দেশে করোনাভাইরাসের প্রকোপ দেখা দেওয়ার পর এ বছর চার মাসের বেশি সময় উৎপাদন কর্মকাণ্ড প্রায় বন্ধ ছিল। ফলে গত অর্থবছর শেষে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি কমে ৫ দশমিক ২৪ শতাংশে নেমে এসেছে।
এর মধ্যেও দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক চলতি বছর ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬৭৪ পয়েন্ট বা ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ বেড়েছে।
২০১৯ সালের শেষ দিন ডিএসইর মূল সূচক ডিএসইএক্স ছিল ৪ হাজার ৪৫৩ পয়েন্ট। ২৪ ডিসেম্বর তা বেড়ে ৫ হাজার ২১৮ পয়েন্টে উঠেছে। লেনদেন হচ্ছে হাজার কোটি টাকার ঘরে।
২০২০ সালের শেষ ছয় মাসে দেশের পুঁজিবাজার ভালো করলেও প্রথম ছয় মাসের পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন।
বছরের প্রথমার্ধে সূচক ৪ হাজার পয়েন্টের নেমে গিয়েছিল, লেনদেনও নেমেছিল ১০০ কোটি টাকার নিচে।
এর সমর্থনে পুঁজিবাজারের সূচক আগের বছরের চেয়ে প্রায় এক হাজার পয়েন্ট বাড়ার কথা তুলে ধরলেন ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগের এই অধ্যাপক।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, প্রণোদনার পাশাপাশি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসিতে নতুন নেতৃত্ব আসার পর তাদের কার্যক্রমে বাংলাদেশের বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরেছে। এসবের সার্বিক প্রভাব পড়েছে পুঁজিবাজারের কর্মকাণ্ডে।
মোহাম্মদ মুসার বিবেচনায়, বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং প্রবাসী আয়ে (রেমিটেন্স) প্রবৃদ্ধিসহ অর্থনীতির কয়েকটি সূচক ভালো থাকায় সামনের বছরও পুঁজিবাজারে ভালো কাটার কথা।
তবে দেশের পুঁজিবাজারে সবচেয়ে বড় অবদান রাখা ব্যাংক খাতে ‘ঝুঁকি রয়েছে’ মন্তব্য করে অধ্যাপক মুসা বলেন, “ব্যাংকগুলোর নিরাপত্তা সঞ্চিতিতে (প্রভিশন) ছাড় দেওয়া হয়েছে। এই সুযোগ নিয়ে ঋণখেলাপি বেড়ে গেলে তা ব্যাংকিং খাতের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে।”
এর প্রভাবে ২০২০ সালের প্রথম থেকে দেশের পুঁজিবাজারের সূচক কমতে থাকে; পতন ঠেকাতে শেয়ারের সর্বনিম্ন দাম বেঁধে দেওয়া হয়। এতে তাৎক্ষণিকভাবে বাজার চাঙা হলেও দীর্ঘ মেয়াদে আশানুরূপ ফল মেলেনি।
এর মধ্যেই করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে নজিরবিহীনভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয় দেশের পুঁজিবাজার। বিরল এই পদক্ষেপকে তখন টেকসই পুঁজিবাজারের জন্য ইতিবাচক হিসেবে দেখেননি বিশেষজ্ঞরা।
শান্তা অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ এমরান হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিশ্বে এটা একটা বিরল ঘটনা। বিনিয়োগকারীদের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
“করোনার কারণে পুঁজিবাজার প্রায় ৬৩ দিন বন্ধ ছিল; বিনিয়োগকারীদের টাকা আটকে গিয়েছিল, কেউ চাইলেও টাকা বের করতে পারছিলেন না।“
ডিএসই ব্রোকারদের সংগঠন ডিবিএর সাবেক সভাপতি আহমেদ রশিদ লালী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এর আগে কোনো দিন বাংলাদেশের পুঁজিবাজার এভাবে বন্ধ হয়নি। ১৯৮৮ সালে বন্যা হয়েছিল; সেসময় পানি ঢুকে গিয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ তিন চার দিন বন্ধ ছিল।”
এক দিকে অর্থনীতির খারাপ অবস্থা, অন্যদিকে পুঁজিবাজারের পতন ঠেকাতে শেয়ারের সর্বনিম্ন দাম বেঁধে দেওয়ায় লেনদেন গিয়ে ঠেকেছিল তলানিতে।
এর মধ্যেই জুলাইয়ের শেষ ভাগ থেকে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার। এর পেছনে তিনটি কারণ খুঁজে পেয়েছেন পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা।
# আমানতের সুদের হার ৫ শতাংশে এবং ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশে বেঁধে দেওয়া। এর ফলে কম সুদে ঋণ পেয়েছেন উদ্যোক্তারা। ব্যাংক সুদ আকর্ষণীয় না হওয়ায় পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বেড়েছে।
# সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের বাস্তবায়নের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসাগুলো দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে থাকে।
# বাংলাদেশের পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার নতুন নেতৃত্বের নেওয়া সিদ্ধান্তগুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে
প্রায় নয় বছর পর মে মাসে নতুন নেতৃত্ব পায় বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন। অনেক দেরিতে হলেও কারসাজির সঙ্গে জড়িতদের শাস্তির ব্যবস্থাসহ পুঁজিবাজারের জন্য বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ও কঠোর সিদ্ধান্ত নেয় নতুন কমিশন।
আইডিএলসি ইনভেস্টমেন্টস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনিরুজ্জামান বলেন, পুঁজিবাজারের কারসাজির বিষয়ে কমিশনের শক্ত ভূমিকা বিনিয়োগকারীদের ‘আস্থা ফেরাতে ভূমিকা’ রেখেছে।
এছাড়া অনেক সমালোচনার মুখেও আগের কমিশনের বেঁধে দেওয়া শেয়ারের সর্বনিম্ন দরের সীমা উঠিয়ে দেয়নি নতুন কমিশন। এটা শেষ পর্যন্ত কাজে লেগেছে বলে মনে করছেন কেউ কেউ।
আহমেদ রশিদ লালী বলেন, সর্বনিম্ন দাম বেঁধে দেওয়ায় সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে একটা ‘স্বস্তি’ ফিরে আসে। কারণ এর মাধ্যমে একটা বিষয় নিশ্চিত হয় যে, লোকসান নির্দিষ্ট অংকের বেশি হবে না।
প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বাড়াতে পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলোর প্রতি মাসের বিনিয়োগ নজরদারির একটা নিয়ম চালু করে নতুন কমিশন, যার ফলে পুঁজিবাজারে টাকার যোগান কিছুটা বাড়ে।
এছাড়া উদ্যোক্তা-পরিচালকদের ন্যূনতম শেয়ারধারণে বাধ্য করতে বিএসইসির কড়াকড়ির ফলে শেয়ারের চাহিদা বেড়ে যায় এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতেও ভূমিকা রাখে।
বিএসইসি ২০২০ সালে প্রায় ১৫টি আইপিওর অনুমোদন দিয়েছে। এর ফলে পুঁজিবাজারে বেশ কিছু টাকা বিনিয়োগ এসেছে।
শর্ত পূরণ করতে না পারায় বেশ কিছু আইপিও বাতিল করেছে বিএসইসি, যার ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা বাজে বিনিয়োগ থেকে ‘বেঁচে যায়’। বিনিয়োগকারীদের আটকে থাকা অর্থ ফেরতের উদ্যোগ নেয় বিএসইসি।
কমিশনের পক্ষ থেকে বিলম্বিত হলেও বহুল প্রত্যাশিত সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নের ফলে আসছে বছর নিয়েও আশাবাদী পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা।
এমরান বলেন, “অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। আগামী বছরে এটা চলমান থাকবে। এতে আমাদের পুঁজিবাজারও ভালো থাকবে বলে আমি মনে করি।
“বেশ কিছু ভালো আইপিও পাইপলাইনে আছে। সেগুলো যদি চলে আসে পুঁজিবাজার সামনে আরও ভালো করবে। সুদের হার কম থাকবে। সেটাও আগামী বছর পুঁজিবাজারকে ভালো রাখতে সাহায্য করবে।”
ডিএসই পরিচালক শাকিল রিজভী বলেন, “২০২১ সালে দেশের পুঁজিবাজার ২০২০ সালের চেয়ে ভালো করবে। বন্ড মার্কেট ভালো হবে, এসএমই বোর্ড চালু হবে। ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্ত হবে।”