“সময়ের মতো দুষ্প্রাপ্য সম্পদ নষ্ট হচ্ছে মোবাইল ফোনের নির্ভরশীল ব্যবহারে,” বলেন গবেষকদের একজন।
Published : 21 Aug 2023, 12:03 AM
মোবাইল ফোন ব্যবহারের ক্ষেত্রেও যে একটা সীমা থাকা দরকার, তা দেশের অনেকেই মানছেন না বলে বিআইডিএস পরিচালিত এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে।
রোববার ঢাকার আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (বিআইডিএস) অনুষ্ঠিত এক অনুষ্ঠানে ‘মোবাইল জীবন: মোবাইল ফোনের নিত্য ব্যবহার’ শীর্ষক এ সমীক্ষার তথ্য উপস্থাপন করেন গবেষক গোলাম নবী মজুমদার।
তিনি বলেন, “মোবাইল একটি প্রযুক্তিগত পণ্য, যে যন্ত্রটির ব্যবহারে জীবন সহজ ও জীবনের অনুষঙ্গ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখন তা জীবনে পরিণত হয়েছে, তাদের কাছে মোবাইলই জীবন। সাক্ষাৎকারে অংশ নেওয়া সবাই বলেছেন, মোবাইল ছাড়া ‘এক মুহূর্ত চলা সম্ভব না’।
দেশের আট বিভাগে ১৫ থেকে ৩৫ বয়সী পিছিয়ে পড়া কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী, গৃহবধূসহ নানা পেশার ২৪০ জনের সাক্ষাৎকারভিত্তিক সমীক্ষাটি পরিচালিত হয়। সমীক্ষায় অংশ নেওয়াদের মধ্যে নারী ১৩০ জন।
সমাজে পিছিয়ে পড়া এসব মানুষের দৈনন্দিন ব্যবহারিক জীবন, আয় ব্যবস্থা, বিনোদন, অবসর যাপন, যোগাযোগে প্রযুক্তি পণ্য মোবাইলের সম্পর্ক কেমন, তা জানতে সমীক্ষাটি পরিচালনা করেন তিন গবেষক।
সাক্ষাৎকারদাতারা মোবাইল ব্যবহার করে কী কী করেন তা জানতে চেয়েছিলেন গবেষকরা। এর বাইরে মোবাইলে কোন ধরনের যোগাযোগ অ্যাপ, সামাজিক মাধ্যম, ওয়েবসাইটে প্রবেশ, সিনেমা, নাটক, গেমিং, অনলাইন বাজি, ইউটিউব, টুইটার (এক্স) ব্যবহারের মতো বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়।
মোবাইল ফোনের ব্যবহার নিয়ে গবেষক গোলাম নবী মজুমদার বলেন, “যাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নাই বা নামমাত্র রয়েছে, তারাই জরিপে অংশ নিয়েছেন। এটি মোটা দাগে বললে, তারা মোবাইলে শুধু ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগই নয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের জন্য ইন্টারনেট ব্যবহারের পাশাপাশি ক্ষুদ্র ব্যবসার কার্যক্রমও পরিচালনা করছেন কেউ কেউ।কোনো কোনো মানুষের জীবন বদলে দিয়ে বেঁচে থাকার অবলম্বনে পরিণত হয়েছে।’’
স্বল্প শিক্ষিত কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই-এসব মানুষ মোবাইল ব্যবহার করে যেমন বর্ণমালা শিখছেন; নতুন ভাষা শিখছেন, মুখে কথা বলে মোবাইলে টাইপ করা (ভয়েস টু টেক্সট), লিখিত মেসেজ ভয়েসে কনভার্ট করার মতো ব্যবহারও আছে। পাশাপাশি ছবি কিংবা অডিও/ভিডিও ফাইল ক্লাউডে সেভ করে এবং মোবাইলে ভিডিও বানিয়ে টিকটক, ফেসবুক, টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যবহারও করছেন সাক্ষাৎকার দাতারা।
লুডু, ক্যারাম, দাবা, দড়ি খেলা, কানা-মাছি’র কৈশোরের খেলাগুলোও তারা মোবাইলে খেলছেন। যোগাযোগে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশে যোগাযোগ করছেন মোবাইল ফোনের মাধ্যমে।
নিরক্ষর হলেও তারা মোবাইল ব্যবহারে এতোটা দক্ষ হয়েছেন যে- তারা মোবাইলে কাঙ্ক্ষিত সব অ্যাপ ব্যবহার করতে পারছেন উল্লেখ করে গোলাম নবী মজুমদার বলেন, “মোবাইল ফোনের গুরুত্বটা তখনই স্পষ্ট হয়, যখন তাদের ফোনটা প্রয়োজন কিন্তু কাছে নেই বা তা ব্যবহার করার উপযোগী নয়। ফোনবিহীন জীবন তখন মনে হয় বন্ধ্যা, অস্থির বা খাঁচায় বন্দি ।”
অনুষ্ঠানে প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ও বেসিসের সাবেক সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবির বলেন, “অদূর ভবিষ্যতে মোবাইল শুধু আর মোবাইল থাকবে না। এটি এমন এক যন্ত্রে পরিণত হবে- যেখানে ব্যবহারকারীরা একসঙ্গে অনেক সুবিধা পেয়ে যাবেন। বিশ্বের অনেক দেশেই এখন এই যন্ত্রকে এম কমার্স (মোবাইল কমার্স) হিসেবে বলা হচ্ছে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক খোরশেদ আলম বলেন, ‘‘শুধু যোগাযোগ নয় মোবাইলের ব্যবহার এখন গবেষণা, পড়াশোনা, তথ্য সংগ্রহের মতো কাজে ব্যবহার হচ্ছে। বড় একটি জায়গাকে হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছে। এর সম্ভাবনাকে ব্যবহার করতে রাষ্ট্রীয় কী নীতিমালা সহযোগিতা করতে পারে- তা বিবেচনায় আনা যায়।’’
সভাপতির বক্তব্যে বিআডিএসের মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন বলেন, “মোবাইল ফোনের ব্যবহার নিয়ে সেভাবে বিস্তর গবেষণা হয়নি। অপব্যবহার নিয়ে কিছুটা তথ্য-উপাত্ত দেখা যায়। লেনদেন সহজীকরণসহ যে বিশাল ইতিবাচক প্রভাব মানবজীবনে পড়ছে তা এই গবেষণায় আলোকপাত করা হয়েছে। এ ধরনের গবেষণা আরো হওয়া প্রয়োজন।”
মোবাইল কীভাবে ব্যবহার হচ্ছে তা দেখে সমাজের মূল্যবোধও পরিমাপ করার সুযোগ হচ্ছে জানিয়ে গবেষক আব্দুস সাত্তার মন্ডল বলেন, “আমি কী গ্রহণ করছি তাই আমার মূল্যবোধ। এটি (মোবাইল ফোন) সমাজের মূল্যবোধকে নষ্টও করেছে।
“সেই সঙ্গে সময়ের মতো দুষ্প্রাপ্য সম্পদ নষ্ট হচ্ছে মোবাইল ফোনের নির্ভরশীল ব্যবহারে। এই কৈশোর, যৌবনের সময় আর ফিরে পাওয়া যাবে না- আমরা তা হারাচ্ছি। এসব নিয়েও বিস্তর গবেষণার প্রয়োজন আছে।”