মায়ের হাতে মার খেয়ে বাড়ি ছাড়া, ১৩ বছর পর ফিরল ভাই-বোন

সন্তানদের খুঁজে পেতে পথে পথে ঘুরেছেন নীতু কুমারী; মসজিদ, মন্দির, গুরুদুয়ারা ও চার্চে গিয়েও প্রার্থনা করেছেন। তার সেই অপেক্ষার পর অবসান হয়েছে ১৩ বছর পর।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 March 2024, 02:46 AM
Updated : 1 March 2024, 02:46 AM

অভাব-অনটনে সাংসারিক কলহে শিশু মেয়েকে খুন্তি দিয়ে মেরেছিলেন দিনমজুর মা নীতু কুমারী; সেই অভিমানে কাউকে কিছু না বলে ছোট ভাইকে নিয়ে বাড়ি ছেড়েছিল মেয়েটি, তারা ফিরে এসেছে ১৩ বছর পর।

মা-বাবার ওপর অভিমান করে ২০১০ সালের জুনে বাড়ি ছেড়েছিল তারা। রাখীর বয়স ছিল তখন ১১, আর ছোট ভাই বাবলুর ৭।

এক কিলোমিটার দূরে নানির বাড়ি যাওয়ার পরিকল্পনা করলেও পথ হারিয়ে নানা অঘটনে তাদের বাড়ি ফিরতে লেগে গেছে ১৩টি বছর।

এক শিশু অধিকারকর্মীর সহায়তায় গত ডিসেম্বরে রাখি ও বাবলু ফেরে তার মা-বাবার কাছে। ছোট বয়সে বাড়ি ছেড়ে আশ্রমে বেড়ে ওঠা দুই ভাই-বোন মাকে পেয়েই জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে। আর সন্তানরা ফিরে আসবেন- এমন আশায় বেঁচে থাকা মা নীতু কুমারীও সন্তানদের বুকে জড়িয়ে নেন। যে মারধরের কারণে ছেলে-মেয়েরা বাড়ি ছেড়েছিল, তার জন্য দুঃখও প্রকাশ করেন।

বাড়ি ছাড়ার কাহিনী

বাবলু ও রাখীদের বাড়ি উত্তর ভারতের শহর আগ্রায়। মা নীতু কুমারী ও বাবা সন্তোষ দিনমজুর।

বিবিসি লিখেছে, অভাবের সংসারে ২০১০ সালের ১৬ জুন কাজ না পেয়ে হতাশা থেকে রাখিকে খুন্তি দিয়ে আঘাত করেন। ওই ঘটনায় অভিমান করে বাবলুকে নানি বাড়ি যাওয়ার প্রস্তাব দেয় রাখী। এদিকে বিভিন্ন সময় বাবার হাতে মার খাওয়া বাবলু তার বোনের কথায় রাজি হয়ে যায়। এরপর এক সুযোগে দুই ভাইবোন বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়।

বাবলু বিবিসিকে বলে, “ঠিকমত পড়াশুনা না করলে বাবা আমাকে মাঝে মধ্যে মারত। তাই রাখী যখন আমার কাছে এসে বলল, চল নানির সঙ্গে আমরা থাকি, তখন রাজি হয়ে যাই।”

কিন্তু তারা পথ হারালে এক রিকশাচালক তাদের রেল স্টেশনে নিয়ে যান। তারা দুজনেই উঠে পড়ে একটি ট্রেনে। আর শিশুদের নিয়ে কাজ করা একটি দাতব্য সংস্থায় যুক্ত এক নারী ট্রেনের ভেতরে রাখী ও বাবলুকে পান।

ট্রেনটি আগ্রা থেকে আড়াইশ কিলোমিটার দূরে মিরুতে পৌঁছালে ওই নারী তাদের পুলিশের হাতে তুলে দেন। এরপর তাদের পাঠানো হয় সরকারি অনাথ আশ্রমে।

বাবলু বলেন, “আমরা তাদের বলেছিলাম বাড়ি যাব। আমাদের মা-বাবা সম্পর্কে তাদের সবকিছু বলার চেষ্টা করেছি। কিন্তু পুলিশ ও আশ্রম কর্তৃপক্ষ আমাদের পরিবারের কাউকে খোঁজেনি।”

বছর খানেক বাবলু ও রাখী একসঙ্গে থাকলেও পরে তাদের আলাদা করে ফেলা হয়। রাখীকে দিল্লিতে একটি এনজিও পরিচালিত মেয়েদের অনাথ আশ্রমে পাঠানো হয়। আর বাবলুকে পাঠানো উত্তর প্রদেশের রাজধানীর লখনৌ এর একটি সরকারি আশ্রমে।

ভাই-বোনের সম্মিলন

গুরুত্বপূর্ণ কোনো কর্মকর্তা, দাতব্য সংস্থার কেউ কিংবা কোনো সাংবাদিক এলেই বাবলু তার বোনের কথা বলত। কিন্তু পাঁচ বছর কেটে গেলেও বোনের দেখা পায়নি সে।

অবশেষে ২০১৭ সালে নতুন তত্ত্বাবধায়ক আসে বাবলুর আশ্রমে। রাখী বড় মেয়েদের কোনো আশ্রমে আছে- বাবলু ওই কর্মকর্তাকে সেটি জানালে তিনি সাহায্য করার আশ্বাস দেন।

বাবলু বলে, “ওই নারী তত্ত্বাবধায়ক নয়ডা ও দিল্লির প্রত্যেক অনাথ আশ্রমে ফোন করেন। অনেক চেষ্টার পর বোনকে খুঁজে পাই।

“সরকারকে বলতে চাই, ভাই-বোনকে এভাবে আলাদা করা নিষ্ঠুর কাজ। ভাই ও বোনকে কাছাকাছি কোনো আশ্রমে রাখা উচিত। তাদের আলাদা করা ঠিক না।”

দুই ভাই-বোন ফের এক হওয়ার পর তারা নিজেদের মা-বাবার সন্ধান পাওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু এ ব্যাপারে রাখী ছিল সন্দিহান।

তার ভাষ্য, “১৩ বছর কোনো ছোটখাটো সময় নয়। মাকে খুঁজে পাব- এমন আশা খুব কমই ছিল।”

তবে বাবলু এ ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী ছিল। বিবিসিকে বাবলু বলে, “রাখীকে পেয়ে আমি খুব খুশি হই। আর আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠি যে, আমাদের মাকেও আমি খুঁজে বের করব।”

আশ্রমে থাকার সময় বাবলু তত্ত্বাবধায়ক এবং আশ্রমের বড়দের হাতে মারও খেয়েছে। দুইবার পালানোর চেষ্টা করে সে। কিন্তু ভয়ে আবার ফিরে আসে।

অন্যদিকে দিল্লিতে এনজিও’র অধীনে আশ্রমে ভালো সময় কাটছিল জানিয়ে রাখী বলে, “আমি বিশ্বাস করি, যা কিছু ঘটে তা ভালোর জন্যই। বাড়ির চেয়ে আমার খুব ভালো জীবন ছিল সেখানে। আমি তাদের কেউ না, কিন্তু তারা আমার ভালো দেখাশোনা করেছে।

“কেউ আমাকে মারধর করেনি। আমাকে যত্ন-আত্তি করা হত। স্কুলে যেতাম, ভালো চিকিৎসা ও অন্য সব সুযোগ ছিল।”

ঘরে ফেরা

মা-বাবার সন্ধানের এক পর্যায়ে বাবলু গত বছরের ২০ ডিসেম্বর আগ্রাভিত্তিক শিশু অধিকারকর্মী নরেশ পরশকে ফোন করে সাহায্য চান। ২০০৭ সাল থেকে নরেশ শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করছেন।

বিবিসিকে নরেশ বলেন, “তাদের মা-বাবাকে খুঁজে বের করা কোনো সহজ কাজ ছিল না।”

রাখী ও বাবলু তাদের বাবার নাম ও জেলা বা ঠিকানা বলতে পারছিল না। তাদের কোনো ধারণাই ছিল না।

তবে সেই চেষ্টায় আলো মেলে যখন বাবলুর একটি ডামি রেল ইঞ্জিনের কথা মনে পড়ে। নরেশ বলেন, “আমি জানতাম সেটি তখনকার আগ্রা ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনের হবে।”

পরে তিনি জগদীশপুরা থানায় যান। ওই থানাতেই রাখি ও বাবলুর হারিয়ে যাওয়ার ঘটনায় ২০১০ সালে সাধারণ ডায়েরি করেছিলেন তাদের বাবা। কিন্তু পুলিশ নথিপত্রের মাধ্যমে খোঁজ করতে গিয়ে দেখেন তাদের মা-বাবা সেখানে আর থাকেন না।

এরপর রাখীর মনে পড়ে, তার মায়ের নাম নীতু এবং গলায় পোড়া দাগ ছিল। এরপর নরেশ শ্রমিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে শুরু করেন। ভারতের দিনমজুর শ্রমিকরা হাটে জড়ো হন দিনমজুর হিসেবে কাজ পাওয়ার জন্য। নরেশ সেসব জায়গাগুলোতেই খোঁজ করছিলেন।

আগ্রায় দীর্ঘদিন এমন খোঁজাখুঁজির পর কিছু শ্রমিক বলছিলেন, তারা নীতুকে চেনেন। আর তার সঙ্গে দেখা হলে তারা খবর দেবেন।

আর সন্তানদের খুঁজে পাওয়ার খবর শোনার সঙ্গে সঙ্গে নীতু কুমারী পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এরপর নরেশের সঙ্গে তার কথা হয়।

সন্তানদের খুঁজে পেতে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছেন নীতু কুমারী। মসজিদ, মন্দির, গুরুদুয়ারা আর চার্চে প্রার্থনাও করেছেন যেন তারা ফিরে আসে। সেই অপেক্ষার অবসান হয়েছে ১৩ বছর পর।