প্রস্তাবটিতে যথেষ্ট ভাষাগত পরিমার্জন করা না হলে বিভিন্ন সরকার একে ব্যবহার করে অধিকার কর্মী, সাংবাদিক এবং সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে নির্যাতনের সুযোগ পাবে।
Published : 27 Aug 2023, 08:38 PM
সাইবার অপরাধ ঠেকাতে আন্তর্জাতিকভাবে প্রয়োগযোগ্য এক চুক্তি শেষ পর্যন্ত “বৈশ্বিক নজরদারির অস্ত্রে” পরিণত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি করবে বলে সমালোচনার মুখে পড়েছে।
গৃহীত হলে এই চুক্তির মাধ্যমে ডেটা প্রাইভেসি এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটবে, জাতিসংঘের প্রতিনিধিদলের কাছে এমন আশংকা প্রকাশ করেছেন অধিকারকর্মীরা।
অনলাইন অপরাধকে সংজ্ঞায়িত করতে এবং ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক সংকট নিরসনে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বাড়াতে জাতিসংঘের খসড়া সাইবার অপরাধ চুক্তিটি নিয়ে গত দুবছর ধরে আলোচনা চলছে।
প্রাথমিকভাবে এই চুক্তিটির প্রস্তাব দেয় রাশিয়া, যাতে সমর্থন দেয় চীন, উত্তর কোরিয়া, ইরান, ভেনেজুয়েলা এবং নিকারাগুয়া। আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন ব্যবহার করে চুক্তিটির মাধ্যমে শাসকগোষ্ঠী বিভিন্ন দেশে নজরদারি চালানোকে বৈধ প্রমাণের চেষ্টা করবে, একইসঙ্গে অনলাইনে মতপ্রকাশকে অপরাধ সাব্যস্ত করে দমন পীড়নের অস্ত্র হিসাবে এর অপব্যবহার হবে – এমন আশংকা প্রকাশ করেছে বেশ কিছু দেশের সরকার এবং মানবাধিকার কর্মীরা।
সোমবার ম্যানহাটনে জাতিসংঘ সদরদপ্তরে খসড়া চুক্তিটির ষষ্ঠ পর্যালোচনা সভা শুরু হয়, আগামী ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রতিনিধিদল একে পুনর্মূল্যায়ন করবেন।
খসড়া প্রস্তাবটিতে যথেষ্ট ভাষাগত পরিমার্জন করা না হলে বিভিন্ন সরকার একে ব্যবহার করে অধিকার কর্মী, সাংবাদিক এবং সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে নির্যাতনের সুযোগ পাবে। বিশেষ করে কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রগুলোতে মতপ্রকাশ এবং প্রাইভেসিকে অপরাধ হিসাবে গণ্য করে বিরোধী শক্তিগুলোকে দমন পীড়ন করা হয়। – বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে আশংকা প্রকাশ করেন মানবাধিকার ও ডিজিটাল প্রাইভেসি অধিকার কর্মীরা।
“এই হচ্ছে আমাদের পরিস্থিতি।” – বলেন ইলেকট্রনিক ফ্রন্টিয়ার ফাউন্ডেশনের (ইএফএফ) বৈশ্বিক প্রাইভেসি নীতিমালা পরিচালক কাতিৎজা রদ্রিগেজ । “কনটেন্টের মধ্যে হস্তক্ষেপ এবং রিয়েল টাইমে মেটাডেটার গতিবিধি অনুসরণের মতো বড় পরিসরে অনধিকার নজরদারি চালাতে সরকারগুলোকে আইনি বৈধতা দেবে এই খসড়া চুক্তিটি। সেইসঙ্গে বড় কোনো অপরাধে যে কোনো ধরনের তদন্ত করতে বিদেশি সরকারগুলোর ওপর সুরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণের ন্যূনতম কোনো বাধ্যবাধকতা থাকছে না।”
বিশেষতঃ প্রস্তাবিত নীতিমালা অনুসারে পুলিশকে বিদেশি কোনো সরকারকে এমন সব তদন্তে সাহায্য করতে হবে যা দুই দেশের কোনোটিতেই শাস্তিযোগ্য অপরাধ নয়, বলে ব্যাখ্যা করেন তিনি।
“ডুয়াল ক্রিমিনালিটি প্রিন্সিপাল বা দুই দেশের আইন অনুযায়ী অপরাধ হিসাবে স্বীকৃত না হলে বন্দী বিনিময় করা যাবে না, এমন বিধান মানবাধিকারের রক্ষা কবচ, এমনকি সে ক্ষেত্রেও তা ঐচ্ছিক।” – বলেন রদ্রিগেজ। “বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার সুরক্ষিত করতে হলে প্রস্তাবিত চুক্তিতে ডুয়াল ক্রিমিনালিটির উল্লেখ থাকতে হবে।”
নজরদারির পূর্বে বিচার বিভাগের অনুমোদনের উল্লেখ থাকতে হবে চুক্তিটিতে, এমন দাবি জানিয়েছে ইএফএফ। সেইসঙ্গে ডেটা সংগ্রহের উদ্দেশ্য সীমিতকরণ এবং বৈধভাবে কতটা ডেটা সংগ্রহ করা যাবে সে সীমা নির্ধারণের মাধ্যমে ডেটা সুরক্ষার নুন্যতম মানদণ্ড স্থির করার দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি।
চুক্তিটির অনুচ্ছেদ ১৭ এর ভাষাগত অস্পষ্টতা উল্লেখযোগ্যভাবে আশংকাজনক, কারণ এর মাধ্যমে অনলাইনে পোস্ট করা যে কোনো বক্তব্যকে অপরাধ হিসাবে চিহ্নিত করে কাউকে শাস্তি দেওয়ার সুযোগ পাবে সরকারগুলো। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের জ্যেষ্ঠ গবেষক, প্রযুক্তি ও মানবাধিকার কর্মী ডেবোরা ব্রাউন।
“ঠিক কী কী বিষয় সাইবার অপরাধ হিসাবে গণ্য হবে, আর কী কী বিষয় হবে না, তা স্পষ্ট করতে ব্যার্থ হয়েছে খসড়া চুক্তিটি।” বলেন ব্রাউন। “এই অস্পষ্টতাকে কাজে লাগিয়ে সরকারগুলো তাদের ইচ্ছামতো আইন বানিয়ে সাইবার অপরাধকে সংজ্ঞায়িত করবে। অনেক সরকারের কাছেই তা অনলাইনে বিরোধীদের প্রাইভেসি ভঙ্গ করা এবং ডিজিটাল নজরদারি বৃদ্ধির সমার্থক।”
এই খসড়ার ভাষাগত দুর্বোধ্যতাকে ব্যবহার করে অনেক দেশে এলজিবিটিকিউ+ জনগোষ্ঠীকে নিপীড়ন করা হতে পারে, বিশেষ করে অল্প বয়েসীদের, এবং সেক্ষত্রে সাইবার অপরাধ আইনকে ব্যবহার করা হতে পারে। বলেন অনুচ্ছেদ ১৯ নিয়ে আলোচনায় অংশ নেওয়া মানবাধিকার আইনজীবি কেরি শেঙ্কম্যান।
“গ্রাইন্ডারে (এলজিবিটি কমিউনিটির ডেটিং অ্যাপ) পোস্ট দিয়েছে মিসরের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী” পুলিশ ফেইক অ্যাকাউন্ট দিয়ে ফাঁদ পাঁতছে, বলেন শেঙ্কম্যান। “জার্ডানের সাইবার অপরাধ আইন এলজিবিটি সম্প্রদায়কে শিকার বানাচ্ছে। ব্যাক্তি স্বাধীনতাকে অপরাধ সাব্যস্ত করে সাইবার-অশ্লীলতা হিসাবে শাস্তি দিচ্ছে উগান্ডা সরকার। ‘সমকামিতা এবং লিঙ্গ পরিবর্তন’ থাকার কারণে বার্বি সিনেমাকে নিষিদ্ধ করেছে লেবানন।”