বিশ্বমঞ্চে বড় খেলোয়াড় হিসেবে রাশিয়ার প্রত্যাবর্তন এবং ইউরোপ আর যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ফাটল ধরানোর পথে রুশ প্রেসিডেন্ট অনেকটাই অগ্রসর হতে পেরেছেন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
Published : 20 Mar 2025, 01:56 PM
যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার দুই প্রেসিডেন্টের মধ্যে সর্বশেষ যে ফোনালাপ হয়েছে তাতে ভ্লাদিমির পুতিন সামান্য ছাড় দেওয়ার বিনিময়ে কৌশলগত বড় জয় অর্জনের পথ পরিষ্কার করলেন বলেই বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
তাদের ভাষ্য, এই ফোনালাপের মাধ্যমে পুতিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক জোড়া লাগাতে এবং বড় খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বমঞ্চে রাশিয়ার প্রত্যাবর্তনের পথ যেমন খুলেছেন, তেমনি ইউরোপ ও ওয়াশিংটনের মধ্যে গজাল চালিয়ে দেওয়ার পথেও অনেকটাই অগ্রসর হতে পেরেছেন। এসবের বদলে ইউক্রেইনে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ডনাল্ড ট্রাম্পের উদ্যোগ যেন ব্যর্থ বলে প্রতিভাত না হয়, সেজন্য তাকেও সামান্য কিছু নগদ দিয়েছেন।
মঙ্গলবার দুই প্রেসিডেন্টের মধ্যে ওই দীর্ঘ ফোনালাপের আগে যুক্তরাষ্ট্র বলেছিল, তারা রাশিয়াকে ৩০ দিনের যুদ্ধবিরতিতে রাজি করাতে চায়, যে প্রস্তাবে আগেই ইউক্রেইন সম্মত হয়েছিল এবং যাকে পূর্ণাঙ্গ শান্তি চুক্তির দিকে প্রথম পদক্ষেপ মনে করা হচ্ছিল।
অথচ শেষমেষ পুতিন যে বিরতিতে রাজি হলেন, তাকে আগের প্রস্তাবের ছিটেফোঁটা বলা যেতে পারে। দুই পক্ষ এক মাসের জন্য একে অপরের জ্বালানি স্থাপনায় হামলা করা থেকে বিরত থাকবে—মস্কোর ছাড় এটুকুই, বলছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
ট্রাম্প যে খালি হাতে ফিরছেন, এমনটা যেন ধরা না পড়ে তা নিশ্চিতে পুতিন সামান্য ছাড়ের এই সতর্ক চাল চেলেছেন বলে অনেকে মনে করছেন।
তবে তিন বছর ধরে চলা যুদ্ধের মধ্যে এবারই প্রথম মস্কো-কিইভ দুই পক্ষ তাদের বৈরিতা অন্তত স্বল্প সময়ের জন্য হলেও কিছুটা কমাতে রাজি হয়েছে, এটাকে স্বস্তিদায়ক মানছেন সবাই।
হোয়াইট হাউজ বলছে, কেবল জ্বালানি অবকাঠামোই নয়, দুই দেশের মধ্যে কৃষ্ণসাগরে যুদ্ধবিরতির পাশাপাশি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধবিরতির আলোচনাও শিগগিরই শুরু হচ্ছে।
ওয়াশিংটন এগুলোকে অর্জন হিসেবে দেখাতে চাইলেও ইউরোপের অনেক বিশ্লেষক তা মনে করছেন না।
তারা বলছেন, জ্বালানি অবকাঠামো ও সমুদ্রপথে হামলা বন্ধ হলে তা ইউক্রেইনের জন্য ভালো হবে না, কেননা যুদ্ধ শুরুর পর এখন পর্যন্ত তারা রাশিয়ার যুদ্ধ অর্থনীতির অন্যতম প্রাণকেন্দ্র তেল স্থাপনাগুলোতে এবং তুলনায় অনেক বড় রুশ নৌবাহিনীর ওপর যেসব হামলা চালিয়েছে তা মস্কোর অগ্রগতিতে ভালোই বাধ সেধেছে।
কিন্তু এখন জ্বালানি অবকাঠামো আর সমুদ্রপথে হামলায় বিরতি এলে রাশিয়া তার পুরো মনোযোগ স্থল অভিযানে দিতে পারবে। বিশেষ করে তাদের পশ্চিমাঞ্চলীয় কুর্স্কে।
গত অগাস্টে আচমকা এক আক্রমণে ওই এলাকার কিছু অংশ কিইভবাহিনী তাদের নিয়ন্ত্রণে নিতে পেরেছিল। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে রুশ সেনারা ওই এলাকার সিংহভাগই দখলমুক্ত করে ফেলেছে, বাকি যেটুকু আছে সেটুকুও যে কোনো সময় ইউক্রেইনের হাতছাড়া হয়ে যাবে বলেই মনে হচ্ছে।
এদিকে পুতিন পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধবিরতির ক্ষেত্রে রাশিয়ার শর্ত পুনর্ব্যক্ত করেছেন। বলেছেন, বিরতির সুযোগ নিয়ে কিইভ অস্ত্রশস্ত্র মজুদ বা নতুন করে আরও সৈন্য সমাবেশ ঘটাতে পারবে না। ইউক্রেইন এসব শর্ত প্রত্যাখ্যান করেছে।
লন্ডনের ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের রাশিয়া বিশেষজ্ঞ নাইজেল গুল্ড-ডেভিস বলেছেন, পুতিন বৃহত্তর যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব কার্যত প্রত্যাখ্যান করেছেন। ট্রাম্প যদি আরও নিষেধাজ্ঞাসহ রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক চাপ জোরদার না করেন, রুশ প্রেসিডেন্ট হয়তো যুদ্ধবিরতির বিষয়টিকে খুব একটা আমলেই নেবেন না।
“তিনি বলেছেন, তিনি (যুদ্ধবিরতিতে) আগ্রহী, এর সঙ্গে ‘স্পষ্টতই অগ্রহণযোগ্য’ কিছু শর্তও জুড়ে দিয়েছেন। এটা এক প্রকারের ‘না’,” রয়টার্সকে ফোনে এমনটাই বলেন গুল্ড-ডেভিস।
ট্রাম্পের সহযোগীরা উল্টো মঙ্গলবারের ফোনালাপকে ‘সফলতা’ এবং যুদ্ধবিরতির লক্ষ্য অর্জনের পথে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবেই দেখছেন।
“কিছুকাল আগ পর্যন্তও আমরা জ্বালানি ও অবকাঠামোতে যুদ্ধবিরতি এবং কৃষ্ণসাগরে গোলাগুলিতে স্থগিতাদেশ- এ দুটো বিষয় নিয়েও একমত হতে পারিনি। আজ আমরা এখানে এসে পৌঁছাতে পেরেছি, আমার মনে হয় এখান থেকে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধবিরতির দূরত্ব তুলনামূলক অনেক কম,” ফক্স নিউজের ‘হেনিটি’ অনুষ্ঠানে এমনটাই বলেছেন ট্রাম্পের দূত স্টিভ উইটকফ।
পশ্চিমাপন্থি রুশ রাজনীতিক আন্দ্রেই কোজিরেভ অবশ্য মনে করছেন, ফোনালাপ থেকে ট্রাম্পের অর্জন আদতে একেবারেই শূন্য।
“যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া এবং আমেরিকাকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরানো, সবই হচ্ছে পুতিনের স্বার্থে,” সংবাদ মাধ্যম দোজদ-কে বলেছেন ১৯৯০ এর দশকে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা, এখন প্রবাসজীবন কাটানো কোজিরেভ।
ক্রেমলিনঘনিষ্ঠ এক রুশ সূত্র রয়টার্সকে বলেছেন, “পুতিন ট্রাম্পের ওপর চাপ সৃষ্টি করে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চাইছেন। তাতে ইউক্রেইনীয়রা পিছু হটবে, ধীরে ধীরে তারা ভূখণ্ড এবং জনগণ সবই হারাবে।”
দুই প্রেসিডেন্টের ফোনালাপের পর ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, তিনি জ্বালানি স্থাপনায় হামলা বন্ধ রাখতে রাজি। অবশ্য এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মস্কো ও কিইভ একে অপরের বিরুদ্ধে শর্ত লঙ্ঘনের অভিযোগ এনেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যদি সীমিত আকারে কেবল জ্বালানি অবকাঠামোতে যুদ্ধবিরতি বজায় থাকে, তাহলে একে কোনোভাবেই পুতিনের দিক থেকে বড় ছাড় মনে করা যাবে না।
ইউক্রেইনের জ্বালানি গ্রিডে হামলা বন্ধের বিনিময়ে তিনিও রাশিয়ায় বড় বড় তেল স্থাপনাগুলোতে ইউক্রেইনের ড্রোন হামলা থেকে মুক্তি পেতে যাচ্ছেন। কিইভের এ ধরনের হামলা কেবল চলতি বছরই রাশিয়ার ৩৩ লাখ টন তেল, যা রাশিয়ার মোট পরিশোধন সক্ষমতার ৪ শতাংশের সমপরিমাণ, নষ্ট করে দিয়েছে বলে অনুমান রয়টার্সের।
কোজিরেভ বলছেন, জ্বালানি স্থাপনায় যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়ে পুতিন আদতে বিন্দুমাত্র ছাড়ও দেননি। যে কোনো বিচারে এটি ‘একেবারেই অর্থহীন’।
“দ্বিতীয়ত, ট্রাম্প এটার কথা বলেনওনি। তিনি যা চেয়েছিলেন, যাতে ইউক্রেইনও রাজি হয়েছিল, সেটি হচ্ছে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধবিরতি। এখন যেটা এলো সেটা হচ্ছে সুনির্দিষ্ট কিছু লক্ষ্যে হামলার ক্ষেত্রে বিরতি। এটা তো চাওয়া হয়নি,” বলেছেন তিনি।
ফোনালাপের পর ক্রেমলিন তার বার্তা জানিয়েছিল, যুদ্ধ বন্ধে উভয় প্রেসিডেন্ট ‘দ্বিপাক্ষিক কাঠামোর মধ্যে’ চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে সম্মত হয়েছেন।
এই ‘দ্বিপাক্ষিক কাঠামোর মধ্যে’ শব্দবন্ধ ইউক্রেইন ও তার ইউরোপীয় মিত্রদের শঙ্কা বাড়িয়ে দিয়েছে। তাদের ভয়, ট্রাম্প কিইভ ও ইউরোপকে বাইরে রেখেই পুতিনের সঙ্গে একটি চুক্তি করে ফেলতে পারেন, যা ভবিষ্যতের জন্য তাদেরকে আরও বড় ঝুঁকির দিকে ঠেলে দিতে পারে।
ক্রেমলিনের বার্তায় আরও বলা হয়েছিল, বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিতে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের যে ‘বিশেষ দায়িত্ব’ তার আলোকে মধ্যপ্রাচ্য, পারমাণবিক বিস্তার ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সম্ভাব্য সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলি নিয়েও দুই নেতা বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
বছরের পর বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমারা মস্কোকে বিচ্ছিন্ন করার, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিয়ে শাস্তি দেওয়ার চেষ্টা চালিয়েছে; এই পুরো চিত্র উল্টে পুতিন চাইছিলেন রাশিয়াকে বিশ্বমঞ্চে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে কথা বলার স্থানে ফিরিয়ে আনতে।
তিনি যে তার লক্ষ্য অর্জনের পথে অনেকটাই অগ্রসর হতে পেরেছেন, ক্রেমলিনের ভাষ্য তাই বোঝাচ্ছে।
“এটি অবশ্যই পুতিনের জন্য বিরাট সাফল্য, যিনি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে ইউক্রেন সংঘাতের ওপর নির্ভরশীলতা থেকে মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন,” বলেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক তাতিয়ানা স্তানোভায়া।
পুতিন যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোকে রাশিয়ায় ব্যবসার বিপুল সম্ভাবনার টোপও দিচ্ছেন।
“ওয়াশিংটনকে তার নেটো মিত্রদের থেকে আলাদা করার চেষ্টায় তিনি যুক্তরাষ্ট্র, কেবল যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেই চুক্তি করতে চাইছেন। এখন ইউরোপকে খুব দ্রুত নিজের প্রতিরক্ষার জন্য সম্পদ জোগাড় করতে হচ্ছে, চলমান এই বিচ্ছিন্নতাবোধ সীমিত পর্যায়ে থাকবে, এমন আশায় বুক বাঁধতে হচ্ছে,” বলেছেন গুল্ড-ডেভিস।