এ অভিষেক অনুষ্ঠান কেবল নতুন প্রেসিডেন্টর শপথ গ্রহণ নয়, বরং কর্পোরেট স্বার্থ ও আমেরিকান কর্তৃত্ববাদের মধ্যে একটি সংমিশ্রণের জন্ম দিয়েছে।
Published : 21 Jan 2025, 04:31 PM
সোমবার বাংলাদেশ সময় রাত ১১টায় যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন ৭৮ বছর বয়সী ডনাল্ড ট্রাম্প।
এদিন সকালে ওয়াশিংটন ডিসির সেন্ট জনস চার্চে একসঙ্গে বসে থাকা ফেইসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ, অ্যামাজন প্রধান জেফ বেজোস, অ্যাপল সিইও টিম কুক ও গুগল প্রধান সুন্দার পিচাইয়ের মতো কোটিপতি টেক প্রধানরা ফিসফিস করে কী প্রার্থনা করেছিলেন তা কেউই জানতে পারবে না।
প্রথমে তারা ডনাল্ড ট্রাম্পের প্রাক-উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গির্জার প্রার্থনায় একসঙ্গে হন। তারপরে টেসলা ও স্পেসএক্স সিইও ইলন মাস্ক, ওপেনএআই প্রধান স্যাম অল্টম্যান ও টিকটক প্রধান শ’ জি চিউয়ের সঙ্গে ক্যাপিটল অনুষ্ঠানে যোগ দেন তারা।
এভাবেই সোমবার ট্রাম্পের অভিষেক অনুষ্ঠানে ক্ষমতার কাছে প্রযুক্তি প্রধানরা “হাঁটু গেড়ে বসেছিলেন” বলে প্রতিবেদনে লিখেছে ব্রিটিশ দৈনিক ইন্ডিপেনডেন্ট।
প্রতিবেদন বলছে, এদের ক্ষমতা সম্পর্কে চিন্তা করলে অবাক হবেন। গোটা বিশ্বে প্রতিদিন আনুমানিক তিনশ ৩০ কোটি ব্যবহারকারীর কথোপকথন নিয়ন্ত্রণ করে ফেইসবুকের মূল কোম্পানি মেটা, যা বিশ্বের পুরো জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশের আলাপ।
অন্যদিকে অ্যামাজন পশ্চিম বিশ্বে সবচেয়ে বড় খুচরা বিক্রেতা ও এর পঞ্চম বড় চাকরিদাতা, যেটি ছোট বিক্রেতাদের বাজার বিশ্বজুড়ে নিয়ন্ত্রণ করে।
এদিকে, অ্যাপল দেড়শ কোটি আইফোন ব্যবহারকারীর ডিজিটাল জীবন দেখভাল করে, যেখানে স্পেসএক্স মানুষের মহাকাশ ভ্রমণ ও এআইয়ের ভবিষ্যত গঠন করে চলেছে ওপেনএআই।
বলাই বাহুল্য, এসব প্রযুক্তি প্রধানরা যথেষ্ট স্মার্ট ও বুদ্ধিমান। তারা এ অনুষ্ঠানে যা দেখছেন তা খুব ভালো করেই বুঝতে পারছেন। এ অভিষেক অনুষ্ঠান কেবল নতুন প্রেসিডেন্টর শপথ গ্রহণ নয়, বরং কর্পোরেট স্বার্থ ও আমেরিকান কর্তৃত্ববাদের মধ্যে একটি সংমিশ্রণের জন্ম দিয়েছে।
আর এই পুরো গল্পটি বুঝতে হলে গত কয়েকদিনে টিকটককে ঘিরে কী ঘটেছে তা জানতে হবে। সুপ্রিম কোর্ট শুক্রবার এক নতুন আইন বহাল রাখে, যার ফলে চীনা মূল কোম্পানি বাইটড্যান্স টিকটকে তাদের অংশীদারত্ব ছয় মাসের মধ্যে কোনো আমেরিকান কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দেবে, নয়ত যুক্তরাষ্ট্রে এ অ্যাপ নিষিদ্ধ করা হবে।
নির্ধারিত সময়ের আগেই শনিবার রাতে ব্যববহারকারীদের জন্য সেবা যুক্তরাষ্ট্রে বন্ধ করে দেয় টিকটক। তবে রোববার সকালের দিকে নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প টিকটক নিষিদ্ধের সময়সীমা বাড়ানোর প্রতিশ্রুতির দেওয়ার পর জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটি আবার চালু করে টিকটক। সোমবার অভিষেকের সময় ট্রাম্পের মনোনীত জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার পরিচালক তুলসী গ্যাবার্ডের পাশেই বসেছিলেন টিকটকের সিইও চিউ।
ইন্ডিপেনডেন্ট লিখেছে, টিকটকের বিরুদ্ধে মামলাটি মার্কিন জনগণের পক্ষে প্রমাণ বা অস্বীকার করা সবসময়ই অসম্ভব ছিল। আমাদের পক্ষে নিশ্চিতভাবে জানা সম্ভব নয় যে, এর চীনা মালিক কোম্পানি বাইটড্যান্স কখনও গোপনে চীন সরকারের কাছে আমেরিকানদের ডেটা পাঠিয়েছে কি না। যদিও টিকটক এমন অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করেছে।
রোববার দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুসারে সোমবার জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টিকটকের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ ৭৫ দিন পিছিয়ে নতুন এক নির্বাহী আদেশে সই করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প।
ট্রাম্প বলেছেন, গত বছর কংগ্রেসে পাস হওয়া ও সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের স্বাক্ষরিত টিকটক নিষিদ্ধ বা মালিকানা বিক্রির আইনটি ওই সময়ের মধ্যে কার্যকর করবে না যুক্তরাষ্ট্র।
এর আগে, ২০২৪ সালের ২৪ এপ্রিল ‘প্রটেকটিং আমেরিকানস ফ্রম ফরেন অ্যাডভারসারি কন্ট্রোলড অ্যাপলিকেশন অ্যাক্ট’ নামের একটি বিলে সই করে তা আইনে পরিণত করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
ওভাল অফিসে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ট্রাম্প বলেছেন, “আমি আপনাদের বলছি, প্রত্যেক ধনী ব্যক্তিই আমাকে টিকটকের বিষয়ে ফোন করেছেন।”
২০২০ সালে টিকটককে নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন ট্রাম্পও। তবে প্লাটফর্মটি নিয়ে তার মন হঠাৎ কেন পরিবর্তন হয়েছে সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের জবাবে ট্রাম্প বলেছেন, “কারণ আমি প্লাটফর্মটি ব্যবহার করেছি।”
ইন্ডিপেনডেন্ট লিখেছে, আসলে বিষয়টি স্পষ্ট নয় যে ট্রাম্পের টিকটককে এক্সটেনশন দেওয়ার আইনী অধিকার আছে কি না। আইন অনুসারে, তাকে কংগ্রেসকে দেখাতে হবে প্লাটফর্মটি বিক্রি বন্ধের দিকে ‘অগ্রগতি’ হয়েছে ও এর ‘বাধ্যতামূলক আইনি চুক্তি’ রয়েছে। যার কোনওটিই সত্য বলে মনে হচ্ছে না। গণতন্ত্রে এই জাতীয় তথ্য গুরুত্বপূর্ণ হলেও স্বৈরশাসনে এগুলোর গুরুত্ব খুবই কম।
এদিকে, টিকটকের বিদেশী মালিকানা বিষয়টিকে বিশেষভাবে দুর্বল করে তুললেও এর আমেরিকান প্রতিদ্বন্দ্বীরাও ট্রাম্পের সঙ্গে একমত পোষণ করতে সময় নষ্ট করেননি। মার্ক জাকারবার্গের ‘এমএজিএ-বান্ধব’ পরিবর্তন ও ঘৃণামূলক কথার নিয়মের আগুন থেকে শুরু করে জেফ বেজোসের ট্রাম্পের প্রতি সম্প্রতি সুর বদলে ফেলার মতো বিষয়গুলো এরই ইঙ্গিত দেয় যে, প্রযুক্তি প্রধানরা খুব ভালো করেই জানেন যে কার কাছে তাদের হাঁটু গেড়ে বসতে হবে।
পুরো সিলিকন ভ্যালি ট্রাম্পের এই অভিষেক কর্মসূচির পেছনে একজোট হবে তা কল্পনা করাও হয়তো কঠিন ছিল। তবে এটাও বলা ঠিক হবে না যে, প্রেসিডেন্সির প্রথম দিনে এটি কেবল এক দিনেন শো ছিল।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘বাকস্বাধীনতা’ ফিরিয়ে আনার ট্রাম্পের দাবির পরও তিনি বারবার গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন বা তার সমালোচনা করার জন্য গণমাধ্যমগুলো বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন।
প্রজেক্ট ২০২৫-এ তার সমর্থকরা পর্নোগ্রাফিকে অপরাধী বানাতে ও যারা পর্নোগ্রাফি তৈরি করে তাদের কারাদণ্ড দিতে চায়। অন্যদিকে ট্রাম্পের দল তাদের অপছন্দের শিক্ষাব্যবস্থার বিভিন্ন ধারণাকে খতিয়ে দেখার জন্য ব্যস্ত।
টিকটক শেষ পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে টিকে থাকুক বা না থাকুক তবে প্রযুক্তি প্রধানরা স্পষ্টভাবে জানেন যে তারা কোন গেইমটি খেলছেন। ক্যাপিটলের গোলকধাঁধায় দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিটি সিইও তাই-ই করছেন।