গেইমিং ডিসর্ডারের মতো ডিজিটাল আসক্তিকে স্বীকৃতি দেয়নি ‘এনএইচএস’ বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউএইচও)।
Published : 09 Feb 2024, 03:04 PM
বিভিন্ন ডিজিটাল যন্ত্র বা সেবায় আসক্তিকে এখনও স্বীকৃতি দেয় না ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’ বা কোনো সরকারি কর্তৃপক্ষ। ফলে, ইন্টারনেটের অতিরিক্ত ব্যবহারে কারো জীবনে বিপর্যয় নেমে এলে সাহায্যের জন্য কোথায় যাবেন তিনি?
ইন্টারনেট আসক্তি প্রসঙ্গে ১২ ধাপের একটি প্রোগ্রামে অংশ নেওয়া তিনজনের সঙ্গে কথা বলেছে বিবিসি।
“বাইরে যাওয়ার চেয়েও নেটে আমার ভাল লাগত, মা ও বাবার সঙ্গে কথা বলার চেয়ে ভাল লাগত, আঁকার চেয়েও ভাল লাগত।”
ঠিক এভাবেই যুক্তরাজ্যের ওয়েস্ট অক্সফোর্ড কমিউনিটি সেন্টারের একটি ছোট কক্ষে, ১৯ বছর বয়সী সোফিয়া প্রযুক্তির সঙ্গে তার এক দশকের ধ্বংসাত্মক সম্পর্ক বর্ণনা করেছেন।
পূর্ব এশিয়ার একটি বস্তিতে জন্ম নেওয়া সোফিয়া ছোটবেলায় তার বাবা-মায়ের সঙ্গে যুক্তরাজ্যে আসেন। অক্সফোর্ডশায়ারে তার প্রথম বছরগুলো নিঃসঙ্গ ছিল। তিনি বলেন, সে সময়ে ডিভাইসগুলোকেই তার বন্ধুর মতো মনে হতো।
“আমি তখনও ইংরেজি ভালভাবে শিখিনি। তা ছাড়া, আমি একা ছিলাম, বঞ্চিত ছিলাম। সে সময় ইন্টারনেট ছিল এক নিখুঁত জিনিস, সেই সময়ে আমার যা দরকার ঠিক তাই পেতাম এতে। ইন্টারনেট নিয়ে একা থাকাই বরং আরামের ছিল।”
সোফিয়া বলেন তিনি ১৫ বছর বয়সেই সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করা ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু তার ব্যবহারের ইচ্ছে কমেনি।
তার পরিবারকে দারিদ্র্য থেকে তুলে আনার স্বপ্ন নিয়ে সোফিয়া দৈনিক ১৬ ঘন্টা করে আত্ম উন্নয়ন ও অর্থ আয় বিষয়ক কনটেন্ট সংশ্লিষ্ট প্রায় ১০ হাজারেরও বেশি ভিডিও দেখেন।
“আমার সম্পর্কগুলো একেবারে তালগোল পাকানো ছিল। বলার মতো কিশোর বয়সের কোনো স্মৃতি আমার কাছে নেই। পড়ালেখা গোল্লায় যাচ্ছিল, আত্মহত্যার ভাবনাও ঘিরে ধরত আমাকে।”
২০২৩ সালে ‘ইন্টারনেট অ্যান্ড টেকনোলজি অ্যাডিক্টস অ্যানোনিমাস’ (আইটিএএ) প্রগ্রামের সাহায্য চেয়েছেন সোফিয়া। এটি ‘অ্যালকোহলিকস অ্যানোনিমাস’ (আইটিএএ) দলে ব্যবহার হওয়া ১২ পদক্ষেপের মডেলের ওপর ভিত্তি করে তৈরি একটি পুনরুদ্ধার প্রোগ্রাম।
আইটিএএ "স্ব-নির্ভর ব্যক্তিদের একটি কমিউনিটি" হিসেবে নিজেদের পরিচয় দেয়। এটি গঠিত হয় ২০১৭ সালে। এখানে বিশ্বজুড়ে সদস্যরা একক স্পনসরশিপ (সরাসরি সাহায্য), ব্যক্তিগত বৈঠক এবং অনলাইনের মাধ্যমে একে অপরকে সাহায্য করেন।
যেসব ডিজিটাল আসক্তি নিয়ে এ দলটি কাজ করে তার মধ্যে রয়েছে সামাজিক মাধ্যম, ভিডিও স্ট্রিমিং, অনলাইন সংবাদ, ডেইটিং সাইট, পর্নোগ্রাফি, গেইমিং ও অনলাইন গবেষণা।
যুক্তরাজ্যের লন্ডন ও অক্সফোর্ডেই কেবল এমন দুটি ব্যক্তিনির্ভর সমর্থন কমিউনিটি রয়েছে। আরেকোটি দ্রুতই ম্যানচেস্টারে হবে বলে প্রতিবেদনে লিখেছে বিবিসি।
অক্সফোর্ড আইটিএএ-এর সোফিয়া ও অন্য দুই সদস্য, অ্যাবি ও ম্যাগি, কীভাবে ইন্টারনেট ব্যবহার তাদের জীবনকে প্রভাবিত করেছে তা জানিয়েছেন বিবিসিকে।
অ্যাবি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার পরেই স্ট্রিমিং পরিষেবাগুলোতে আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন তিনি। সারা দিন-রাত এগুলো ব্যবহার করতেন, এমনকি খেতে বা ঘুমাতেও ভুলে যেতেন।
“ব্যবহার করা থালাবাসন সপ্তাহের পর সপ্তাহ স্তুপ হয়ে থাকত।”
ম্যাগি বলেন, ইন্টারনেট ছিল তার “পছন্দের নেশা”। যে কোনো নতুন কাজের চাপ বরং আরও দীর্ঘ সময়ের জন্য তাকে ভিডিও কনটেন্টে আশক্ত করে তুলত।”
“আমি হঠাৎ করেই একদিন কাজে যাইনি। কাজের জন্য তৈরি হলেও ফের বিছানায় গিয়ে ইউটিউব দেখা শুরু করি। এটি আমাকে হতবাক করে দেয়। সত্যিই আমি অবাক হয়েছিলাম।”
পরে তিনি তার ম্যানেজারের কাছে শপথ করেছিলেন যে এমনটি আর হবে না। কিন্তু পরের সপ্তাহে চার দিন একই কাজ করলে চাকরি হারান ম্যাগি।
তাদের ইন্টারনেট ব্যবহারের ব্যাপকতা নিয়ে তিন জনই সাহায্য খুঁজছিলেন। তবে, বিভিন্ন মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবা, মানসিক চাপ সংক্রান্ত কোর্স ও আসক্তির ওপর ইন্টারনেট গবেষণা, কোনোকিছুই ইন্টারনেট ব্যবহারের ইচ্ছে নিবারণে খুব বেশি কিছু করতে পারেনি বলে প্রতিবেদনে লিখেছে বিবিসি।
ম্যাগি বলেন তিনি মরিয়া হয়েই একটি ‘নারকোটিক্স অ্যানোনিমাস’ বা মাদক দ্রব্য আসক্তির মিটিংয়েও চলে গিয়েছিলেন।
“হঠাৎ করেই আমি এমন মানুষদের একটি ঘরে চলে গিয়েছিলাম, যেখানে আমি ইউটিউব বদলে ‘মাদক’ শব্দটি ব্যবহার করলেই তাদের গল্পের সঙ্গে মিলে যেতে পারতাম। হুবহু একই প্যাটার্ন।” – বলেন তিনি।
ইন্টারনেটে আসক্ত হওয়ার বিষয়টি “প্রায় ইন্টারনেটের মতোই পুরানো।” তবে, এর একটি “সর্বজনীন, বাস্তবসম্মত একটি সংজ্ঞা”র অভাব ছিল। – বিবিসিকে বলেন বোর্নেমাউথ ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক জন ম্যাকঅ্যালানি।
“বর্তমানে যুক্তরাজ্যে কোনো বিশেষ ধরনের ডিজিটাল আসক্তির খুব সুনির্দিষ্ট সমাধান দেওয়া কঠিন হবে। তবে, বেশিরভাগ চিকিৎসক, মনোবিজ্ঞানী ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বুঝতে পারবেন যে কারো সমস্যা হচ্ছে কি না," বলেন ম্যাক অ্যালানি।
গেইমিং ডিসর্ডারের মতো ‘ডিজিটাল আসক্তিকে’ স্বীকৃতি দেয়নি ‘এনএইচএস’ বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউএইচও)। গেইমিং ডিসঅর্ডার আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি পায় ২০২২ সালে।
যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে বড় বেসরকারি মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবা কোম্পানি ‘প্রায়রি’ বিবিসিকে বলেছে, ২০২০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে তাদের কাছে সেবা নিয়ে অনুসন্ধান দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। এসব পরিষেবার মধ্যে রয়েছে গেইমিং, ইন্টারনেট, সামাজিক মাধ্যম, জুয়া ও পর্নগ্রাফি আসক্তি।
সোফিয়া, অ্যাবি এবং ম্যাগি সকলেই এখন তাদের অবস্থা থেকে পুনরুদ্ধারের বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছেন বলে লিখেছে বিবিসি। তারা বলেছেন আইটিএএ-এর অনলাইন ও সরাসরি মিটিংগুলো তাদের জীবন বদলে দেওয়ার মতো ছিলI
"আমার শুধু মনে আছে, বেশিরভাগ মিটিং জুড়েই খুব কেঁদেছি,” বলেন অ্যাবি ।
"কারণ তারা আমার গল্প শুনছিল, সেখানে আমার মতো মানুষ ছিল। আমি আগে কাউকে এমন অভিজ্ঞতা বলতে শুনিনি।”
আইটিএএ-এর ১২ তম পদক্ষেপে বলা আছে “এই বার্তাটি ইন্টারনেট ও প্রযুক্তি আসক্তদের কাছে পৌঁছে দিন”। সে অনুসারে, অ্যাবি ও ম্যাগি অক্সফোর্ডে একটি সরাসরি সহায়তা দল গঠন করেছেন৷
পাশাপাশি, অ্যাবি এখন ভিডিও সাইট ও টিভি থেকে দূরে থাকেন। ম্যাগি অনলাইনে প্রবেশের জন্য লাইব্রেরির কম্পিউটার ব্যবহার করেন। আর সোফিয়ার ইন্টারনেট ব্যবহারের প্রয়োজন হলে তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখেন তার স্পন্সর (বা সহায়ক)।
সোফিয়া, অ্যাবি ও ম্যাগি পরিচয় গোপন রাখার জন্য ছদ্মনাম ব্যবহার করেছেন বলে প্রতিবেদনে লিখেছে বিবিসি।