ওলার সিইও ভাবিশ আগরওয়াল কোম্পানিটিকে দেখাতে চেয়েছেন ভারতে দুই চাকার টেসলা হিসাবে, যে দেশে আর্থিক খরচের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ।
Published : 20 Apr 2025, 02:18 PM
একসময় ভারতীয় স্টার্টআপ দুনিয়ার উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিল ওলা। বর্তমানে নানা সংকটের সঙ্গে লড়াই করছে স্টার্টআপটি।
২০১০ সালে প্রতিষ্ঠিত স্টার্টআপটি অল্প সময়েই ঘরে ঘরে পরিচিত এক নাম হয়ে ওঠে। রাইড হেইলিং থেকে শুরু করে বিদ্যুচ্চালিত গাড়ি ও ব্যাটারির ব্যবহারের কারণে উবারকে রীতিমতো চ্যালেঞ্জ করে বসেছিল ওলা।
২০২৩ সালে ‘ক্রুত্রিম’ হয়ে ওঠে ভারতের প্রথম এআই কোম্পানি যার মূল্য একশ কোটি ডলারেরও বেশি উঠেছিল বলে প্রতিবেদনে লিখেছে বিবিসি। এর সঙ্গেই এআই প্রতিযোগিতায় ঝাঁপিয়ে পড়ে ওলা।
ভারতে এআই প্রতিযোগিতায় অর্থায়ন করেছে জাপানের ‘সফটব্যাংক’, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ‘টাইগার গ্লোবাল’ ও সিঙ্গাপুরের ‘টেমাসেক’-এর মতো বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীরা।
গত বছর শেয়ার বাজারে নাম লিখিয়ে প্রায় ৭৩ কোটি ৪০ লাখ ডলারের তহবিল সংগ্রহ করেছে ওলা, যা ২০২৪ সালে ছিল ভারতের সবচেয়ে বড় আইপিও। তবে এই উচ্চাভিলাষী উত্থানের সঙ্গে সম্প্রতি বেশ কয়েকটি বিতর্কও তৈরি করেছে স্টার্টআপটি, বিশেষ করে ইভি শাখায়।
বিবিবি লিখেছে, আইপিও চালু হওয়ার পর থেকে সাত মাসে ওলা ইলেকট্রিকের মূল্য পড়ে গেছে প্রায় ৭০ শতাংশ। অন্যান্য বড় মোটরবাইক নির্মাতার দিক থেকে প্রতিনিয়ত প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হচ্ছে ওলা। পাশাপাশি ক্রমাগত সরকারি তদন্তেরও মুখে পড়ছে স্টার্টআপটি।
গত বছরের এপ্রিলের তুলনায় এ বছর ওলার স্কুটারের বিক্রি অর্ধেকেরও নীচে নেমে এসেছে, ফলে কোম্পানির লোকসানও বেড়েছে। গ্রাহকরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন ভিডিও পোস্ট করেছেন, যেখানে দেখা গেছে ওলা স্কুটারে আগুন ধরে গেছে বা মাঝপথে ভেঙে পড়ছে।
ওলার নতুন চালু হওয়া কয়েকশ শোরুমে লাইসেন্স ও রেজিস্ট্রেশন নিয়ে সরকারি তদন্তও চলছে। ওলার এক বিক্রেতা স্টার্টআপটির বিরুদ্ধে দেউলিয়া মামলাও করেছেন, যা নিয়ে স্টক এক্সচেঞ্জকে দেওয়া এক বিবৃতিতে ওলা বলেছে, মামলাটি নিষ্পত্তি করেছে তারা।
ওলার সাবেক কর্মী ও এ সংশ্লিষ্ট সূত্রের বরাত দিয়ে বিবিসি লিখেছে, অর্থ পরিশোধে দেরি হওয়ার কারণে অনেক ডিলার ও পার্টনার তাদের সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে ফেলেছে।
খরচ ও লোকসান কমাতে কর্মী ছাঁটাই, পুনর্গঠন এবং স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতির আশ্রয় নিয়েছে ওলা। বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে উঠে এসেছে, নভেম্বর থেকে তারা দ্বিতীয় দফায় কর্মী ছাঁটাই করেছে, যার সংখ্যা এক হাজারেরও বেশি।
এসব বিষয় নিয়ে ওলা’র কাছে বিস্তারিত জানতে চাইলেও স্টার্টআপটি বিবিসিকে তাদের আগের কিছু প্রেস বিবৃতির লিঙ্ক পাঠিয়েই দায় সেরেছে এবং অনেক প্রশ্নেরই সুনির্দিষ্ট কোনও উত্তর দেয়নি তারা।
তাহলে, সমস্যাটা হল কোথায়?
ওলার সিইও ভাবিশ আগরওয়াল কোম্পানিটিকে দেখাতে চেয়েছেন ভারতে দুই চাকার টেসলা হিসাবে। ভারতের মতো দেশ যেখানে আর্থিক খরচ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, সেখানে তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বায়ু দূষণ সমস্যারও একটি লাগসই সমাধানের।
তিনি স্টার্টআপটিতে কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগ এনেছেন, ভারত জুড়ে ওলার শোরুমও খুলেছেন, এমনকি যারা অনলাইনে বুকিং করেছিলেন তাদের দোরগোড়ায় গিয়ে স্কুটার পৌঁছে দিয়েছেন।
তবে, অটো ম্যাগাজিন ‘ওভারড্রাইভ’-এর বিশ্লেষক রোহিত পারাদকর বলছেন, ওলা আসলে ভাবতের বাজার ঠিকঠাক বুঝতে পারেনি।
ওলা স্কুটারটি তৈরি করেছে ডাচ স্টার্টআপ ‘এটারগো’র ‘অ্যাপস্কুটার’-এর আদলে, যে কোম্পানিটিকে ওলা ইলেকট্রিক কিনে নিয়েছিল ২০২০ সালে।
ওলার বেশ কয়েকজন সাবেক কর্মী বলেছেন, ওলার প্রথম ইভি স্কুটারটি এটারগো’র সংস্করণে খুব বেশি পরিবর্তন ছাড়াই বাজারে এনেছিল তারা। ওলার কমপ্লায়েন্স বিভাগে কাজ করেছেন এমন এক সাবেক কর্মী বলেছেন, ওই সময় দ্রুত বাজারে আনার টার্গেট ঠিক রাখতে অসম্ভব তাড়াহুড়ো করেছিল ওলা।
এক প্রশ্নের জবাবে ওলা ২০২৩ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত এক ব্লগ পোস্টের কথা উল্লেখ করেছে। স্কুটারগুলো “ভারতে চালানোর জন্য যথাযথ তৈরি ও পরীক্ষা করা হয়নি” এমন অভিযোগকে স্রেফ ‘মিথ’ হিসেবে বর্ণনা করেছে। ওই পোস্টে উল্লেখ আছে, এটারগো’র স্কুটারকে ওলা কীভাবে “একেবারে শুরু থেকে তৈরি” করেছে এবং “ভারতের সড়কের” জন্য পরীক্ষাও চালিয়েছে তারা।
ব্লগ পোস্টে ওলা বলেছে, “পুরো গাড়িটির ডিজিটাল সিমুলেশন, পার্টস পরীক্ষা, গাড়ির ল্যাব টেস্ট’সহ মোট তিনটি ধাপে পরীক্ষা করেছে তারা।
তবে গ্রাহকদের হাতে ঘটা বেশ কয়েকটি দূর্ঘটনা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। যেমন– কিছু স্কুটারে আগুন ধরে গিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর কারণ সম্ভবত শর্ট সার্কিট বা ত্রুটিপূর্ণ ব্যাটারি সিস্টেম।
অগ্নিকাণ্ডের তদন্তের জন্য ২০২২ সালে তদন্তের জন্য ওলার প্রথম প্রজন্মের এক হাজার চারশটিরও বেশি স্কুটার তুলে নিয়েছিল কোম্পানিটি। তবে, ওই প্রতিবেদন কখনও আলোর মুখ দেখেনি। ওই সময় কোম্পানিটি কেবল বলেছিল, তাদের এসব ব্যাটারি সিস্টেম ভারতীয় ও ইউরোপীয় মান মেনে চলে। কিন্তু আগুন লাগার কারণ প্রশ্নে মুখ খোলেনি ওলা।
এদিকে, ওলার প্রতিদ্বন্দ্বী বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠিত গাড়ি নির্মাতা সহজেই বিদ্যুচ্চালিত স্কুটার বাজারে এনেছে, যা কোম্পানিটির ওপর চাপ আরও বাড়িয়েছে। ডিসেম্বরের মধ্যে ভারতের বাজারে ওলার শেয়ার ৫২ শতাংশ থেকে নেমে আসে ১৯ শতাংশে। এরপর জানুয়ারিতে সামান্য বেড়ে ২৫ শতাংশে এসে দাঁড়ায়।
লাভের জন্য মাসে ৫০ হাজার ইউনিট স্কুটি বিক্রির লক্ষ্য নিয়েছে ওলা। তবে সে লক্ষ্য কতটা বাস্তব, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে বিশ্লেষকদের।
সরকারি তথ্য বলছে, ফেব্রুয়ারিতে ১০ হাজারেরও কম স্কুটার বিক্রি হয়েছে ওলার। আর, কোম্পানিটির দাবি, ২৫ হাজার স্কুটার বিক্রি হয়েছে তাদের। এ অসঙ্গতি নিয়ে নোটিশ জারি করেছে ভারতের কেন্দ্রীয় পরিবহণ মন্ত্রণালয়।
ওলা বলেছে, মার্চ মাসে ২৩ হাজারটিরও বেশি স্কুটার বিক্রি করেছে তারা এবং এ অর্থবছরের জন্য ৩০ শতাংশ বাজার শেয়ার ধরে রেখেছে কোম্পানিটি।
বিক্রি বাড়াতে বিশাল ছাড়ের পাশাপাশি সাশ্রয়ী দামে নতুন মডেলও বাজারে এনেছে ওলা। তবে অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে কোম্পানিটির লোকসান বেড়ে সাড়ে ছয় কোটি ডলারে পৌঁছেছে, যা এক বছর আগে ছিল চার কোটি ৩৬ লাখ ডলার।
ওলার একজন সাবেক কর্মী বলেছেন, এক সময় মাসে হাজার হাজার অভিযোগ জমা হচ্ছিল ওলার বিরুদ্ধে। এক বছরের মধ্যে ১০ হাজার অভিযোগ পাওয়ার পর ওলাকে নোটিশ পাঠায় ভারতের ভোক্তা অধিকার সংস্থা ও কেন্দ্রীয় ভোক্তা সুরক্ষা কর্তৃপক্ষ বা সিসিপিএ।
২১ মার্চ ভারতের চারটি রাজ্যে কোম্পানিটি নিয়ে তদন্তের বিষয়টি স্বীকার করেছে ওলা এবং বলেছে, কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সহযোগিতা করছে তারা।
বিবিসি লিখেছে, ওলার ভাগ্যের এই পরিবর্তন বিনিয়োগকারীদের, বিশেষ করে যারা চড়া মূল্যে শেয়ারে বিনিয়োগ করেছিলেন তাদেরকে উদ্বিগ্ন করে তুলছে। তবে ভারতের কার্বন নিঃসরণ কমাতে ও উৎপাদন সম্প্রসারণের প্রচেষ্টায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে কোম্পানিটি।
ওলা ইলেকট্রিকের প্রোডাক্ট স্ট্র্যাটেজি’র সাবেক প্রধান ও বর্তমানে কনসালটেন্সি কোম্পানি ‘ইনসাইট ইভি’র দীপেশ রাঠোর বলেছেন, “সফটওয়্যারে জ্ঞান নিয়ে আসলে হার্ডওয়্যার উৎপাদনে কাজে লাগে না। হার্ডওয়্যার তৈরিতে যে সময় প্রয়োজন, সেটা ভিন্নরকম।”
সম্প্রতি ওলা ক্যাবের সিইও’সহ বেশ কয়েকজন শীর্ষ কর্তা ব্যক্তি পদত্যাগ করেছেন। প্রযুক্তি, বিপণন, বিক্রি ও ব্যবসা বিভাগের মূল লোকজনও গত বছর ওলা ছেড়ে গেছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গুরুত্বপূর্ণ লোকজনের এভাবে চলে যাওয়ার বিষয়টিও কোম্পানিটির পণ্য ও পরিষেবা সংক্রান্ত সমস্যায় প্রভাব ফেলেছে।