গত এক বছরে এআই প্রযুক্তির সম্ভাব্য ঝুঁকি নিয়ে বেশ কিছু ঘটনা দেখা গেছে। এর মধ্যে আছে এআই চ্যাটবট ব্যবহার করে স্কুল শিক্ষার্থীদের বাড়ির কাজ করে দেওয়ার অভিযোগও।
Published : 24 Dec 2023, 05:07 PM
২০২৩ সালে প্রযুক্তি খাতে অন্যতম আলোচনার বিষয় ছিল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, যার সূত্রপাত ঘটেছে জেনারেটিভ এআই ও চ্যাটজিপিটি’র মতো উদীয়মান প্রযুক্তির উত্থান থেকে।
২০২২ সালের শেষে চ্যাটজিপিটি চালু করার পর থেকেই এ প্রযুক্তির সম্ভাব্য ঝুঁকি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা দেখা গেছে। হোক সেটা কোনো দেশের পার্লামেন্ট বা টিভি সংবাদের কোনো প্রতিবেদনে।
জেনারেটিভ এআই মডেল নিয়ে মানুষের আগ্রহের কথা বিবেচনায় রেখে নিজস্ব চ্যাটবট উন্মোচন করতে বা ভবিষ্যতে নিজস্ব পণ্যে এআই ব্যবহারের পরিকল্পনা জানাতে দেখা গেছে বিশ্বের শীর্ষ প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোকে।
অন্যদিকে, বিভিন্ন দেশে কীভাবে এআই প্রযুক্তির সম্ভাব্য ঝুঁকি মোকাবেলা করা যায়, তা নিয়ে বিতর্ক বেড়েছে সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মধ্যেও।
গত এক বছরে এআই প্রযুক্তির সম্ভাব্য ঝুঁকি নিয়ে বেশ কিছু ঘটনা দেখা গেছে। এর মধ্যে আছে এআই চ্যাটবট ব্যবহার করে স্কুল শিক্ষার্থীদের বাড়ির কাজ করে দেওয়ার অভিযোগ ও উদীয়মান এ খাত যেন মানবতার অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে না দাঁড়ায়, তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে যুক্তরাজ্যের প্রধান মন্ত্রী ঋষি সুনাকের আয়োজিত প্রথম বৈশ্বিক এআই সুরক্ষা সম্মেলন।
ব্রিটিশ দৈনিক ইন্ডিপেন্ডেন্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এক কথায় এ পুরো বছরই কেটেছে এআই প্রযুক্তিকে ঘিরে।
কে কী এনেছে?
এ প্রযুক্তির মতোই গত এক বছরে এআই সংশ্লিষ্ট পণ্য উন্মোচনের প্রবণতাও বেড়েছে, যেখানে চ্যাটজিপিটি’র অভাবনীয় সাফল্যে ওপেনএআই জেনারেটিভ এআইভিত্তিক পণ্য আনার ঘোষণা দেওয়ার পর থেকেই তাদের অনুসরণ করে নিজস্ব এআই ব্যবস্থা উন্মোচন করেছে গুগল, মাইক্রোসফট ও অ্যামাজনের মতো শীর্ষ প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো।
গুগল
চ্যাটজিপিটি’র সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে ‘বার্ড’ নামে নিজস্ব এআই চ্যাটবট প্রকাশ করেছে গুগল, যেখানে রয়েছে গুগলের সুপরিচিত সার্চ ইঞ্জিন থেকে ডেটা সংগ্রহের সুবিধা। এ ছাড়া, ‘গুগল অ্যাসিস্ট্যান্ট’ নামের ভার্চুয়াল সহায়ক ব্যবস্থা উন্মোচন করেছে কোম্পানিটি, যা ব্যবহারের সুবিধা মেলে কোম্পানির নিজস্ব স্মার্টফোন ও স্মার্ট স্পিকারগুলোয়।
অ্যামাজন
একইভাবে, নিজস্ব ভার্চুয়াল সহায়ক ব্যবস্থা ‘অ্যালেক্সা’তে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি যোগ করেছে আরেক প্রযুক্তি জায়ান্ট অ্যামাজনও, যেখানে বিভিন্ন প্রশ্নের তুলনামূলক নির্ভুল ও মানুষের সঙ্গে আলাপের মতোই জবাব মেলে।
মাইক্রোসফট
উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেমে ‘কোপাইলট’ নামে নিজস্ব ভার্চুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্ট যোগ করেছে মাইক্রোসফট, যেখানে রয়েছে জেনারেটিভ এআই প্রযুক্তি ব্যবহারের সুবিধা, যার মাধ্যমে ব্যবহারকারী প্রতিবেদন লেখা থেকে শুরু করে নিজের উইন্ডোজ স্ক্রিন সাজানোর মতো সুবিধাও পেয়ে থাকেন।
ইলন মাস্ক
‘এক্সএআই’ নামে নিজস্ব এআই স্টার্টআপ কোম্পানি তৈরির ঘোষণা দিয়েছেন মার্কিন ধনকুবের ইলন মাস্ক।
স্টার্টআপ কোম্পানিটি এরইমধ্যে ‘গ্রক’ নামের কথোপকথনমূলক এআই ব্যবস্থা উন্মোচন করেছে, যা ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছেন মাস্ক মালিকানাধীন সামাজিক মাধ্যম এক্স-এর ‘পেইড’ গ্রাহকরা।
এমন বড় পরিসরে এআই পণ্যের বিকাশ বিভিন্ন দেশের সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার নজর এড়িয়ে যায়নি।
যুক্তরাজ্য
মার্চে এআই প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণে নিজস্ব ‘হোয়াইট পেপার’ প্রকাশ করেছে যুক্তরাজ্য সরকার, যেখানে একক কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থা গঠন করার বদলে বিভিন্ন খাতে প্রচলিত নীতিমালা ব্যবহার করে এআই প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণের প্রস্তাব রয়েছে।
তবে, এআই প্রযুক্তি নিয়ে এখনও কোনো বিল চালু না হওয়ার বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা করতে দেখা গেছে বিশেষজ্ঞদের এক অংশকে। পাশাপাশি, তারা সতর্কবার্তা দিয়েছেন, বিভিন্ন এআই টুলের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ প্রযুক্তির সম্ভাব্য ঝুঁকিগুলো অনিয়ন্ত্রিত থেকে যাচ্ছে।
যুক্তরাজ্যে সরকার বলেছে, গোটা বিশ্ব এখনও এআই প্রযুক্তির সম্ভাব্য ঝুঁকি শনাক্ত করার কাজ করছে, যার ফলে তারা এ নীতিমালা তৈরি নিয়ে তাড়াহুড়ো করতে চায় না। আর, এআই নিয়ে তাদের প্রক্রিয়া কিছুটা শিথিল করার কারণ হল আগের চেয়ে বেশি উদ্ভাবনের সুযোগ দেওয়া।
ইইউ
এ মাসের শুরুতে এআই প্রযুক্তি নজরদারির জন্য নিজস্ব নীতিমালা তৈরির বিষয়ে একমত হয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। তবে, ২০২৫ সালের আগে তা আইনে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবে, আইনটি কার্যকর হলে, বিভিন্ন এআই মডেল নিয়ে তদন্ত চালাতে ও সেগুলো কীভাবে প্রশিক্ষিত হয়েছে, সে সম্পর্কে তথ্য জানার ক্ষমতা পাবে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো।
এআই সম্মেলন
গেল নভেম্বরে যুক্তরাজ্যের ব্লেচলি পার্কে বিশ্বের প্রথম এআই সেইফটি সামিট আয়োজন করেন দেশটির প্রধান মন্ত্রী ঋষি সুনাক, যার লক্ষ্য, এআই নীতিমালা তৈরির ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্যকে বিশ্বের নেতৃস্থানীয় পর্যায়ে রাখা।
দুই দিনের এ সম্মেলনে তথাকথিত ‘সম্মুখসারীর এআই’ ব্যবস্থার সম্ভাব্য ঝুঁকি নিয়ে আলোচনা করেছেন সুনাক ও যুক্তরাজ্যের প্রযুক্তি মন্ত্রী মিশেল ডনেলান। এ যুগান্তকারী প্রযুক্তি ভুল কারও হাতে গেলে তা ক্ষতিকারক কাজের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হবে, এমন সতর্কবাণীও উঠে এসেছে এ আয়োজনে।
‘ব্লেচলি ডিক্লারেশন’ নামের এক চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেছে আয়োজনে অংশ নেওয়া দেশগুলো, যার মধ্যে রয়েছে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রও। বিভিন্ন কোম্পানি যেন নিরাপদ ও দায়িত্বশীল উপায়ে নিজস্ব এআই ব্যবস্থার বিকাশ ঘটিয়ে এর সম্ভাব্য ঝুঁকিগুলো মোকাবেলা করে, সে আহ্বান রয়েছে এ চুক্তিপত্রে।
এ ছাড়া, যুক্তরাজ্যে ‘এআই সেইফটি ইনস্টিটিউট’ গঠন এবং ওপেনএআই ও গুগল ডিপমাইন্ডের মতো শীর্ষ কোম্পানির সঙ্গে ঐচ্ছিক চুক্তি করার ঘোষণাও দিয়েছেন সুনাক। এর মাধ্যমে কোম্পানিগুলোর নতুন এআই মডেল প্রকাশের আগে প্রতিষ্ঠানটি সেগুলো পরীক্ষা করার সুযোগ পাবে।
ইন্ডিপেন্ডেন্ট বলছে, এ চুক্তি বাধ্যতামূলক না হলেও, সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার আলোচনায় এআই সুরক্ষা যে গুরুত্বপূর্ণ এক অংশ, তার ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এর মাধ্যমে।
অল্টম্যানের ছাঁটাই
এ বছরের আরেকটি বড় ঘটনা ছিল, নভেম্বরের শেষে চ্যাটজিপিটি’র নির্মাতা কোম্পানি ওপেনএআইয়ের পরিচালনা পর্ষদ কর্তৃক কোম্পানির সিইও স্যাম অল্টম্যানের নাটকীয় ছাঁটাইয়ের ঘটনাটি।
তবে, এ সিদ্ধান্তের পরপরই কোম্পানির প্রায় সকল কর্মী এক চিঠিতে স্বাক্ষর করেন, যেখানে তারা হুমকি দেন যে তাকে সিইও পদে না ফেরালে তারা ওপেনএআই ছেড়ে মাইক্রোসফটের প্রস্তাবিত অল্টম্যানের নতুন এআই গবেষণা দলে যোগ দেবেন।
এমন হুমকির পরপরই অল্টম্যানকে নিজ পদে ফেরাতে বাধ্য হয় কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ। আর নিজ পদে ফেরার পরপরই ওপেনএআইয়ের পর্ষদকে নতুন করে ঢেলে সাজিয়েছেন অল্টম্যান। তবে, অল্টম্যানকে ঠিক কী কারণে ছাঁটাই করা হয়েছিল, সে কারণ এখনও পরিষ্কার নয়।
এর পর থেকেই, মাইক্রোসফটের সঙ্গে ওপেনআইয়ের সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন তুলছে যুক্তরাজ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ ‘কম্পিটিশন অ্যান্ড মার্কেটস অথরিটি (সিএমএ)’।
সিএমএ বলেছে, অল্টম্যানকে নিয়ে যে নাটক চলেছে, তার অংশ হিসেবেই দুই কোম্পানির মধ্যকার অংশীদারিত্বের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
এদিকে ইঙ্গিত মিলেছে, সামনের বছর এআই খাত নিয়ে তদন্তের প্রবণতা আরও বাড়তে দেখা যাবে।