এই বস্তুগুলো আদতে কী, তা বুঝে উঠার জন্য কিছুটা সময় প্রয়োজন, বলেছেন এফবিআইয়ের সাবেক উপপরিচালক অ্যান্ড্রু ম্যাককেব।
Published : 14 Feb 2023, 05:46 PM
প্রথমে সাউথ ক্যারোলাইনার ওপর কথিত চীনা নজরদারি বেলুন, এরপর আলাস্কা, পরে কানাডা, তার পর হুরন হ্রদের ওপর- মাত্র দেড় সপ্তাহের ভেতর একে একে চারটি উড়ন্ত কিছুকে গুলি করে নামাল যুক্তরাষ্ট্র।
জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক মহলও এখন এইসব অজ্ঞাত উড়ন্ত বস্তু বা ইউপিএ নিয়ে মেতে আছে।
কথিত সেই চীনা নজরদারি বেলুন নিয়ে লঙ্কাকাণ্ডের কয়েকদিনের মধ্যে মার্কিন কর্মকর্তারা যুক্তরাষ্ট্রের আকাশসীমা পর্যবেক্ষণ নীতিতে পরিবর্তন এনেছেন, যুদ্ধবিমানগুলোও যুক্তরাষ্ট্রের ভূখণ্ডের ভেতরে, সীমান্তে কিংবা কানাডার খানিকটা ভেতরে ঢুকে তিনটি অজ্ঞাত বস্তুকে গুলি করে নামিয়েছে।
সিএনএন লিখেছে, শুক্রবার থেকে এ পর্যন্ত গুলি করে নামানো ওই তিনটি বস্তু কী জিনিস তা স্পষ্ট বলছেন না কেউ; এগুলোর পরিচয় দেওয়া হচ্ছে ‘অজ্ঞাত বস্তু’ হিসেবে। কেউই জানে না এগুলো কাদের, কোথা থেকে এসেছে।
তবে এগুলো যে অন্তত পৃথিবীর বাইরে থেকে আসেনি, হোয়াইট হাউস তা আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিতে চাইছে।
এলিয়েন নয়, হুমকিও নেই
“এইসব আকাশযানের ওপর ভিত্তি করে এলিয়েন বা ভিন গ্রহের প্রাণীদের নিয়ে মার্কিন জনগণের দুশ্চিন্তা করার প্রয়োজন আছে বলে মনে করছি না। এটা নিয়ে আর বলার কিছুও নেই,” সোমবার হোয়াইট হাউসের ব্রিফিংয়ে এমনটাই বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল কাউন্সিল কো-অর্ডিনেটর ফর স্ট্র্যাটেজিক কমিউনিকেশন্স জন কারবি।
গুলির পর আকাশ থেকে নেমে আসা বস্তুগুলো তাৎক্ষণিক কোনো হুমকি সৃষ্টি করেনি, কোনো ধরনের যোগাযোগের সংকেত পাঠায়নি, স্বচালিত বা দূর থেকে পরিচালনা করার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি, সেগুলোতে কোনো মানুষও ছিল না, বলেছেন তিনি।
এ বিষয় নিয়ে জো বাইডেনের প্রকাশ্যে কম মন্তব্য করা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণের পর যুক্তরাষ্ট্রের সরকার এখন বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখতে মনোযোগী হয়েছে।
জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেইক সুলিভানকে ঠিক করা হয়েছে অজ্ঞাত উড়ন্ত বস্তুগুলো পর্যালোচনায় একটি ‘আন্তঃসংস্থা দলের’ নেতৃত্ব দিতে।
তিন ‘অজ্ঞাত বস্তু’ সম্বন্ধে যা যা জানা গেছে
আলাস্কা এবং কানাডার উত্তরাঞ্চলে যেগুলো গুলি করে নামানো হয়েছে, সেগুলো বেলুন সদৃশ, সঙ্গে সংযুক্ত ছিল ছোট সিলিন্ডার আকৃতির ধাতব বস্তু। এগুলো ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪০ হাজার ফুট উঁচু দিয়ে উড়ছিল।
রোববার হুরন হ্রদের ওপর গুলি করে নামানো বস্তুটি প্রথম শনাক্ত হয় আগেরদিন, মন্টানায়। এটি আগেরগুলোর তুলনায় খানিকটা ভিন্ন ধরনের। অষ্টভুজাকৃতির, যার সঙ্গে লাগানো তার ঝুলে ছিল। এটি মিশিগানের আপার পেনিনসুলার ২০ হাজার ফুট উপর দিয়ে উড়েছিল।
এই উচ্চতায় বস্তুগুলো বিমান চলাচলে ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে বিবেচনায় মার্কিন সামরিক বাহিনী সেগুলোকে গুলি করে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয়।
ফিল্টারে বদল, অজ্ঞাত বস্তু দেখা শুরু
নর্থ আমেরিকান অ্যারোস্পেস ডিফেন্স কমান্ড (নোরাড) এখন যে আকাশে এত এত অজ্ঞাত উড়ন্ত বস্তু দেখছে, তার একটি কারণ হতে পারে সাম্প্রতিক সময়ে তাদের ‘ফিল্টারিংয়ে’ পরিবর্তন। এর ফলে কত উচ্চতায়, কী কী ধরনের বস্তু নিয়ে তাদের মাথা ঘামানো দরকার, সেটায় খানিকটা বদল এনেছে তারা।
নির্দিষ্ট উচ্চতায় ওড়া মন্থরগতির টার্গেট শনাক্তে তারা তাদের ফিল্টারে এই বদল এনেছে বলে বিষয়টি সম্বন্ধে অবগত একটি সূত্র সিএনএনকে বলেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ওপর দিয়ে চীনের একটি কথিত নজরদারি বেলুনের ওড়াউড়ি এবং যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে প্রবেশ করা সম্ভাব্য হুমকি মোকাবেলায় ওয়াশিংটনের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার পর গত সপ্তাহেই সামরিক বাহিনী তাদের ফিল্টারে এই বদল আনে, বলেছে ওই সূত্র।
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক উপপরিচালক, এখন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বেলফার সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের সিনিয়র ফেলো বেথ সানের বলেন, ২০২১ সালের মার্চ থেকে এ পর্যন্ত ২৪৭টি অজ্ঞাত উড়ন্ত বস্তুর খবর নথিভুক্ত করার খবর কংগ্রেসকে গত মাসেই জানিয়েছেন জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার পরিচালক।
তার আগে আরও ১১৯টি উড়ন্ত বস্তু সংক্রান্ত খবর পাওয়া গেছে।
এর অর্ধেকেরই ‘বেলুন বা বেলুনজাতীয় কিছু’ বৈশিষ্ট্যের কথা জানা গেছে। বাকিগুলোর মধ্যে কোনো কোনোটার বৈশিষ্ট্য ছিল ড্রোনের মতো। কয়েকটিকে ‘প্লাস্টিক ব্যাগের মতো বাতাসে ভাসা জঞ্জালের’ চেয়ে বেশি কিছু মনে হয়নি।
সানের বলছেন, আগে গুরুত্ব দেওয়া না হলেও এখন এই ধরনের অজ্ঞাত উড়ন্ত বস্তুকে গুরুত্ব দেওয়ার সময় এসেছে।
তবে প্রত্যেকটি ইউএপি-কে গুলি করে নামানো সম্ভব নয়, দরকার কোনটা সত্যিকারের হুমকি তা শনাক্ত করতে পারা, বলেছেন এই নিরাপত্তা বিশ্লেষক।
“আকাশে একটি বস্তু দেখার পরপরই প্রতিবার এফ-২২ বিমান ওড়ানোর লক্ষ্য বা সামর্থ্য কোনোটাই নেই আমাদের। সে কারণে আমাদের মনোযোগ ঠিক করতে হবে।
“বলতে হবে, কীভাবে আমরা সত্যিকারের হুমকি শনাক্ত করতে পারবো?,” বলেছেন তিনি।
এই ধরনের অজ্ঞাত বস্তু জাতীয় নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি নয় বলেও তিনি মনে করেন।
“এগুলো জটিল কিছু নয়। দুর্বল প্রযুক্তির জিনিস। তবে এটা আমাদের দুর্বলতা উন্মুক্ত করে দিচ্ছে। এ ধরনের আকাশ দিয়ে আসা হুমকি, ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের হুমকির ক্ষেত্রে দশকের পর দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্রের মহাদেশীয় প্রতিরক্ষাকে অবজ্ঞা করা হয়েছে,” বলেন সানের।
যুক্তরাষ্ট্র এতদিন উত্তর মেরুর দিক থেকে আসা কিছুর জন্য প্রস্তুত হয়ে ছিল, কিন্তু আলাস্কার দক্ষিণ দিক থেকেও যে কিছু আসতে পারে, সেই ব্যাপারে তারা প্রস্তুত ছিল না।
যুক্তরাষ্ট্রের বেশিরভাগ রাডারই ১৯৮০-র দশকের হওয়ায় এগুলো খুব বেশি উড়ন্ত বস্তুর ওপর নজর রাখতেও পারে না; যে কারণে নতুন ফিল্টারিং প্রয়োজন হয়ে পড়েছে, এবং এ খাতে জো বাইডেন প্রশাসন নজরও দিয়েছে, বলেছেন সানের।
দরকার ধৈর্য
এই বস্তুগুলো আদতে কী, তা বুঝে উঠার জন্য কিছুটা সময় প্রয়োজন বলে মনে করেন এফবিআইয়ের সাবেক উপপরিচালক অ্যান্ড্রু ম্যাককেব।
“কিছু কিছু এমন জায়গায় পড়ছে যেখান থেকে তা উদ্ধার করা মুশকিল। এরপর এসব জিনিস ভার্জিনিয়ার কোয়ান্টিকোতে এফবিআইর ল্যাবরেটরিতে নিয়ে যেতে হবে। তারপর কখনো আন্তর্জাতিক অংশীদারদের থেকে, কখনো যুক্তরাষ্ট্রের কাজ করা গবেষকদের জড়ো করে এই সরঞ্জামগুলো কীভাবে কাজ করে, তা বের করতে হবে।
“সবকিছুর জন্যই সময় দরকার। আমরা যে বস্তুগুলো কী, সেগুলো কী কী করতে সক্ষম তা বের করতে পারবো, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এটা তাড়াতাড়ি হবে না,” বলেছেন তিনি।
আপাতত ‘গুলিতেই’ সমাধান
কথিত চীনা নজরদারি বেলুন নিয়ে কী করা হবে, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে বাইডেন প্রশাসনের দেরি নিয়ে তুমুল সমালোচনা হলেও এখন যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে যে কোনো অজ্ঞাত উড়ন্ত বস্তুকে গুলি করে নামানোর পক্ষে ডেমোক্র্যাট-রিপাবলিকান উভয় পক্ষেরই তুমুল সমর্থন দেখা যাচ্ছে।
“উড়ে বেড়ানোর সুযোগ দেওয়ার চাইতে আমি সেগুলোর উদ্দেশ্যে ট্রিগার চেপে দিতে বেশি পছন্দ করবো। যার মাধ্যমে আমরা আসলে দেখাতে চাই, যা নীতি নিয়ে আলোচনার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো- আমরা যে আমাদের আকাশসীমা সুরক্ষিত রাখবো, এর মাধ্যমে তার ঘোষণা দেওয়া। এরপর আমাদের দরকার এই খাতে বিনিয়োগ করা।
“এই অজ্ঞাত বস্তু কিছু সমস্যা আর বিচ্যুতিকে হাজির করেছে। এইসব বিচ্যুতি যত দ্রুত সম্ভব পূরণ করা দরকার, কেননা হুমকি যে আছে তা এখন মেনে নিতে হবে আমাদের,” বলেছেন মার্কিন হাউস ইন্টিলিজেন্স কমিটির চেয়ারম্যান মাইক টার্নার।