থ্রিডি প্রিন্টার বানিয়ে দিচ্ছে অস্ত্র, বাড়াচ্ছে শঙ্কা

প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে সাথে থ্রিডি প্রিন্টারে তৈরি আগ্নেয়াস্ত্র অদূর ভবিষ্যতে আরও বড় ঝুঁকি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে বলে ইউরোপোলের আশঙ্কা।

প্রযুক্তি ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 Nov 2022, 11:13 AM
Updated : 11 Nov 2022, 11:13 AM

ব্রিটিশ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য মাথাব্যথার নতুন কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে থ্রিডি প্রিন্টিং প্রযুক্তিতে বানানো আগ্নেয়াস্ত্র এবং অস্ত্রের যন্ত্রাংশ।

বিবিসি জানিয়েছে, ৭ অক্টোবর লন্ডনের এক বাসায় অভিযান চালানোর পর এ প্রযুক্তি পণ্য নিয়ে সতর্কবার্তা দিয়েছে যুক্তরাজ্যের পুলিশ বিভাগ। ওই বাসাকে ‘থ্রিডি আগ্নেয়াস্ত্রের অস্থায়ী কারখানা’ হিসেবে বর্ণনা করেছে ব্রিটিশ পুলিশ।

যুক্তরাজ্যের ‘ন্যাশনাল ফায়ারআর্মস টার্গেটিং সেন্টার’ এর প্রধান ম্যাথিউ পারফেক্ট বলছেন, ব্যারেল আর গুলির মত আনুষঙ্গিক বাদে আগ্নেয়াস্ত্রের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ যন্ত্রাংশ থ্রিডি প্রিন্টারেই তৈরি করা সম্ভব।

থ্রিডি প্রযুক্তির শুরুর দিনগুলো থেকেই অবৈধ অস্ত্র তৈরিতে এর ব্যবহার নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন বিশেষজ্ঞরা। থ্রিডি প্রিন্টারে তৈরি প্রথম প্রজন্মের আগ্নেয়াস্ত্রগুলো টেকসই না হওয়ায় এবং কেবল একবার গুলি করার সক্ষমতার কারণে গুরুত্ব পায়নি।

কিন্তু অক্টোবরের অভিযানের পর ‘যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ক্রাউম এজেন্সি (এনসিএ)’ বলছে, থ্রিডি প্রিন্টারে তৈরি আগ্নেয়াস্ত্রের ঝুঁকি এখন গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় না নিলে চলছে না।

ম্যাথিউ পারফেক্ট বলছেন, এখন থ্রিডি প্রিন্টারে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রও বানানো যাচ্ছে, যা একসঙ্গে বহু গুলি করার সক্ষমতা রাখে। আর কোনো সিরিয়াল নম্বর না থাকায় এই অস্ত্রগুলোর নির্মাতা, উৎপত্তিস্থল এবং ব্যবহারকারীর হিসাব রাখা কার্যত অসম্ভব।

তবে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যারেল এবং গুলি তৈরিতে ধাতব পদার্থ ব্যবহার করতে হয়। ফলে এখনও সাধারণ স্ক্রিনিংয়েই এসব অস্ত্র ধরা সম্ভব হচ্ছে। 

যুক্তরাজ্যে থ্রিডি প্রিন্টারে বানানো আগ্নেয়াস্ত্র জব্দ হওয়ার ঘটনা আগের চেয়ে বেড়েছে বলে জানিয়েছে বিবিসি। গত বছর সেখানে এরকম অস্ত্র উদ্ধারের ২১টি ঘটনা ঘটেছে।

মহামারীর লকডাউনের সময় সীমান্ত দিয়ে প্রথাগত ধাতব আগ্নেয়াস্ত্র পাচার কঠিন হয়ে পড়লে অপরাধীরা থ্রিডি প্রিন্টারে আগ্নেয়াস্ত্র বানানোর দিকে ঝুঁকতে শুরু করে বলে ম্যাথিউ পারফেক্টের ধারণা।

সামনের দিনগুলোতে এ ধরনের আগ্নেয়াস্ত্রের ঝুঁকি আরও বাড়বে বলে মনে করেন ইউনিভার্সিটি অব ব্রাইটনের ক্রিমিনোলজি বিষয়ের অধ্যাপক পিটার স্কোয়ার্স।

তিনি বিবিসিকে বলেন, “ঘটনাগুলো খুব দ্রুত ঘটছে। প্রযুক্তিও হাতের নাগালে … আর সফটওয়্যার ও নকশাগুলোতো ওয়েবেই পাওয়া যায়।”

কিংস কলেজ লন্ডনের ‘ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব র‌্যাডিকালাইজেশন’-এর জ্যেষ্ঠ গবেষণা সহযোগী রাজান বাসরার মতে, পুরো ইউরোপের বাস্তবতাই প্রতিফলিত হচ্ছে যুক্তরাজ্যে।

প্রথাগত আগ্নেয়াস্ত্র সহিংস উগ্রপন্থিদের প্রথম পছন্দ হলেও, হাতের নাগালে বেআইনি অস্ত্র না পেলে বিকল্প হিসেবে থ্রিডি প্রিন্টারে তৈরি অস্ত্রই তারা ব্যবহার করবে।

“উগ্রপন্থিদের মধ্যে থ্রিডি প্রিন্টারে আগ্নেয়াস্ত্র নির্মাণ এবং ব্যবহারের প্রবণতা বাড়তে দেখছি আমরা, স্পেন, সুইডেন, জার্মানি এবং নেদারল্যান্ডসে এমন ঘটনা দেখেছি আমরা। যুক্তরাজ্যেও এমনটা কয়েকবার ঘটেছে,” বিবিসিকে বলেছেন ড. বাসরা।

তিনি বলেন, এ ধরনের অস্ত্রের বিষয়ে ডানপন্থি সন্ত্রাসী দলগুলোই বেশি আগ্রহী। গত জুন মাসে একটি ডানন্থি দলের কয়েকজন সদস্যকে সেজন্য দোষী সাব্যস্ত করে শেফিল্ড ক্রাউন কোর্ট। দলটির দুই সদস্যের বাড়িতে থ্রিডি প্রিন্টারে তৈরি আগ্নেয়াস্ত্র পাওয়া গিয়েছিল।

থ্রিডি অস্ত্রগুলো ক্রমশ ‘মূলধারার অপরাধ জগতে’ অবস্থান তৈরি করে নিচ্ছে এবং মূলধারার ইন্টারনেট প্ল্যাটফর্মগুলোতেও এর উপস্থিতি বাড়ছে বলে জানান ড. বাসরা।

অপরাধীদের মধ্যে ‘এফজিসি’ নামে পরিচিতি একটি আধা-স্বয়ংক্রিয় থ্রিডি আগ্নেয়াস্ত্রের উদাহরণ টেনে বাসরা বলেন, “এই অস্ত্রটির বিশেষত্ব হচ্ছে, এর নকশাই করা হয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নে নিয়ন্ত্রিত নয় এমন যন্ত্রাংশের সঙ্গে ব্যবহারের কথা মাথায় রেখে।”

অস্ত্রটি থ্রিডি প্রিন্টারে নির্মাণের নির্দেশনা অনলাইনে প্রথম পোস্ট করা হয়েছিল ২০২০ সালে। এর সঙ্গে একশ পাতার ম্যানুয়াল এবং নির্মাণ প্রক্রিয়ার বিভিন্ন পর্যায়ের ভিডিও ছিল। 

যুক্তরাজ্যে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে সহিংসতার ঘটনা তুলনামূলক কম হলেও অপরাধীরা অন্যান্য অপরাধীদের মধ্যে ভীতি সঞ্চার করতে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র সংগ্রহ করছে বলে জানিয়েছেন পারফেক্ট।

ঝুঁকি আরও বাড়বে

ফ্রান্সের ইউনিভার্সিটি অফ রঁ-এর গবেষক ক্রিস্টান গোবলাসের বরাত দিয়ে বিবিসি লিখেছে, সামনের দশকে থ্রিডি প্রিন্টারের কাঁচামাল হিসেবে ধাতব পদার্থ ব্যবহারের প্রযুক্তি সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতায় চলে আসতে পারে।

এ প্রযুক্তি জনসাধারণের হাতের নাগালে চলে এলে থ্রিডি প্রিন্টারের আগ্নেয়াস্ত্রগুলোর নির্ভরযোগ্যতা আরও বাড়বে এবং সেগুলো আরও বেশি টেকসই হবে।

ইউরোপোলও জানিয়েছে, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বেশ কিছু জায়গায় থ্রিডি প্রিন্টিং প্রযুক্তিতে আগ্নেয়াস্ত্র তৈরি ও বিক্রির ঘটনা উদঘাটন করেছে তারা।

এর মধ্যে বেশ কিছু আগ্নেয়াস্ত্র এবং যন্ত্রাংশ বিক্রির জন্য তোলা হয়েছিল ডার্ক ওয়েবের বেআইনি মার্কেটপ্লেসে।

থ্রিডি প্রিন্টিং প্রযুক্তিতে আগ্নেয়াস্ত্র তৈরি বর্তমানে কিছুটা কঠিন হলেও ‘প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে সাথে অদূর ভবিষ্যতে এটি আরও বড় ঝুঁকি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে বলে ইউরোপোলের আশঙ্কা।