নতুন আসক্তি ক্রিপ্টো, সমাধান ‘পাঁচ তারকা’ রিহ্যাব সেন্টারে

তিনি আসলে ‘প্যারাসেলসাস রিকভারি’তে গিয়েছিলেন যে ঘুমের ওষুধের উপর অতিরিক্ত নির্ভরতার কারণে। পরে দেখা গেল মূল কারণ ক্রিপ্টো আসক্তি।

প্রযুক্তি ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 Feb 2023, 08:44 AM
Updated : 6 Feb 2023, 08:44 AM

একটা সময় ছিল যখন ক্রিপ্টো মুদ্রার ব্যবসায় প্রতি সপ্তাহে দুই লাখ ডলার ঢালতেন ডন; মুদ্রার দর আর নিজের ব্যালেন্স জানতে সবসময় উদগ্রীব থাকায় রাতে নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমাতেন না, উঠেও পড়তেন খুব ভোরে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডিজিটাল মুদ্রা লেনদেন পরিচালনাকারী একটি কোম্পানিতে কাজ করা ডন জানান, দীর্ঘ দূরত্বের ফ্লাইট যাত্রার আগে তিনি খুবই বিচলিত হয়ে পড়তেন, দরদর করে ঘামতেন। কারণ ফ্লাইট যাত্রায় ইন্টারনেট সংযোগ না থাকায় ক্রিপ্টো মুদ্রায় তার বিনিয়োগের আপডেট মিলবে না দীর্ঘ সময়।

প্রচণ্ড মানসিক চাপে ২০২২ সালের মাঝামাঝিতে তার অবস্থা আরও খারাপ হতে থাকলে তিনি শেষ পর্যন্ত মেনে নিলেন যে, কারও সাহায্য নিতেই হচ্ছে।

এরপর স্পেনের দ্বীপ মাজোর্কাতে পুনর্বাসন কেন্দ্র ‘দ্য ব্যালেন্স’-এ চার সপ্তাহ কাটান ডন, যেখানে তার পরিস্থিতির উন্নতি হতে থাকে।

বিবিসি জানিয়েছে, ডন তার আসল নাম প্রকাশ করতে চাননি, কারণ ডিজিটাল মুদ্রায় বিনিয়োগকারীদের নিয়ে তার মন্তব্যের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

মানসিক স্ট্রেসের মধ্যে দিয়ে যাওয়া ওই ব্যক্তি প্রাইভেট একটি ভিলায় থাকতেন। একজন গৃহ পরিচারিকা আর রাধুনিই কেবল আসাযাওয়া করতেন সেখানে।

পুনবার্সন কেন্দ্রে চিকিৎসা শুরু হলে তাকে শরীর মাসাজ, ইয়োগা, বাইক চালনার পাশাপাশি থেরাপিও দেওয়া হচ্ছিল। ডন জানান, ‘ব্যালেন্সের’ চিকিৎসা আর পরিচর্যা তার ‘ক্রিপ্টো আসক্তি’ কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করেছে। কিন্তু চার সপ্তাহের চিকিৎসা শেষে তার হাতে ধরিয়ে দেওয়া হলো ৭৫ হাজার ডলারের এক ‘অস্বাভাবিক’ বিল।

‘দ্য ব্যালেন্স’ সুইজারল্যান্ডের জুরিখে প্রতিষ্ঠিত হলেও লন্ডন ও মাজোর্কায়ও তাদের শাখা কেন্দ্র রয়েছে। ‘স্বাস্থ্য ও পরিপূর্ণতার নিরাপদ আশ্রয়’ হিসেবে একে বর্ণনা করেছে ‘ব্যালেন্স’ কর্তৃপক্ষ।

তাদের ওয়েবসাইটের হোম পেইজে ‍রয়েছে সমুদ্র সৈকত সংলগ্ন একটি বাড়ির ছবি এবং এখান থেকে সেবা নেওয়া গ্রাহকদের প্রশংসা বাণী। এ সেন্টারের চিকিৎসার তালিকায় রয়েছে দুঃশ্চিন্তা, অবসাদ, হতাশা, ট্রমা পরবর্তী মানসিক চাপ এবং খাদ্যভ্যাসে সমস্যাজনিত বিষয়গুলো।

বিবিসি বলছে, মহামারী এবং অস্থিতিশীল ক্রিপ্টো বাজার মিলে উন্মাদনা তৈরি করেছে ডিজিটাল মুদ্রার ব্যবসায়। আর এতে যুক্ত হয়ে যারা মানসিকভাবে অস্থির, অবসাদগ্রস্ত কিংবা আসক্ত হয়ে পড়ছেন, তাদের জন্য এখন গড়ে উঠেছে বিভিন্ন পুনর্বাসন কেন্দ্র; যারা সরাসরি ‘ক্রিপ্টো আসক্তি’ সারিয়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে।

এরকম যেসব রিহ্যাব সেন্টারের খোঁজ পেয়েছে বিবিসি, সেগুলোর বেশিরভাগই বিলাসবহুল ও জাঁকজমকে পূর্ণ। তারা মাদক, অ্যালকোহল ও খাদ্যভ্যাসে সমস্যা সারানোর প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে।

তিনটি রিহ্যাব সেন্টার ও ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ বিবিসিকে জানিয়েছে, ক্রিপ্টোকারেন্সি আসক্তিসহ এরকম সমস্যাগুলো নিয়ে গত দুই বছরে তাদের কাছে শত শত প্রশ্ন এসেছে। কিন্তু ক্রিপ্টো আসক্তির চিকিৎসায় এত বেশি অর্থ প্রয়োজন পড়ে কিনা তা নিয়ে সন্দিহান বিশেষজ্ঞরা।

স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এবং স্ট্যানফোর্ড অ্যাডিকশন মেডিসিন ডুয়াল ডায়াগনসিস ক্লিনিকের প্রধান অধ্যাপক আনা লেম্বকে বলছেন, ক্রিপ্টো আসক্তির চিকিৎসা আসলে অন্যান্য আসক্তির মতোই।

“এটি বায়োসাইকোসোশাল ডিজিজ, আর এজন্য বায়োসাইকোসোশাল পদ্ধতিতেই নিরাময় প্রয়োজন। যেমন- কিছু ক্ষেত্রে ওষুধ, একক ও গ্রুপ সাইকোথেরাপি, অভ্যাস ও পরিবেশের পরিবর্তন অথবা স্বাস্থ্যসম্মত পরিবর্তিত কার্যক্রম বাস্তবায়ন প্রয়োজন।”

তবে আনা লেম্বকে যোগ করেন, খরচ কত হবে সেটি সবসময় নির্ধারিত নয়। তার মতো বিশেষজ্ঞরা যুক্তি দেন, এই আসক্তি অনেকটা জুয়ার মতো, আর একে সেভাবেই দেখা উচিত।

রুটজার্স স্কুল অফ সোশাল ওয়ার্কের সেন্টার ফর গ্যাম্বলিং স্টাডিজের পরিচালক লিয়া নোওয়ার বলেন, “তারা বিষণ্ণ বা অবসাদগ্রস্তদের কাছ থেকে অর্থ উপার্জন করছে। আপনি ক্রিপ্টো ব্যবসা, খেলাধুলায় বাজি বা লটারি যাতেই আসক্ত হন না কেন, আপনার লক্ষণ আর চিকিত্সা মূলত একই হবে।”

মিজ লেম্বকে বলেন, অন্যান্য আসক্তির মতো ক্রিপ্টোর বেলাতেও আসক্তির উপাদান থেকে রোগীকে দূরে রাখা এবং রোগীর চিকিৎসা প্রত্যাখ্যান করার লক্ষণ বিবেচনায় নিয়ে চিকিৎসা শুরু করা উচিত। এর সঙ্গে থাকতে পারে উদ্বেগ, বিরক্তি এবং অনিদ্রার বিষয়ও ।

"অন্তত চার সপ্তাহের জন্য কোনও ক্রিপ্টো ট্রেডিংয়ে যুক্ত হওয়া বা এর লেনদেনের তথ্য পাওয়া একেবারে বন্ধ করে দিতে পারলে মস্তিষ্ক তার আত্মতৃপ্তির উৎসগুলো নতুন করে ঠিক করে নেওয়ার সুযোগ পায়। এটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ধরে রাখতে পারলে এবং রোগীর জন্য মানসিক সহায়তা এবং ভরসার জায়গাটি তৈরি করতে পারলে তারা চিকিৎসা সম্পূর্ণ করেন।

আর দীর্ঘমেয়াদে চিকিৎসার বেলায় আর্থিক বিনিয়োগে স্বাস্থ্যকর বিকল্পের বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত থাকবে- তিনি যোগ করেন।

ক্রিপ্টো আসক্তির চিকিত্সা একেবারেই নতুন ধারার বিষয়। এতে এখনও বিশেষ সনদের প্রচলন হয়নি। বিবিসি যেসব থেরাপিস্ট ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের কর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছে, তাদের অধিকাংশই নিজেদেরকে মানসিক স্বাস্থ্য এবং অ্যালকোহল থেকে শুরু করে মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার, গেইমিং এবং জুয়া সহ বিভিন্ন আসক্তির জন্য লাইসেন্সধারী পরামর্শক হিসাবে পরিচয় দিয়েছেন।

পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলি বলছে, ক্রিপ্টো আসক্তির গভীর মিল রয়েছে জুয়ার সঙ্গে। তার চেয়েও বড় কথা, এটি জুয়ার চেয়েও উত্তেজনাপূর্ণ। কারণ, এটি অসম্ভব অস্থিতিশীল এবং এর ট্রেডিং চলে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টাই।

জুরিখভিত্তিক পুনর্বাসন কেন্দ্র ‘প্যারাসেলসাস রিকভারি’র প্রধান নির্বাহী জ্যান গেবার বলেন, "ক্রিপ্টো ট্রেডিং বৈধ হওয়ার হাওয়া বইছে, অপরদিকে জুয়া নিয়ে আলোচনায় একে বরাবরই সমস্যাজনক হিসাবে দেখা হয়।

ক্রিপ্টো ট্রেডিং মূলত অনিয়ন্ত্রিত হওয়ায় এর সংশ্লিষ্টদের সাহায্য চাওয়ার উদাহরণও কম। অন্যদিকে, কোনো কোনো দেশে নিয়ম করাই আছে যে, ঝামেলা পাকানো জুয়াড়িদের শনাক্ত করতে বা বের করে দিতে হবে; অথবা আসক্তির লক্ষণ দেখা গেলে কী করতে হবে সে বিষয়ে নির্দেশনা এবং দরকারি টুল রয়েছে।

তবে, ক্রিপ্টো আসক্তির লক্ষণ খুব যে আলাদা, এমন নয়।

শুরুতে আমি কেবল কয়েক হাজার পাউন্ড বিনিয়োগ করছিলাম, কিন্তু শেষের দিকে এমনও হয়েছে আমি এক একটি ট্রেডেই লক্ষ লক্ষ পাউন্ড ঢেলেছি।

ক্রিপ্টো ট্রেডিংয়ে যারা আসক্ত ক্রমাগত তারা “জীবনে উত্তেজনা এবং আনন্দের” উৎস হিসাবে এর দিকে ঝুঁকতে শুরু করে বলে উল্লেখ করলেন অ্যারন স্টার্নলিস্ট। স্ত্রী লিনের সঙ্গে তিনি নিউ ইয়র্কভিত্তিক ‘ফ্যামিলি অ্যাডিকশন স্পেশালিস্ট’ পরিচালনা করছেন।

তিনি বলেন, প্রচলিত লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে মিথ্যা বলা, চুরি করা, ঋণগ্রস্ত হওয়া; বিশ্রাম ও ঘুমের সমস্যা এবং সম্পর্ক, ক্যারিয়ার এবং শিক্ষার বিষয়গুলো গোল্লায় দিয়ে সব সময় ক্রিপ্টো মূল্য পর্যবেক্ষণ ও এর পেছনেই লেগে থাকা।

উদাহরণস্বরূপ, ডনের কথা বলা যায়। ২০২২ সালে ক্রিপ্টো মন্দায় ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির বিষয়টি বোঝার পর তার গার্লফ্রেন্ড যখন সম্পর্ক ছিন্ন করে চলে যান, তখনই কেবল  তিনি চিকিত্সার উপায় খুঁজতে শুরু করেন।

লন্ডনের ৩২ বছর বয়সী জেন, (পরিবর্তিত নাম) এক সময় তিন-চার দিন ধরে ক্রিপ্টো “ট্রেডিং উন্মাদনা” চালিয়ে গেছেন। জেন বলেন, ওই কয়দিনের অনুপস্থিতিই তার বয়ফ্রেন্ডের বিশ্বাসে ফাটল ধরায় এবং তিনি ধরে নেন জেনের কোনো গোপন সম্পর্ক আছে।

"আমি কী করছি সেটি তাকে বলতে না পারায় সম্পর্ক আরও খারাপ দিকে মোড় নেয়। যদিও এখন সত্যিটা বেরিয়ে এসেছে, কিন্তু আমাদের সম্পর্ক কখনই আর পুরোপুরি ঠিক হয়নি।

জেন ক্রিপ্টো কিনতে শুরু করেন ২০১৪ সালে। “শুরুতে আমি কেবল কয়েক হাজার পাউন্ড বিনিয়োগ করছিলাম, কিন্তু শেষের দিকে এমনও হয়েছে আমি এক একটি ট্রেডেই লক্ষ লক্ষ পাউন্ড ঢেলেছি।

শেষ পর্যন্ত তিনি ‘প্যারাসেলসাস রিকভারি’র শরণাপন্ন হন। ক্রিপ্টো আসক্তির নিরাময়ে এখানে আছে চার থেকে ছয় সপ্তাহের প্যাকেজ। প্রতি সপ্তাহে খরচ ৮৫ হাজার পাউন্ড পর্যন্ত বা এক লাখ চার হাজার ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় কোটি টাকার ওপরে)। অনলাইন থেরাপিতে  প্রতি ঘণ্টার সেশনে খরচ সাড়ে ছয়শ ডলার। চিকিত্সার মধ্যে রক্ত পরীক্ষা, কাস্টমাইজড ডায়েট প্ল্যান, যোগব্যায়াম, আকুপাংচার এবং প্রয়োজন অনুসারে ওষুধ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তার ভাষায় এটি মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য “৩৬০ ডিগ্রি পদ্ধতি” ।

ক্রিপ্টো আসক্তদের চিকিৎসায় প্রায়ই সীমানা নির্ধারণ করে দিতে হয়। যেমন ট্রেডিং এবং লসের সীমা- একটি নির্দিষ্ট মূল্যে পৌঁছানোর পরে আর লেনদেন করা যাবে না-- এমন নিয়ম। এইসব নিয়ম মেনে চললে অতিরিক্ত ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।

‘দ্য ব্যালেন্সে’র প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী আবদুল্লাহ বোউলাদ বলেন, সেন্টারের থেরাপিস্টরা এই ধরনের সীমানা নির্ধারণে সহায়তা করে। তবে তিনি আরও যোগ করেছেন যে, তারা ক্লায়েন্টদের ‘কোল্ড টার্কি’ বা আসক্তি একেবারে বন্ধ করে দেওয়ার কথা বলেন না, আর পুরোপুরি ডিভাইস বিচ্ছিন্ন থাকারও দরকার হয় না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্রিপ্টো আসক্তি প্রায়শই টের পাওয়া যায় অন্যান্য লক্ষণ দেখে।

কিথ, যিনি তার প্রকৃত নাম প্রকাশ করতে চাননি, বলেন, তিনি আসলে ‘প্যারাসেলসাস রিকভারি’তে গিয়েছিলেন যে ঘুমের ওষুধের উপর অতিরিক্ত নির্ভরতার কারণে। পরে দেখা গেল মূল কারণ ক্রিপ্টো আসক্তি।

৫১ বছর বয়সী কিথ জানান, তিনি ক্রিপ্টো ট্রেডিংয়ে আসক্ত হয়ে পড়েন কোভিড-১৯ লকডাউনের সময়।

“আমরা সবাই বিচ্ছিন্ন ছিলাম। এর ফলে গোপনে ব্যবসা করা সহজ হয়ে যায়।”

“আমার বাচ্চারা যখন ক্রিসমাসে আমার সঙ্গে থাকতে এসেছিল তখনই বুঝতে পারি যে আমি কতটা অনিয়ম করছি। আমি ওদের সঙ্গে চরম বিরূপ আচরণ করছিলাম। আর ওরা ভয় পাচ্ছিল যে আমি টানা কয়েক দিন ধরে ঘুমাচ্ছি কেন।

“অথচ, গোটা সময় ধরে আমরা কেউই ভাবিনি যে, সমস্যার মূলে আমার ক্রিপ্টো ট্রেডিং।”