চিপ উৎপাদন খাত বাড়ানোর চেষ্টা করছে ভিয়েতনাম ও ভারতের মতো দেশও। এর মাধ্যমে মার্কিন চীনা ভূরাজনৈতিক অস্থিরতার কবলে পড়া গ্রাহকদের টানা যাবে।
Published : 18 Dec 2023, 12:50 PM
নিজেদের ‘হাই-এন্ড’ চিপের বিভিন্ন অংশ সমন্বিত করার লক্ষ্যে মালেয়শিয়ার বিভিন্ন কোম্পানির সঙ্গে কাজ করার আগ্রহ বাড়ছে চীনের সেমিকন্ডাক্টর নকশাকারী কোম্পানিগুলোর মধ্যে।
বিভিন্ন সূত্র বলছে, নতুন এই আগ্রহের পেছনে রয়েছে চীনের চিপ খাতের লাগাম টেনে ধরার উদ্দেশ্যে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা বাড়ানোর সম্ভাব্য ঝুঁকি। এ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে পরিকল্পনা সাজাচ্ছে চীনা কোম্পানিগুলো।
সূত্ররা বলছে, চীনের কোম্পানিগুলো বিভিন্ন মালেয়শীয় চিপ প্যাকেজিং কোম্পানিকে ‘জিপিইউ’ শ্রেণির চিপ সমন্বিত করার অনুরোধ জানাচ্ছে।
রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ অনুরোধে কেবল ‘চিপ অ্যাসেম্বলি’র বিষয়টিতেই জোর দেওয়া হয়েছে, যা মার্কিন নিষেধাজ্ঞারে আওতাধীন নয়। বিষয়টির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দুই ব্যক্তির তথ্য অনুসারে, কয়েকটি কোম্পানি এরইমধ্যে চুক্তি সেরেও ফেলেছে।
তবে, চুক্তির গোপনীয়তা রক্ষার বিষয়টিকে কারণ হিসেবে দেখিয়ে সূত্ররা এর সঙ্গে জড়িত কোম্পানিগুলোর নাম বলতে রাজি হননি।
উচ্চমানের জিপিইউ চিপে চীনের প্রবেশাধিকার সীমিত করতে দেশটিতে চিপ বিক্রি এমনকি চিপ তৈরির সরঞ্জাম বিক্রির ওপরও নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে ওয়াশিংটন। এর কারণ হিসেবে তারা বলছে, এর মাধ্যমে চীন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা খাতে যুগান্তকারী কিছু ঘটিয়ে ফেলতে পারে বা নিজেদের সুপার কম্পিউটারের সক্ষমতা বাড়াতে পারে। এ ছাড়া, চীনের সামরিক খাতের জন্য এ ধরনের চিপ ব্যবহারের ঝুঁকির বিষয়টিও উল্লেখ করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
চীনের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি দেশটিতে এআই চিপের চাহিদাও বাড়ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এর ফলে পর্যাপ্ত উন্নতমানের প্যাকেজিং সেবা দিতে গিয়ে কাঠখড় পোড়াতে হচ্ছে তুলনামূলক ছোট চীনা সেমিকন্ডাক্টর কোম্পানিগুলোকে।
সংশ্লিষ্ট দুই ব্যক্তির তথ্য অনুসারে, কিছু কিছু চীনা কোম্পানি উন্নত চিপ প্যাকেজিং সেবা দিতে আগ্রহী।
এ ধরনের প্যাকেজিং ব্যবস্থা চিপের পারফর্মেন্সে বড় উন্নতি সাধনের পাশাপাশি সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে চিপলেট নির্মাণের বিষয়টিও, যেখানে চিপগুলো এমনভাবে প্যাকেজিং করা হয় যাতে এগুলো একসঙ্গে একটি ক্ষমতাশালী মস্তিষ্ক হিসেবে কাজ করার সক্ষমতা অর্জন করে।
এ ধরনের সেবা মার্কিন রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার আওতায় না পড়লেও এর জন্য প্রয়োজন অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। আর, চীনা কোম্পানিগুলোর মধ্যেও উদ্বেগ বাড়ছে যে, একদিন হয়ত এ ধরনের সেবাও মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়বে।
সেমিকন্ডাক্টর সরবরাহ চেইনের ‘অন্যতম মূল হাব’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে মালেয়শিয়া। এ ছাড়া, চীনা কোম্পানিগুলো নিজেদের ‘অ্যাসেম্বলিং’ ব্যবস্থায় বৈচিত্র্য আনার লক্ষ্যে চীনের বাইরে নজর দেওয়ায়, দেশটিতে ব্যবসা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে রয়টার্স।
বিষয়টির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক সূত্র বলেছে, এরইমধ্যে চীনা কোম্পানিগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ ও ব্যবসা বাড়াতে দেখা গেছে বিভিন্ন মালেয়শীয় চিপ প্যাকেজিং কোম্পানিকে। এর মধ্যে রয়েছে ‘ইউনিসেম’ও, যাদের সিংহভাগ মালিকানাই চীনা কোম্পানি ‘হুয়াতিয়ান টেকনোলজি’র দখলে।
কোম্পানির চীনা গ্রাহকদের সম্পর্কে রয়টার্সকে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি ইউনিসেমের চেয়ারম্যান জন চিয়া। তবে তিনি বলেছেন, “ব্যবসায়িক নিষেধাজ্ঞা ও সরবরাহ চেইনে সমস্যা থাকায় অনেক চীনা চিপ নকশা কোম্পানিই চীনের বাইরে নিজস্ব ব্যবসায় সরবরাহ চেইনের বাড়তি উৎসের খোঁজে মালেয়শিয়ায় এসেছে।”
এ ছাড়া, মালেয়শিয়ার সঙ্গে চীনের সুসম্পর্ক থাকায় দেশটিকে ভাল ও সাশ্রয়ী বিকল্প হিসেবেও দেখছে চীনা চিপ নকশা কোম্পানিগুলো। সূত্রদের মতে, এর কারণ হল দেশটির অভিজ্ঞ কর্মশক্তি ও অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি।
চীনা কোম্পানিগুলোর চিপ সমন্বয় করার অর্ডার গ্রহণের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হওয়ার ঝুঁকি আছে কি না, সে সম্পর্কে চিয়া বলেন, ইউনিসেমের ব্যবসায়িক চুক্তিগুলো ‘পুরোপুরি বৈধ ও সামঞ্জস্যপূর্ণ’। আর ‘এ ধরনের ঝুঁকি’ সম্পর্কে কোম্পানির ভেবে দেখার সময় নেই।
তিনি আরও বলেন, মালেয়শিয়ায় ইউনিসেমের বেশিরভাগ গ্রাহকই যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা।
এ প্রসঙ্গে রয়টার্সকে তাৎক্ষণিক জবাব দেয়নি মার্কিন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া, মালেয়শিয়ার শীর্ষস্থানীয় চিপ প্যাকেজিং কোম্পানি ‘মালেয়শিয়ান প্যাসিফিক ইন্ডাস্ট্রিজ’ ও ‘ইনারি আমারট্রন’-এর কাছ থেকেও এ বিষয়ে সাড়া মেলেনি।
এক সূত্রের তথ্য অনুসারে, চীনা কোম্পানিগুলো চীনের বাইরে চিপ সমন্বিত করতে আগ্রহী কারণ এতে চীনের বাইরের বাজারে তাদের পণ্য বিক্রি করা সহজ হবে।
শীর্ষ হাব
সেমিকন্ডাক্টর প্যাকেজিং, অ্যাসেম্বলি ও পরীক্ষার বৈশ্বিক বাজারে বর্তমানে ১৩ শতাংশ অবদান রাখছে মালেয়শিয়া। এ ছাড়া, ২০৩০ সাল নাগাদ এ সংখ্যাকে ১৫ শতাংশে নেওয়ার লক্ষ্যস্থির করেছে দেশটি।
যেসব চীনা কোম্পানি মালেয়শিয়ায় ব্যবসা বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে একসময় হুয়াওয়ের ইউনিট হিসেবে কাজ করা কোম্পানি ‘এক্সফিউশন’। কোম্পানিটি বলেছে, জিপিইউ সার্ভার তৈরির জন্য তারা মালেয়শীয় কোম্পানি ‘ন্যাশনালগেইট’-এর সঙ্গে জোট বাঁধবে।
এদিকে, মালেয়শিয়ার পেনাং অঙ্গরাজ্যে নতুন ডিজাইন সেন্টার নির্মাণ করছে সাংহাইভিত্তিক কোম্পানি ‘স্টারফাইভ’ও। অন্যদিকে, গত বছর চীনভিত্তিক চিপ প্যাকেজিং কোম্পানি ‘টংফু মাইক্রোইলেক্ট্রনিক্স’ বলেছিল, মার্কিন চিপ নির্মাতা এএমডি’র সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে তারা মালেয়শিয়ায় একটি কারখানা বানাবে।
বিভিন্ন লোভনীয় প্রস্তাবনার মাধ্যমে চিপ শিল্পে কয়েকশ কোটি ডলারের বিনিয়োগ পেয়েছে মালেয়শিয়া। গেল অগাস্টে জার্মান কোম্পানি ‘ইনফিনিয়ন’ বলেছিল, মালেয়শিয়ায় নিজস্ব চিপ কারখানা বানাতে তারা ৫৪০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে।
২০২১ সালে মার্কিন চিপ নির্মাতা ইনটেল ঘোষণা দিয়েছিল, তারা মালেয়শিয়ায় একটি অত্যাধুনিক চিপ প্যাকেজিং কারখানা নির্মাণ করবে, যার পেছনে খরচ হবে সাতশ কোটি ডলার।
চীনা কোম্পানিগুলো চিপ প্যাকেজিংয়ের জন্য কেবল মালেয়শিয়াকেই বেছে নিচ্ছে, বিষয়টি এমন নয়। ২০২১ সালে সিঙ্গাপুরে একটি অত্যাধুনিক কারখানা বানিয়েছে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম চিপ সমন্বয়কারী কোম্পানি ‘জেসিইটি গ্রুপ’।
এ ছাড়া, নিজেদের চিপ উৎপাদন খাত বাড়ানোর চেষ্টা করছে ভিয়েতনাম ও ভারতের মতো দেশগুলোও। তারা আশা করছে, এর মাধ্যমে মার্কিন চীনা ভূরাজনৈতিক অস্থিরতার কবলে পড়া গ্রাহকদের আকৃষ্ট করা যাবে।