কেবল ইসরায়েলের ওপর পাল্টা আঘাত নয়, তাদের সমর্থক যেকোনো দেশের স্বার্থকেই নিশানা করার হুঁশিয়ারি দিয়েছে তেহরান।
Published : 03 Oct 2024, 04:42 PM
আবারও মধ্যপ্রাচ্যকে সম্ভাব্য এক ব্যাপক ও ধ্বংসাত্মক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে এনে দাঁড় করিয়েছে নেতৃত্বস্থানীয় দুই আঞ্চলিক শক্তি ইরান ও ইসরায়েল, যারা গত ৪৫ বছরের বেশির ভাগ সময় ধরের একে অপরের মুখোমুখি হয়ে আছে।
বর্তমান পরিস্থিতি পুরো অঞ্চলটির জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক মুহূর্তগুলোর একটি হিসেবে হাজির হয়েছে।
পাহলভি রাজবংশের শাহকে ১৯৭৯ সালে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করার পর ইরান ইসলামি প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়। দেশটি দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েল রাষ্ট্রকে ‘ইহুদিবাদী শাসনব্যবস্থা' বলে আখ্যা দিয়ে ধ্বংস করার অঙ্গীকার জানিয়ে আসছে।
ইসরায়েলের অভিযোগ, ইরানের বিপ্লবী রক্ষী বাহিনী (আইআরজিসি) তাদের মিত্র ও ছায়া বাহিনীগুলোর মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে সহিংসতা ছড়াচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি সুন্নি প্রধান আরব দেশও ইসরায়েলের মতো মনোভাব পোষণ করে।
ইসরায়েল বলছে, মঙ্গলবার রাতে ইরান যে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে তার প্রতিশোধ নেবে তারা।
বিবিসি লিখেছে, ইরানের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর মধ্যে কয়েকটি ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেদ করে বিমানঘাঁটিসহ কয়েকটি জায়গায় আঘাত হেনেছে।
ইরান জানিয়েছে, বৈরুতে হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরাল্লাহ এবং তেহরানে হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়াকে হত্যার জবাবে ইসরায়েলে এ হামলা চালিয়েছে তারা।
কিন্তু এরপর কী হবে?
১৮০টিরও বেশি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে হামলা চালানোর ঘটনায় ইরানকে শাস্তি দিতে ইসরায়েল ও তার ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্র উভয়েই অঙ্গীকার করেছে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু প্রতিশ্রুতি জানিয়ে বলেছেন, “ইরানকে চরম মূল্য দিতে হবে।”
ইরান চলতি বছরের এপ্রিলেওইসরায়েলে ব্যাপক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালিয়েছিল। তখন প্রায় একই ধরনের পরিস্থিতিতে মিত্ররা ইসরায়েলের প্রতি সংযমের আহ্বান জানিয়েছিল, কিন্তু এবার তারা নীরব।
এ পরিস্থিতিতে ইসরায়েল লেবাননে, গাজায়, ইয়েমেনে ও সিরিয়ায় থাকা তাদের সব শত্রুদের বিরুদ্ধে একযোগে লড়ার বিষয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েছে। নেতানিয়াহু সরকার অবস্থান থেকে সরবে বলে মনে হচ্ছে না।
ইসরায়েলি পরিকল্পনাকারীরা সম্ভবত ইরানে হামলা চালানো হবে কি না বা কখন আঘাত হানা হবে, এসব নিয়ে এখন আর বিতর্ক করছেন না, বরং কতোটা কঠোর আঘাত হানা হবে তা নিয়ে হিসাব কষছেন।
মার্কিন উপগ্রহ গোয়েন্দা ব্যবস্থা এবং ইরানে থাকা ইসরায়েলি গুপ্তচর সংস্থা মোসাদের এজেন্টদের সহায়তায় বিস্তৃত লক্ষ্যবস্তু থেকে নিশানা ঠিক করার সুযোগ রয়েছে ইসরায়েল প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) । তাদের সামনে ইরানের যেসব লক্ষ্যস্থলে হামলা চালানোর সুযোগ আছে, সেসবকে মোটাদাগে তিন ভাগ করা যেতে পারে:
গতানুগতিক সামরিক হামলা: প্রাথমিকভাবে সেই সব ঘাঁটিকে অবশ্যই নিশানা করা হবে, যেখান থেকে ইরান ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছিল। তার মানে সেই তালিকায় থাকবে- লঞ্চ প্যাড, কমান্ড-অ্যান্ড-কন্ট্রোল সেন্টার, রিফুয়েলিং ট্যাংক ও স্টোরেজ বাঙ্কার। আরও কঠোর আঘাতের পরিকল্পনা করা হলে আইআরজিসি'র ঘাঁটি, বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও বিভিন্ন ক্ষেপণাস্ত্র ব্যাটারিতে আঘাত হানতে পারে। এমনকি ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির সঙ্গে সংযুক্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের হত্যার চেষ্টাও হতে পারে।
অর্থনৈতিক: এর মধ্যে ইরানের সবচেয়ে অরক্ষিত রাষ্ট্রীয় সম্পদ যেমন পেট্রোকেমিক্যাল প্ল্যান্ট ও বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং সম্ভবত সমুদ্রবন্দরকে নিশানা করা হতে পারে। তবে এ ধরনের পদক্ষেপ খুবই অজনপ্রিয় হতে পারে, কারণ তাতে সামরিক বাহিনীর চাইতে সাধারণ মানুষ অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
পরমাণু শক্তি: ইসরায়েলের জন্য এটি একটি বড় লক্ষ্যস্থল। জাতিসংঘের পরমাণু পর্যবেক্ষণ সংস্থা আইএইএ-র মাধ্যমে এটি প্রতিষ্ঠিত সত্য যে ইরান বেসামরিক পারমাণবিক বিদ্যুৎ শক্তির জন্য প্রয়োজনীয় ২০ শতাংশেরও বেশি ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে। ইসরায়েল ও অন্যদের সন্দেহ, ইরান ‘ব্রেকআউট পয়েন্টে’ পৌঁছানোর চেষ্টা করছে, যেখান থেকে দেশটি খুব অল্প সময়ের মধ্যে পারমাণবিক বোমা তৈরিতে সক্ষম হবে। ইসরায়েলের সম্ভাব্য নিশানার তালিকায় আছে, ইরানের সামরিক পরমাণু কর্মসূচির কেন্দ্রস্থল পারচিন; তেহরান, বোনাব ও রামসারের গবেষণা চুল্লিগুলো এবং বুশেহর, নাতাঞ্জ, ইসফাহান ও ফেরদোর প্রধান স্থাপনাগুলো।
বিবিসি লিখেছে, ইসরায়েল অনুমান করার চেষ্টা করছে, তাদের হামলার জবাবে ইরান কী ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে এবং তা কীভাবে প্রশমিত করা যায়। ইরানের অবস্থান হলো, মঙ্গলবার ইসরায়েলি সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের পর আক্রমণ শেষ হয়েছে। তবে তারা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছে, ইসরায়েল পাল্টা হামলা চালালে ইরানও পাল্টা কঠিন আঘাত হানবে।
ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান বলেছেন, “এটি আমাদের সক্ষমতার আভাস মাত্র।”
এই হুঁশিয়ারিকে আরও জোরদার করে আইআরজিসি বলেছে, “ইহুদিবাদী রাষ্ট্রটি যদি ইরানের অভিযানের প্রতিক্রিয়া জানায়, তবে তারা বিধ্বংসী হামলার মুখোমুখি হবে।”
সামরিকভাবে ইসরায়েলকে পরাস্ত করার সক্ষমতা ইরানের নেই। ইসলামি প্রজাতন্ত্রটির বিমান বাহিনী সেকেলে ও দুর্বল, তাদের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও নিশ্ছিদ্র নয়। দেশটির বিমান বাহিনীকে বছরের পর বছর ধরে চলা পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার সঙ্গে লড়াই করতে হচ্ছে।
কিন্তু এই মুহূর্তে তাদের কাছে বিপুল পরিমাণ ব্যালিস্টিক ও অন্যান্য ক্ষেপণাস্ত্র যেমন আছে, তেমনই আছে বিস্ফোরকবাহী আত্মঘাতী ড্রোন। এর পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ইরানের অসংখ্য মিত্র মিলিশিয়া বাহিনী আছে।
ইরান এরপর ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়লে তা ইসরায়েলের সামরিক ঘাঁটির বদলে আবাসিক এলাকাগুলোকে নিশানা করতে পারে। ২০১৯ সালে সৌদি আরবের তেল স্থাপনায় ইরান সমর্থিত মিলিশিয়াদের হামলা দেখিয়ে দিয়েছে তাদের প্রতিবেশীরা এ ধরনের হামলার ক্ষেত্রে কতটা অরক্ষিত।
পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে আইআরজিসির নৌবাহিনীর ছোট ছোট জলযানের দল আছে, যা দ্রুতগতিতে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়তে পারে। ওই জলযানের দল মার্কিন নৌবাহিনীর পঞ্চম নৌবহরের যুদ্ধজাহাজ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় ব্যাপক আঘাত হানার সক্ষমতা রাখে। আর হরমুজ প্রণালীতে হামলা হলে বিশ্বজুড়ে দৈনিক তেল রপ্তানির ২০ শতাংশ পর্যন্ত প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হতে পারে, তাতে বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
তাছাড়া কুয়েত থেকে ওমান পর্যন্ত উপসাগরীয় আরব অংশে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি আছে। ইরান হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছে, হামলা হলে তারা শুধু ইসরায়েলের ওপরই পাল্টা আঘাত হানবে না, ওই হামলার সমর্থক যেকোনো দেশের স্বার্থকেই নিশানা করবে।
তেল আবিব ও ওয়াশিংটনের প্রতিরক্ষা পরিকল্পনাকারীরা এখন এসব বিষয়গুলো বিবেচনা করে দেখছেন।