অ্যান্টার্কটিকার বরফের বিশাল চাদর যদি সম্পূর্ণভাবে গলে যায় তবে তা গোটা বিশ্বে সমুদ্রের স্তর প্রায় ২০০ ফুট (৬০ মিটার) বাড়িয়ে তুলতে পারে।
Published : 01 Sep 2024, 11:35 AM
আলাস্কার উত্তরে ‘বিউফোর্ট’ সাগরের বরফগলা পানিতে জড়ো হয়েছেন নাসা’র ‘জেট প্রোপালশন ল্যাবরেটরি (জেপিএল)’-এর একদল প্রকৌশলী। তাদের সামনেই বরফ ভেদ করে সোজা নিচে নেমে গেছে বরফ কেটে তৈরি করা এক সুরঙ্গ।
সেই সুরঙ্গ দিয়ে তারা নামিয়ে দিলেন নলাকার এক রোবট। সেটি সোজা চলে গেল হিমশীতল সমুদ্রের নীচে।
এই কার্যক্রম ছিল ‘আইসনোড’ নামের একটি প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ এক পদক্ষেপ, যার লক্ষ্য হচ্ছে অ্যান্টার্কটিকার রহস্যময় ও গলে যাওয়া বরফের বিভিন্ন তাক থেকে তথ্য সংগ্রহ করার জন্য স্বচালিত রোবটের একটি বহর তৈরি করা।
সুরঙ্গ দিয়ে নিচে পাঠিয়ে দেওয়া এই রোবটটিই ছিল মেরু অঞ্চলে বরফের গভীরে অনুসন্ধান চালাতে সক্ষম নাসার ‘আন্ডার ওয়াটার’ রোবট।
আইসনোডের মূল লক্ষ্য হল অ্যান্টার্কটিকার বরফ কত দ্রুত গলে যাচ্ছে সেটি হিসাব করা ও এর ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে এটি কতটা ভূমিকা রাখতে পারে সেটি জানা।
অ্যান্টার্কটিকার বরফের বিশাল চাদর যদি সম্পূর্ণভাবে গলে যায় তবে তা গোটা বিশ্বে সমুদ্রের স্তর প্রায় ২০০ ফুট (৬০ মিটার) বাড়িয়ে তুলতে পারে বলে প্রতিবেদনে লিখেছে বিজ্ঞানভিত্তিক সাইট নোরিজ। এর সহজ ব্যাখ্যা হলো, সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চল চলে যাবে প্রায় ২০ তলা সমান পানির নিচে।
এর গভীর প্রভাব পড়বে বিশ্বের উপকূলীয় অঞ্চলে। বিজ্ঞানীরা এরইমধ্যে জানেন, সমুদ্রের পানির তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া এই গলনের একটি প্রধান কারণ। তবে এটি কত দ্রুত ঘটছে তা ভবিষ্যদ্বাণী করার জন্য তাদের আরও তথ্য জানা প্রয়োজন।
অ্যান্টার্কটিকার বরফ গবেষণার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে একটি হল– বরফ গলনের ঘটনা সবচেয়ে দ্রুত যেসব অঞ্চলে ঘটে, সেখানে মানুষের পৌঁছানো অবিশ্বাস্যরকম কঠিন।
এর মধ্যে রয়েছে পানির নীচের কিছু অঞ্চল, যেখানে ভাসমান বরফের বিভিন্ন তাক, যেটি সমুদ্রের তলদেশ লাগোয়া।
‘গ্রাউন্ডিং জোন’ নামে পরিচিত এই অঞ্চলটি প্রায়শই মাইলের পর মাইল বরফের নিচে ঢাকা থাকে, যেখানে মানুষের পক্ষে পৌঁছানো প্রায় অসম্ভব। বিভিন্ন কৃত্রিম স্যাটেলাইটও পানির নীচের এইসব গহ্বর দেখতে পারে না। তাহলে সমাধান কী?
এখানেই আইসনোড-এর প্রয়োজন। জেপিএল’-এর প্রকৌশলীরা প্রায় ৮ ফুট (২.৪ মিটার) লম্বা ও ১০ ইঞ্চি (২৫ সেন্টিমিটার) ব্যাসের রোবট তৈরি করছেন।
এসব রোবট ডিজাইন করা হয়েছে বরফের তাকের গভীরে পাঠানোর জন্য ও সমুদ্রের গরম পানি কীভাবে বরফ গলাতে ভূমিকা রাখছে সে সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করতে। এসব রোবটের তিন পাওয়ালা ‘ল্যান্ডিং গিয়ার’ রয়েছে, যা এদের বরফের নীচের অংশে যুক্ত হতে সহায়তা করে, যেখানে পৌঁছে এরা বরফ গলে যাওয়ার প্রক্রিয়াটি পর্যবেক্ষণ করতে পারে।
কোনও প্রপালশন সিস্টেম নেই এসব রোবটে। এর পরিবর্তে উন্নত সফটওয়্যার ব্যবহার করা হয়েছে এতে, যা এদের নির্ধারিত স্থানে পৌঁছানোর জন্য সমুদ্রের বিভিন্ন স্রোতের মধ্য দিয়ে চলতে সহায়তা করে। একবার সেখানে পৌঁছে গেলে এসব রোবট নিজেদের ‘ব্যালাস্ট’টি ফেলে দেয়, যা এদের উপরের দিকে উঠতে ও সেখানের বরফের সঙ্গে যুক্ত হতে সাহায্য করে।
এরপরে এরা পরিমাপ করে গরম ও লবণাক্ত সমুদ্রের পানি বরফের সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগ করে এবং ঠাণ্ডা ও গলে যাওয়া পানি কেমন আচরণ করে।
এক বছর পর্যন্ত কাজ করতে পারবে এসব আইসনোড রোবট। এভাবেই ডিজাইন করা হয়েছে এদের। ঋতু পরিবর্তনের তথ্য’সহ এখানকার তথ্য ক্রমাগত সংগ্রহ করবে এরা। মিশন শেষ হওয়ার পর রোবটগুলো বরফ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে খোলা সমুদ্রের দিকে উঠে আসবে ও কৃত্রিম স্যাটেলাইটের মাধ্যমে এরা বিজ্ঞানীদের কাছে জোগাড় করা তথ্য পাঠাবে।
২০২৪ সালের মার্চ মাসে বিউফোর্ট সাগরে পরিচালিত এ সাম্প্রতিক পরীক্ষাটি প্রথমবারের মতো কোনো মেরু পরিবেশে প্রোটোটাইপ পরীক্ষা করেছে।
পরীক্ষাটি মার্কিন নৌবাহিনীর ‘আর্কটিক সাবমেরিন ল্যাবরেটরির আইস ক্যাম্প’-এর অংশ ছিল। এটি তিন সপ্তাহের এই অপারেশন গবেষকদের কঠোর আর্কটিক পরিস্থিতিতে কাজ করার ভরসা দিচ্ছে, যেখানে তাপমাত্রা নেমে আসে মাইনাস মাইনাস ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে।
পরীক্ষার সময় সমুদ্রের প্রায় ৩৩০ ফুট (১০০ মিটার) গভীরতায় নেমে এসে রোবটটি লবণাক্ততা, তাপমাত্রা ও পানি প্রবাহের তথ্য সংগ্রহ করেছে। ভবিষ্যতের অবিচ্ছিন্ন মিশনের জন্য রোবটটিকে প্রস্তুত করার লক্ষ্যে এর উন্নয়নের বিভিন্ন বিষয়ও চিহ্নিত করেছেন গবেষকরা।
“আমরা যে অগ্রগতি করেছি তাতে আমরা সন্তুষ্ট। আমাদের লক্ষ্য– এইসব প্রোটোটাইপের বিকাশ চালিয়ে যাওয়া, আর্কটিকে আরও পরীক্ষা করা ও অবশেষে অ্যান্টার্কটিক বরফের তাকের নীচে রোবটের একটি সম্পূর্ণ বহর তৈরি করা,” বলেছেন ‘জেপিএল-এর রোবোটিক্স প্রকৌশল ও আইসনোড-এর প্রধান অনুসন্ধানকারী পল গ্লিক।