বেলা ফুরালো তবে সিলিকন ভ্যালির?

কোম্পানির ব্যবসার পরিধি আর আর্থিক মূল্যায়ন খুব দ্রুত বাড়ার সবগুলো ঘটনাও এখন আর প্রযুক্তি খাতে সাফল্যের গল্প বলছে না। বরং থেরানোস আর উইওয়ার্ক-এর মতো কোম্পানিগুলোর গল্প সতর্কবার্তা বহন করছে বিনিয়োগকারী ও সেবাগ্রাহক উভয়পক্ষের জন্যই।

আব্দুল্লাহ জায়েদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 Sept 2022, 09:00 AM
Updated : 18 Sept 2022, 09:00 AM

স্ন্যাপচ্যাটে কর্মী ছাটাই, শেয়ার বাজারে মেটা আর অ্যাপলের মতো কোম্পানির দরপতন, আর প্রথমসারির বিভিন্ন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানে নতুন কর্মী নিয়োগ থমকে যাওয়ায় সাম্প্রতিক দিনগুলোতে প্রযুক্তি শিল্পে একটি প্রশ্ন বারবার উঠে আসছে: সিলিকন ভ্যালির স্বর্ণযুগ কি তবে ফুরিয়ে গেল?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উত্তরটা বেশ জটিল। আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি শিল্পের প্রভাব-প্রতিপত্তি আর পরিধি ঊর্ধ্বমুখী গতি ধরে রেখেছে টানা কয়েক দশক ধরে। শাপে বর হয়েছে গত কয়েক বছরের মহামারী; বিশ্ব জনসংখ্যার একটা বড় অংশকে অনলাইনের দিকে ঠেলে দিয়েছে কোভিড, প্রযুক্তিকেন্দ্রীক সেবার বাজারও বেড়েছে ওই সময়ের মধ্যে।

সার্বিক প্রযুক্তি শিল্পের ‘বিস্ফোরণের’ সঙ্গে সঙ্গে লোভনীয় বেতন আর নানা বাড়তি সুবিধার যে চাকরির সুযোগ তৈরি হচ্ছিল, তার গতিও কমে আসছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

সিলিকন ভ্যালির দিন বদল প্রসঙ্গে ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াশিংটনের অধ্যাপক ও লেখক মার্গারেট ও’মারার মতে, “সুদিন তো আর চিরদিন থাকে না।”

“বিভিন্ন দিক থেকে ভাবলে, একটা দীর্ঘ সময় ধরে সবকিছুর আকার বাড়তে থাকার পর আমরা আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাচ্ছি।”

এক্ষেত্রে বিশ্ববাজারের নিম্নমুখী প্রবণতাও ভূমিকা রাখছে – প্রযুক্তি শিল্পও এ পরিবর্তনের প্রভাব এড়াতে পারছে না বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। কেবল ২০২২ সালেই তিনবার সুদের হার বাড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক, আরও বৃদ্ধির আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন বলছে, সুদের হার কম থাকার কারণে প্রযুক্তি শিল্পে দ্রুত সাফল্য পেয়েছে বেশ কয়েকটি নতুন কোম্পানি, অল্প সময়ে শতকোটি ডলার মূল্যায়নের মাইলফলক ছুঁয়েছে এগুলো।

এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে উবার এবং এয়ানবিএনবির মতো বহুলপরিচিত নাম। পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে এয়ারবিএনবির বাজারমূল্য এখন চার হাজার সাতশ কোটি ডলার এবং উবারের বাজারমূল্য এখন আট হাজার দুইশ কোটি ডলার।

কিন্তু সুদের হার বাড়তে থাকায় ‘নগদ অর্থেও টান পড়েছে’ এবং বিনিয়োগকারীরও এখন অনেক হিসেব করে খরচের হাত খুলছেন বলে মন্তব্য করেছেন ও’মারা।

“বিনিয়োগকারীদের অনেকের হাতেই এখনও যথেষ্ট নগদ অর্থ আছে। কিন্তু এমন দুর্দিনে নতুন বিনিয়োগ চুক্তির গতিও কমতে থাকবে,” যোগ করেন তিনি।

কোম্পানির ব্যবসার পরিধি আর আর্থিক মূল্যায়ন খুব দ্রুত বাড়ার সবগুলো ঘটনাও আর প্রযুক্তি খাতে সাফল্যের গল্প বলছে না। বরং থেরানোস আর উইওয়ার্ক-এর মতো কোম্পানিগুলোর গল্প বিনিয়োগকারী ও সেবাগ্রাহক উভয়পক্ষের জন্য সতর্কবার্তা বহন করছে।

প্রচারণার জোরে খুব দ্রুত সাফল্য পেয়েছিল থেরানোস; কয়েক ফোটা রক্ত থেকে ক্যান্সার এবং ডায়বেটিক্স চিহ্নিত করার প্রযুক্তি উদ্ভাবনের দাবি করেছিল কোম্পানিটি। কোম্পানির বাজারমূল্য দ্রুত শতকোটি ডলার ছাড়ালেও খুব শিগগিরই প্রমাণ হয়ে যায় যে কোম্পানির দাবি সবই আসলে ছিল ভুয়া।

একদিকে থেরানোসের মতো কোম্পানিগুলোর মিথ্যাচারের গল্প, অন্যদিকে ফেইসবুক তথা মেটা প্ল্যাটফর্মসের গোমর ফাঁস হওয়ায় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি জনগনের দৃষ্টিভঙ্গিই পাল্টে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে গার্ডিয়ান। গেল বছরেই ফেইসবুকের এক তথ্য ফাঁসকারী সাবেক কর্মী কোম্পানির অভ্যন্তরীণ নথিপত্র দেখিয়ে অভিযোগ তুলেছেন, মুনাফা কামাতে পারলে সেবাগ্রাহকের ভালো-মন্দ নিয়ে মাথাব্যথা নেই কোম্পানিটির শীর্ষ কর্মকর্তাদের।

এ ঘটনাগুলোতে উত্তর আমেরিকায় সিলিকন ভ্যালি নিয়ে জনসাধারণের দৃষ্টিভঙ্গিই পাল্টে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে গার্ডিয়ান। একসময়ে ফেইসবুকের সুনাম করে বেরিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা; ২০০৮ সালের নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে অনেকাংশে ফেইসবুকের ওপর নির্ভর করেছেন তিনি, ২০১১ সালে ‘স্টেট অফ দ্য ইউনিয়ন’ ভাষণেও কোম্পানিটির সুনাম গেয়েছেন।

সেই ওবামাই স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে দেওয়া সাম্প্রতিক বক্তব্যে ভুয়া তথ্যের প্রচার এবং বিশেষ করে নির্বাচনের সময়ে ফেইসবুকের ভূমিকা নিয়ে কঠোর সমালোচনা করেছেন মার্ক জাকারবার্গের কোম্পানিটির।

“গণতন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়ার পেছনে একটা বড় কারণ হচ্ছে, আমাদের যোগাযোগ এবং তথ্য হজম করার প্রক্রিয়ায় তাৎপর্যপূর্ণ কিছু পরিবর্তন এসেছে”-- যোগ করেন তিনি।

দৃশ্যপটে উপস্থিতি বেড়েছে আইনপ্রণেতা এবং বাজারনিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর। কঠোর হচ্ছে ‘ফেডারেল ট্রেড কমিশন (এফটিসি)’, অন্যদিকে নতুন আরও কঠোর আইন প্রণয়নের পথে হাঁটছে মার্কিন কংগ্রেস, যা প্রযুক্তি খাতের জন্য এযাৎকালের সবচয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন শিল্প সংশ্লিষ্টরা।

বিগ টেক হিসেবে পরিচিত প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি জনমতেও আসছে পরিবর্তন। ৬৮ শতাংশ মার্কিন নাগরিকের মতে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে বেশি ক্ষমতা চলে গিয়েছে এবং অর্থনীতির ওপর তাদের প্রভাবটাও বেশি; ২০১৮ সালেই এমন মতামত ছিল ৫১ শতাংশ মার্কিন নাগরিকের।

“ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়লে মানুষ তা নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়ে। কেউ একইসঙ্গে দুই লাখ কোটি ডলারের কোম্পানি আর আদরের সন্তান হতে পারে না। এটা জীবনচক্রেরই অংশ”-- বলেন ও’মারা।

সিলিকন ভ্যালির সীমানা বাড়ছে ক্যালিফোর্নিয়ার বাইরেও

সিলিকন ভ্যালির ভৌগলিক অবস্থানেও পরিবর্তন আসছে বলে মন্তব্য বিশেষজ্ঞদের। দীর্ঘ সময় ধরে সাধারণ মানুষের চোখে উদ্ভাবনী শক্তির আঁতুর ঘরের ভূমিকা পালন করেছে স্যান ফ্রান্সিসকোর দক্ষিণের অঞ্চলটি। ১৯৩০ সালের পর মার্কিন সামরিক বাহিনীর পক্ষে গবেষণা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে এমন প্রকল্পগুলোর প্রযুক্তি হাব হিসেবে দৃশ্যপটে আবির্ভাব সিলিকন ভ্যালির। পরবর্তীতে সে রেওয়াজ ধরে রেখেছে ব্যক্তিমালিকানাধীন খাতের কোম্পানিগুলো।

কিন্তু ক্যালিফোর্নিয়ার সীমানা ছাড়িয়ে গেছে প্রযুক্তি শিল্প। মহামারীতে এই প্রসারণ প্রবণতাও বেড়েছে। ২০২১ সালে টেক্সাসের অস্টিনে প্রধান কার্যালয় সরিয়ে নিয়েছে বিদ্যুচ্চালিত গাড়ি নির্মাতা টেসলা। একই ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে ওরাকল ও হিউলেট-প্যাকার্ডের মতোে একাধিক প্রথমসারির প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান।

“কোভিডে পুরো খেলাই পাল্টে গেছে,”-- মন্তব্য করেছেন মানবসম্পদ খাতের কর্মী ব্রেন্ট উইলিয়ামস। কর্মী নিয়োগ কোম্পানি ‘মাইকেল পেইজ’র এ জ্যেষ্ঠ কর্মীর মতে সিলিকন ভ্যালির আর্থিক ও ভৌগলিক পরিবর্তনের প্রভাব প্রতিফলিত হচ্ছে কর্মী নিয়োগের বেলাতেও।

“কোম্পানিগুলোর জন্যেও এটা খুবই প্রতিযোগিতামূলক হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, প্রতিভাভান কর্মীর জন্য তারা কেবল স্থানীয় প্রতিযোগীদের বিপরীতে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করছেন না, কার্যত পুরো যুক্তরাষ্ট্রের সবার সঙ্গেই লড়ছেন তারা,”-- বলেন তিনি।

আর মহামারীর কারণে বাড়িতে বসে বা অফিস থেকে দূরে কোথাও বসে কাজ করার প্রথাও বেড়েছে– যা মহামারীর আগে হয়তো ভাবাই যেত না।

সিলিকন ভ্যালির গল্প এখনই থামছে না

পুরো শিল্প খাতের সামনে একর পর এক নতুন প্রতিবন্ধকতার আবির্ভাব হলেও, ‘সিলিকন ভ্যালি এখনও শক্ত অবস্থানে আছে বলে মন্তব্য করেছেন স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিষয়ের অধ্যাপক নিকোলাস ব্লুম। সিলিকন ভ্যালি ২০০১ এবং ২০০৮ সালের মন্দার মতো একাধিক জীবনচক্র পাড়ি দিয়েছে এবং প্রতিবারই হারানো জৌলুস ফিরে পেয়েছে বলে মন্তব্য তার।

“কিছু কোম্পানি হয়তো বিশ্বায়ন আর বাড়ি থেকে কাজ করার প্রথার কারণে বাইরের দিকে চলে যাচ্ছে, কিন্তু সিলিকন ভ্যালি এখনও গ্রাউন্ড জিরো, এই খাতে আর কোনো অঞ্চলের এতো বেশি গুরুত্ব নেই।”

নিকোলাস ব্লুমের সঙ্গে একমত প্রকাশ করেছেন অধ্যাপক মার্গারেট ও’মারাও; প্রযুক্তি শিল্প খাতে সিলিকন ভ্যালির গুরুত্ব হারানোর কোনো আশঙ্কা এখনও দেখছেন না তিনি।

“সিলিকন ভ্যালির জন্য এটি হয়তো একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি, কিন্তু এটি সিলিকন ভ্যালির জন্য সমাপ্তি নয়,”-- বলেন ও’মারা।