরাকে পেশাগত সফর এবং পরে ওহিও স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়, ইয়েল ল স্কুলের চাকরি এবং ক্যালিফোর্নিয়ায় ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্টের ভূমিকায় ছিলেন।
‘হিলবিলি এলিজি’ ভ্যান্সকে বেস্টসেলিং লেখকের খ্যাতির পাশাপাশি রিপাবলিকান শিবিরের কাছেও প্রয়োজনীয় করে তোলে। শ্বেতাঙ্গ, শ্রমজীবী ভোটারদের কাছে ট্রাম্পের আবেদন ব্যাখ্যা করার জন্য তাকে ঘন ঘন তলব করতে থাকে তারা।
ভেঞ্চার ক্যাপিটাল থেকে রাজনীতি
২০১৭ সালে ভ্যান্স ওহাইতে ফিরে আসেন এবং ভেনচার ক্যাপিটালের কাজ চালিয়ে যান। তিনি ইয়েলে থাকা অবস্থায় ভারতীয় বংশোদ্ভূত ঊষা চিলুকুরি ভ্যান্সকে বিয়ে করেন। তাদের তিনটি সন্তান রয়েছে - ইওয়ান, বিবেক ও মিরাবেল।
সান দিয়েগোতে বেড়ে ওঠা ভারতীয় অভিবাসীর সন্তান ঊষা ভ্যান্সের অতীত অভিজ্ঞতা তার স্বামীর থেকে একেবারেই আলাদা। ইয়েলের স্নাতক ঊষা স্নাতকোত্তর করেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। আইনে পড়াশোনা শেষে তিনি সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি জন রবার্টসের কর্মচারী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে ঊষা একজন আইনজীবী হিসেবে কাজ করছেন।
বিবিসি লিখেছে, রাজনীতির মাঠে প্রার্থী হিসেবে ভ্যান্সের নাম দীর্ঘদিন ধরে আলোচনায় ছিল। ২০২২ সালের পুনর্নির্বাচনে ওহাইওর রিপাবলিকান সেনেটর রব পোর্টম্যান আর ভোট করতে না চাইলে সেই সুযোগ ধরা দেয় ভ্যান্সের কাছে।
যদিও তার প্রচারের শুরুটা ধীর গতিতে চলছিল, তবে তার একসময়ের বস, সিলিকন ভ্যালির পিটার থিয়েলের কাছ থেকে এক কোটি ডলার পেয়ে তাতে গতি আসে। তবে রিপাবলিকান পার্টি থেকে ওহাইওতে নির্বাচিত হতে মূল বাধা হিসেবে দাঁড়ায় ট্রাম্পকে নিয়ে তার অতীত সমালোচনা।
ভ্যান্স তার অতীত মন্তব্যের জন্য ক্ষমা চেয়েছিলেন। একপর্যায়ে তিনি ট্রাম্পের সমর্থনও অর্জন করেন এবং রিপাবলিকানের মনোনয়ন পান। শেষ পর্যন্ত তিনি সেনেটর নির্বাচিত হন।
চৌকস এই রাজনীতিক ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ রাজনীতিতে ধীরে ধীরে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হয়ে উঠেছেন, আর ট্রাম্পের প্রায় সব এজেন্ডায় অবদান রেখেছেন।
বিভিন্ন বিষয়ে তার অবস্থান কেমন?
রক্ষণশীল ভোটার হিসেবে সিনেটে তিনি নির্ভরযোগ্য হয়ে উঠেছেন। জনপ্রিয় অর্থনৈতিক নীতির যেমন তিনি সমর্থনকারী, তেমনই ইউক্রেইনকে সহায়তার প্রশ্নে তিনি অন্যতম বিরোধিতাকারীর তকমা পেয়েছেন।
ডেমোক্র্যাট সরকারে ভ্যান্স তার সংক্ষিপ্ত মেয়াদে যেসব বিল তুলেছেন, সেগুলো তেমন একটা আলোর মুখ দেখেনি। এসব বিলে নীতি পরিবর্তনের চেয়ে বার্তাই বেশি পাঠিয়েছেন তিনি।
গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধের প্রতিবাদে যেসব কলেজে বিক্ষোভ হয়েছে এবং অনথিভুক্ত অভিবাসীদের নিয়োগকারী কলেজগুলোতে ফেডারেল তহবিল বন্ধ করার জন্য সম্প্রতি বিল উত্থাপন করেছিলেন ভ্যান্স।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য আইন না মানলে চীন সরকার যাতে যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাজার থেকে ছিটকে পড়ে- এমন একটি আইনের খসড়া গত মার্চে উত্থাপন করেন ভ্যান্স।
‘আমেরিকান ড্রিম’ ধারণা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "আপনি যে দেশটিকে বাড়ি বলছেন, সেখানে আপনার নিজের এবং আপনার পরিবারের জন্য একটি ভাল জীবন গড়ার সুযোগ থাকা উচিত, যা বামপন্থিদের দ্বারা অবরুদ্ধ ছিল “
২০১৯ সালে ক্যাথলিক ব্যাপটিস্ট হওয়া ভ্যান্স যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে গর্ভপাতের পক্ষে সমর্থন প্রকাশ করেন। তবে সম্প্রতি তিনি ট্রাম্পের মতামতের সঙ্গে একমত পোষণ করে বলেন যে, এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার আসলে রাজ্যগুলোর।
ট্রাম্পকে হিটলার তকমা দেওয়ার বিষয়টি ২০২২ সালে প্রকাশিত হওয়ার পর তার একজন প্রতিনিধি বলেছিলেন, এখন সেটি আর তার মতামত হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করে না।
ভ্যান্সকে রিপাবলিকান ও অন্যরা কীভাবে নিচ্ছেন?
ভ্যান্স সোমবার যখন মিলওয়াকিতে রিপাবলিকান দলের সম্মেলনস্থলে প্রবেশ করছিলেন, তখন করতালির মুহুর্মুহু শব্দ শোনা যায়। তাকে কিছুটা বিস্মিত দেখাচ্ছিল।
উত্তরপূর্ব ওহাইওর পোর্টেজ কাউন্টির দলীয় প্রধান আমান্ডা সাফেকুল বলেন, "তিনি নম্রতা দিয়ে শুরু করেছেন এবং তিনি তরুণ। অনেকেই ভাববে যে, সে তার মতো দেখতে।”
গত শনিবার নির্বাচনি সমাবেশে ডনাল্ড ট্রাম্পকে হত্যাচেষ্টার পরপরই ডেমোক্র্যাটদের প্রচারণার দিকে অভিযোগের তীর ছোড়াদের অন্যতম ভ্যান্স।
তিনি বলেন, "বাইডেনের প্রচারণার মূল কথা হচ্ছে প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প একজন স্বৈরাচারী ফ্যাসিবাদী, যাকে যে কোনো মূল্যে থামাতে হবে।
“এই কথাবার্তা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে হত্যাচেষ্টার দিকে সরাসরি উসকানি দিয়েছে।”
প্রেসিডেন্ট বাইডেন সোমবার এক বক্তব্যে ভ্যান্সকে 'ট্রাম্পের ক্লোন' বলে অভিহিত করেছেন।
আরও পড়ুন: