যেভাবে এআই’র লেখা ভুয়া কলাম ছাপা হল আইরিশ পত্রিকায়

“এটি স্রেফ প্রতারণা। আমরা যার সঙ্গে যোগাযোগ করছিলাম তিনি আসলে ভুয়া পরিচয় দিয়েছেন। আমরা এক পরিকল্পিত প্রতারণার শিকার।”

প্রযুক্তি ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 May 2023, 11:15 AM
Updated : 17 May 2023, 11:15 AM

যে ভয়টি হচ্ছিল এআই আর চ্যাটজিপিটি নিয়ে, সেটিই করে দেখালেন এক শিক্ষার্থী। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে তৈরি করা এক নিবন্ধ মানব লেখকের ধরে নিয়ে মতামত কলামে প্রকাশ করেছে আয়ারল্যান্ডের জাতীয় দৈনিক ‘আইরিশ টাইমস’।

আর এমন কাণ্ডে পরে ক্ষমা চেয়েছে পত্রিকাটি।

‘আইরিশ উইমেন’স অবসেশন উইথ ফেইক ট্যান ইজ প্রবলেমেটিক’ শীর্ষক  নিবন্ধটি প্রকাশ পেয়েছে ১১ মে, বৃহস্পতিবার।

নিবন্ধের ‘লেখক’ আইরিশ নারীদের ‘নকল ট্যান’ (ত্বকের রঙ বাদামী করার জন্য ব্যবহৃত স্প্রে জাতীয় সামগ্রী) ব্যবহারের সমালোচনা করে বলেন, এটি ‘গাঢ় গাত্রবর্ণের ব্যক্তিদের অবমূল্যায়নের পাশাপাশি তাদের পরিচয়কে নিছক ফ্যাশন সামগ্রীর পর্যায়ে নামিয়ে আনে।’

নিবন্ধের শুরুতে ওই লেখকের পরিচয় দেওয়া হয় ‘আদ্রিয়ানা আকোস্তা-কর্তেজ’ নামের এক লাতিন আমেরিকান অভিবাসী নারী হিসেবে, যিনি আয়ারল্যান্ডের উত্তর ডাবলিনে থাকেন বলে দাবি করেন। আর এই পরিচয়পত্রের পাশে এক নীল রঙের চুলওয়ালা নারীর ছবিও ছিল।

“আমার আইরিশ বোনদের বলতে চাই, আপনারা নিজেদের পছন্দ ভেবে দেখার  পাশাপাশি এমন সামাজিক নীতিমালা নিয়ে প্রশ্নও তুলুন। যারা ট্যান করতে ভালোবাসেন, আমি তাদের অপমানিত বা বিচার করার চেষ্টা করছি না। তবে, আমি এ নিয়ে চিন্তাভাবনা ও আলোচনা উস্কে দিতে চাই।” --উল্লেখ রয়েছে নিবন্ধে।

শেষ পর্যন্ত দেখা যায় যে এটি একটি ভুয়া নিবন্ধ ছিল। রোববার এক বিবৃতিতে এই নিবন্ধ প্রকাশের ঘটনাকে ‘মারাত্মক ভুল’ বলে স্বীকার করেন সংবাদপত্রটির সম্পাদক রুয়াধান ম্যাক করমাইক।

তিনি ব্যাখ্যা করেন, বেশ কয়েকদিন ধরেই কলামের লেখক সম্পাদকীয় ডেস্কের সঙ্গে যোগাযোগের পাশাপাশি প্রাসঙ্গিক গবেষণার লিঙ্কও সরবরাহ করেছেন। এ ছাড়াও, নিজের ব্যক্তিগত ঘটনা, এমনকি সম্পাদনার জন্য পর্ষদের পরামর্শও নিয়েছেন। এ বিষয়গুলো সাধারণত এমন ব্যক্তিদের বেলাতেই ঘটে যারা নিজেদের লেখা জাতীয় পর্যায়ে প্রকাশ করতে চান।

এই প্রতিবেদন প্রকাশের ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ে পর আইরিশ টাইমস আবিষ্কার করে– এই কলাম সম্ভবত ভুয়া।

“এখন মনে হচ্ছে নিবন্ধ ও এর সঙ্গে থাকা বাইলাইন ফটো অন্তত আংশিকভাবে জেনারেটিভ এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি।” --বলেন ম্যাক করমাইক।

“এটি স্রেফ প্রতারণা। আমরা যার সঙ্গে যোগাযোগ করছিলাম তিনি আসলে ভুয়া পরিচয় দিয়েছেন। আমরা এক পরিকল্পিত প্রতারণার শিকার।”

ব্রিটিশ সংবাদপত্র ‘ইভিনিং স্ট্যান্ডার্ড’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, সামাজিক প্ল্যাটফর্ম রেডিটে কলামটি ভাইরাল হওয়ার পর আয়ারল্যান্ডের অন্যান্য সংবাদকর্মীও এতে আগ্রহ দেখাতে শুরু করেন।

বাণিজ্য বিষয়ক আইরিশ অনলাইন সাময়িকী ‘দ্য কারেন্সি’র দুই সাংবাদিক বেশ কিছু এআই ফটো বিশ্লেষক’সহ এই বাইলাইন ছবি বিশ্লেষণ করেন। তারা খুঁজে পান, এই ছবি নকল হওয়ার সম্ভাবনা ৯৩ দশমিক আট শতাংশ।

পরবর্তীতে বেশ কয়েকটি প্রকাশনার সংবাদকর্মী আইরিশ টাইমসের মন্তব্য জানতে যোগাযোগ করে। এর পরপরই কলাম সরিয়ে ফেলার পাশাপাশি এটি নিয়ে তদন্ত পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয় সংবাদপত্রটি।

কীভাবে লেখানো হল ওই কলাম

এআই’র মাধ্যমে তৈরি জাল নিবন্ধ লেখার পেছনে থাকা ব্যক্তিটির সঙ্গে কথা বলেছে স্ট্যান্ডার্ড। পাশাপাশি, আইরিশ টাইমস ও তার বিভিন্ন চিঠিও দেখেছে সংবাদপত্রটি।

এর পেছনে থাকা ব্যক্তি আসলে একজন আইরিশ ‘নন-বাইনারি’ স্নাতক ছাত্র, যিনি আয়ারল্যান্ডে নিজের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের শঙ্কায় নিজের পরিচয় গোপন রাখতে চেয়েছেন।

“এই আলোচনাটি হয়েছিল আমার বন্ধুদের সঙ্গে। ফ্যাশনের সাংস্কৃতিক প্রভাব নিয়ে আলোচনার সময় এক তরুণী আমাকে বলেন, এই প্রতিযোগিতা আদতে ব্যক্তির জাতিগোষ্ঠী ও তার গায়ের রঙের ওপর নির্ভর করে। এরপরই আমি  ‘ডেভিল’স অ্যাডভোকেট’ হিসেবে ভূমিকা পালন করে তার নকল ট্যানের বিষয়টি লেখায় তুলে আনি।”

এরপরই ওপেনএআই’র জনপ্রিয় চ্যাটবট চ্যাটজিপিটিকে আয়ারল্যান্ডের ডাবলিনে থাকা এক লাতিন নারীর দৃষ্টিকোণ থেকে ‘কীভাবে নকল ট্যান ফর্সা ত্বকে উচ্চ মেলানিনযুক্ত উপাদান যোগ করছে ও এর চাহিদা বাড়াচ্ছে’, সে সম্পর্কে এক হাজার শব্দের একটি নিবন্ধ লিখতে বলেন ওই ছাত্র।

তিনি আরও বলে দেন, এআই’র উচিৎ ‘আয়ারল্যান্ডে নকল ট্যানিং সংস্কৃতির ওপর জোর দেওয়া ও আইরিশ নারীদের এই বিষয় সম্পর্কে জানানো’।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওই শিক্ষার্থীকে আইরিশ টাইমসের একজন সম্পাদক লেখাটি নিয়ে মতামত ও পরামর্শ পাঠালে তিনি সেটি চ্যাটজিপিটিকে প্রথম লেখাটির ওপর যোগ করে  সংশোধন করতে বলেন। পাশাপাশি, লেখার ধরনকে ‘অনেকটা আলাপচারিতামূলক’ করার কথাও বলেন তিনি।

ছবির বেলায় তারা ইমেজ জেনারেটর ‘ডাল-ই ২’তে ‘নারী, স্থুলকায়, নীল চুল, অফিসের পোশাক, আত্মতৃপ্ত অভিব্যক্তি’ এমন প্রম্পট ব্যবহার করে এক সংবাদকর্মীর ছবি তৈরি করতে বলে।

“আমি বলব, প্রকাশিত লেখার ৮০ থেকে ৯০ শতাংশই এআই’র মাধ্যমে তৈরি।” --ব্যাখ্যা করেন ওই শিক্ষার্থী।

“আইরিশ টাইমস কেবল কয়েকটি ছোট সংশোধন করেই এই নিবন্ধ প্রকাশে এতটা আগ্রহ দেখানোয় আমি হতবাক হয়ে যাই। আর তারা আমার পরিচয় যাচাইয়ের উদ্দেশ্যে ফোনেও যোগাযোগ করেনি।”

তিনি আরও যোগ করেন, তাদের কৌশলে এই নিবন্ধ জমা দেওয়ার একটি কারণ ছিল নিজেদের বন্ধুদের জন্য মজা করা। 

তিনি বলেন, তিনি আদতে জেন্ডার পরিচয়ের রাজনীতি সম্পর্কে জানান দিতে চেয়েছিলেন। আর এগুলো কীভাবে গণমাধ্যম ও অনলাইনে ব্যবহার করে সরকারী নীতি ও অর্থনীতির মতো তুলনামূলক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো থেকে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানো যায়, সেটি দেখানোর উদ্দেশ্যও ছিল।

“এর কোনো সুস্পষ্ট সমাপ্তি আসলে দেখি না। লোভী সরকারের ব্যর্থতা তুলে ধরার বদলে জনগণকে জেন্ডার, জাতি বা যৌনতা নিয়ে লড়াইয়ের এক সহজ টোপ হিসেবে কাজ করে এটি।” --বলেন তিনি।

“এমনকি আইরিশ টাইমসের প্রতিক্রিয়া ও আইরিশ গণমাধ্যমে নিবন্ধটি নিয়ে মূল মনোযোগ ছিল কেবল এআই’র দিকে, আর সম্ভবত ব্যাকগ্রাউন্ড চেকিংয়ে সংবাদপত্রের দুর্বলতা নিয়ে। তারা নিবন্ধের বিষয়বস্তু বেমালুম এড়িয়ে গেছেন ও কীভাবে এটি ব্যবহার করে টুইটারে মানুষের মধ্যে সংঘাত বাধানো হচ্ছে, সে সম্পর্কে কেউই কোনো কথা বলছেন না।”

ওই ব্যক্তি বলছেন, শুক্রবার বিকেলে আইরিশ টাইমসের কাছে দ্বিতীয় নিবন্ধ পাঠানোর পর সংবাদপত্রটি তাদের ফোন নাম্বার চাইলে তারা বুঝতে পারেন, তাদের এই খেলা শেষ।

নিজেদের ফোন নাম্বারের বদলে তারা ডাবলিনের এক ‘ক্লাউন (সং)’ পরিষেবার নাম্বার সরবরাহ করে সংবাদপত্রটির সঙ্গে ইমেইল চালাচালি অব্যাহত রাখলেও প্রকাশনাটির সঙ্গে তারা কোনো কথা বলেননি।

তারা আরও অনুরোধ জানান, তাদের কলাম লেখার ফি যেন কোনো দাতব্য সংস্থায় দান করা হয়।

ওই ব্যক্তির গল্প যাচাইয়ের উদ্দেশ্যে আইরিশ টাইমসের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল স্ট্যান্ডার্ড।

সাংবাদিকতায় কি এআই ব্যবহার করা উচিৎ?

বাস্তবতা হলো, গণমাধ্যম শিল্প এই মুহূর্তে সুবিধাজনক অবস্থানে নেই। তবে, মিডিয়ায় ক্রমাগত পরিবর্তনের এই বিশাল সমুদ্রে কীভাবে সাংবাদিকতা খাতে এআই ব্যবহার করা যেতে পারে তা নিয়ে সম্পাদকরা কাজ করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন।

“সাংবাদিকতার ওপর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সম্ভাব্য বিশাল প্রভাব নিয়ে আমরা সবাই লড়াই করছি।” --স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন যুক্তরাজ্যের ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্ট্যান্ডার্ড অর্গানাইজেশন (ইপসো)’র প্রধান নির্বাহী শারলট দিওয়ার।

“ইপসো’তে, আমরা এই বিষয়ে নিজেদের চিন্তাভাবনার বিকাশ করছি। আর কীভাবে এটি আমাদের নীতিমালার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, তা-ও খতিয়ে দেখছি। তবে, আমরা জানি সম্পাদকীয় দায়িত্ববোধ মূল নীতি হিসেবেই থাকবে: সম্পাদকরা নিজস্ব প্রতিবেদন এবং সম্পাদকীয় মানদণ্ডের কাছে দায়বদ্ধ, ব্যবহৃত প্রযুক্তি নির্বিশেষেই। পাশাপাশি, এটিও সতর্কতার সঙ্গে নিশ্চিত করতে হবে যে তাদের বিভিন্ন কনটেন্ট যেন প্রতিষ্ঠিত সম্পাদকীয় মানদণ্ড মেনে চলে।”

এপ্রিলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে তৈরি নকল নিবন্ধ তৈরি করা নিয়ে বেশ কিছু শিক্ষার্থী ও গবেষক ব্রিটিশ সংবাদপত্র ‘দ্য গার্ডিয়ান’-এর সঙ্গে যোগাযোগ করার পর এআই সম্পর্কে এক বিবৃতি প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেয় সংবাদপত্রটি।

তারা সাহিত্য পর্যালোচনায় সহায়ক হিসেবে চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করেছেন। সে সময় এআই তাদের আকর্ষণীয় শব্দওয়ালা গার্ডিয়ানের কিছু শিরোনামও উদাহরণ হিসাবে দেখায় যেগুলো ভাল মানের উদাহরণ হতে পারে। সমস্যা হল, ওই শিরোনামের কোনো লেখা খুঁজে পাওয়া যায়নি।

গার্ডিয়ানের কর্মীরা বুঝতে পারেন, চ্যাটজিপিটি আসলে গার্ডিয়ানকে নকল করে বানানো শিরোনামের পরামর্শ দিচ্ছিল, যা একেবারে সংবাদপত্রটির নিজস্ব সংবাদকর্মীদের লেখার মতোই দেখায়।

গার্ডিয়ানের ‘এডিটোরিয়াল ইনোভেশন’ বিভাগের প্রধান ক্রিস মোরান বলেন, সংবাদপত্রটি এমন এক দল তৈরি করেছিল, যারা এই প্রযুক্তি সম্পর্কে শেখার পাশাপাশি ‘সাংবাদিকতায় জেনারেটিচভ এআই ব্যবহার করলে তা কীভাবে কাজ করবে’, সে সম্পর্কে বিভিন্ন শিক্ষাবিদ, অন্যান্য সংস্থা ও নিজস্ব কর্মীদের কাছে পরামর্শ নিচ্ছিল।

তিনি আরও বলেন, সংবাদপত্রটি এখনও এই প্রযুক্তি সম্পর্কে নিশ্চিত নয়।

“এই কার্যক্রম পরিচালনায় জেনারেটিভ এআই’র সম্ভাব্য ব্যবহার সম্পর্কে জিজ্ঞাসার পাশাপাশি আমরা সাংবাদিকতার পেছনের কারণ ও এর মূল্য সম্পর্কেও জানতে পেরেছি।”

“আমরা এর সম্ভাবনা নিয়ে আনন্দিত। তবে, এটি সম্পর্কে বোঝা, মূল্যায়ন ও বিস্তৃত বিশ্বে এর সম্ভাব্য প্রভাব ডিকোড করা নিশ্চিতভাবেই আমাদের প্রথম কাজ।”