ভোপালের শেষ নবাবের মেয়ে আবিদা সুলতান ছিলেন এক বিদ্রোহী মুসলিম রাজকন্যা। মাত্র ১৫ বছর বয়সে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন তিনি।
Published : 24 Nov 2024, 10:00 PM
ভারতে ভোপালের শেষ নবাব হামিদুল্লাহ খানের বড় মেয়ে আবিদা সুলতান। আর দশটা সাধারণ রাজকন্যার মতো তিনি মোটেই ছিলেন না। শৈশব থেকেই সমাজের প্রচলিত ধ্যান-ধারণা আর রীতিনীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছিলেন আবিদা।
তিনি ছোট করে চুল ছাঁটতেন, বাঘ শিকার করতেন, পোলো খেলতেন, উড়োজাহাজ চালিয়েছেন এমনকি মাত্র ৯ বছর বয়সেই চালান রোলস-রয়েস। বিবিসি এক প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে ১৯ শতকের এই মুসলিম রাজকন্যার জীবনধারা:
সেই সময়কার ভোপাল রাজ্যের এই সাহসী মুসলিম রাজকন্যার জন্ম ১৯১৩ সালের ২৮ অগাস্ট। আর মৃত্যু ১১ মে ২০০২ সালে। বিদ্রোহী রাজকন্যা আবিদা মুসলিম নারীদের জন্য প্রচলিত পর্দা প্রথা মানেননি।
মাত্র ১৫ বছর বয়সে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন তিনি। তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতে ভোপাল পরিচিতি পেয়েছিল বেগমদের নগর হিসেবে। ব্রিটিশ শাসকদের অনুগত ‘প্রিন্সলি স্টেট’ ভোপালের রাজগদি দখলে রেখেছিলেন এই বেগমরা। বলা হয়, বাঘিনীর মতো রাজ্য শাসন করতেন তারা।
সেই সাহসী বেগমদের ঐতিহ্য আবিদা বজায় রেখেছিলেন। ভোপালের রাজনীতিতে তিনি ছিলেন প্রভাবশালী। যতদিন ভোপাল রাজ্য আবিদার বাবার তত্ত্বাবধানে ছিল ততদিন তিনি মুসলিম রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেননি। তবে বাবার মন্ত্রিসভার চেয়ারপারসন এবং মুখ্য সচিবের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন।
আবিদা সুলতানের শৈশব কাটে ভোপালের শাসক বেগম দাদি সুলতান জাহানের তত্ত্বাবধান ও কঠোর অনুশাসনে। কোরআন পাঠ থেকে শুরু করে ঘোড়ায় চড়া, সংগীত শেখা, এমনকি ঘর ঝাড় দেওয়া থেকে শুরু করে বাথরুম পরিস্কার করার মতো বাড়ির কাজ পর্যন্ত তিনি শিখেছিলেন।
আবিদা সুলতান তার আত্মজীবনীতেই সেকথা লিখেছেন। তিনি আরও লেখেন, "আমাদের কোনও লিঙ্গগত পার্থক্য শেখানো হয়নি। আমরা ছেলেদের মতোই স্বাধীন ছিলাম।" তবে ১৩ বছর বয়সে দাদি আবিদাকে পর্দা করার জন্য জোরাজুরি করলে তিনি এর ঘোর বিরোধিতা করেন। পরে বাবার মুক্তমনা দৃষ্টিভঙ্গির কারণে আবিদাকে আর পর্দা করতে হয়নি।
মাত্র ১২ বছর বয়সে আবিদার বিয়ে হয়েছিল পাশের কুরওয়াই রাজ্যের শাসক সারওয়ার আলি খানের সঙ্গে, যিনি ছিলেন আবিদার শৈশবের বন্ধু। তবে সে বিয়ে দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। এক দশকেরও কম সময় টিকে ছিল এই বিয়ে।
বিবাহিত জীবনের অভিজ্ঞতা আত্মজীবনীতে তুলে ধরেছেন আবিদা। বিয়ের পর যৌনতায় অস্বস্তি এবং জ্ঞানের অভাব কিভাবে আবিদার কাছে তার বিবাহিত জীবনকে বিষিয়ে তুলেছিল সেকথা বর্ণনা করেছেন তিনি।
স্বামী-স্ত্রীর বিবাহিত সম্পর্কের বিষয়টি খোলাসা করে তুলে ধরে আবিদা সমাজের এই প্রচালিত ধারণা ভেঙেছিলেন যে, মুসলিম নারীরা যৌনতা নিয়ে লিখতে পারে না।
বিয়ে বিচ্ছেদের পর আবিদা একমাত্র ছেলেকে নিয়ে ভোপালে ফিরে যান। কিন্তু ছেলের কাস্টডি নিয়ে দু’জনের মধ্যে শুরু হয় কদর্য লড়াই। দীর্ঘদিনের এ লড়াইয়ে হতাশ হয়ে শেষ পর্যন্ত আরেক সাহসী পদক্ষেপ নেন আবিদা।
তিনি গাড়ি চালিয়ে সোজা আবার ফিরে যান তার স্বামীর কাছে। ঘরে ঢুকে রিভলবার বের করে তা স্বামীর কোলে ছুড়ে দিয়ে বলেন, “আমাকে গুলি করো, নয়ত আমি তোমাকে গুলি করব।”
এরপর দুইজনের মধ্যে ধস্তাধস্তি শুরু হলে আবিদা জয়ী হন। শেষ হয় ছেলের কাস্টডি নিয়ে বিরোধ। পরে একক মা হিসাবে ছেলেকে বড় করেন আবিদা, একইসঙ্গে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হিসাবে তিনি পালন করেন তার দায়িত্বও।
১৯৩৫ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত আবিদা রাজ্যের মন্ত্রিসভা পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন। ওই সময়ে ভোপাল মধ্যপ্রদেশের সঙ্গে একীভূত হয় এবং রাজ্যের রাজধানী শহর হিসাবে নাগপুরের স্থলাভিষিক্ত হয়।
ভারতের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনার জন্য ব্রিটিশ সরকারের ডাকা গোল টেবিল বৈঠকেও অংশ নিতেন আবিদা। সে সময় তিনি সাক্ষাৎ করতেন মহাত্মা গান্ধী, মতিলাল নেহেরু, জওহরলাল নেহেরুর মতো প্রভাশালী নেতাদের সঙ্গে।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের চরম অবনতির সচক্ষে দেখেছিলেন আবিদা সুলতান। দেশভাগের পর বাড়তে থাকা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার জেরে ১৯৫০ সালে একমাত্র ছেলের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তিনি পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন। তখন আবিদার বোন ভোপালের দায়িত্ব নেন।
পাকিস্তানে আবিদা তার রাজনৈতিক জীবনে গণতন্ত্র ও নারীর অধিকারের জন্য কাজ করেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি পাকিস্তানেই ছিলেন। ২০০২ সালে করাচিতে তার মৃত্যু হয়।
আবিদা সুলতান ভারতে না থাকলেও ভোপালের মানুষ তাকে মনে রেখেছে। ভোপালের নারী শসকদের নিয়ে গবেষণা করা সাংবাদিক শামসু উর রেহমান আলভি মনে করেন, “আবিদা সুলতানের নাম খুব তাড়াতাড়ি বিস্মৃত হওয়ার সম্ভাবনা নেই।”