ডিবিএ সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, “আমরা রুগ্ন হয়ে যাচ্ছি, হয়ে গেছি। তাহলে বাজারের হাল ধরবে কে? এর জন্য আমাদের নীতি-সহায়তা দরকার।”
Published : 11 Jun 2024, 05:46 PM
সুশাসনের ঘাটতি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা না থাকায় একদিকে যেমন ভালো ভালো কোম্পানি পুঁজিবাজার বিমুখ হচ্ছে, আর ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্ত না হওয়ায় নতুন বিনিয়োগকারীও আকর্ষণ করা যাচ্ছে না।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ব্রোকারেজদের সংগঠন ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ডিবিএর নেতারা বলছেন, এই দুইয়ের চক্করে পড়ে ধুঁকছে ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠানগুলো।
মঙ্গলবার মতিঝিলের ডিএসই ভবনে বাজেট পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে ডিবিএ সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, “গত ১৫ বছরে পুঁজিবাজারে ভালো মানের উল্লেখযোগ্য কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়নি। হাতে গোনা কয়েকটি ভালো কোম্পানি এসেছে মাত্র। বাজারে ভালো কোম্পানি না আসলে নতুন বিনিয়োগকারী আসবে না।”
মৌলিভিত্তি সম্পন্ন কোম্পানি বাজারে না আসার কারণ নিয়ে প্রশ্নে তিনি বলেন, “সার্বিকভাবে পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএইসি, স্টক এক্সচেঞ্জ, তালিকাভুক্ত কোম্পানি ও বাজার সংশ্লিষ্টদের মধ্যে সুশাসনের ঘাটতি আছে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা না থাকায় নতুন করে ভালো মানের কোম্পানি বাজারে আসতে চাইছে না।”
বাজার নতুন বিনিয়োগকারীও আকর্ষণ করতে পারছে না। গত কয়েক বছরে বিনিয়োগকারীদের বিও (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স) হিসাব ৩৩ লাখ থেকে ১৭ লাখে নেমেছে।
এর প্রভাবে ৫০ শতাংশ ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠান এখন রুগ্ন হয়ে পড়েছে জানিয়ে সাইফুল ইসলাম বলেন, “বাজারে ব্যক্তি পর্যায়ের বিনিয়োগকারীই ৮০ শতাংশ। এখন তারাই বাজারের উপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলছে। আস্থা ফেরাতে ডিএসইকে আরো ক্ষমতায়ন করতে হবে। বিদ্যমান সবগুলো নিয়ম, নীতিমালা পূর্ণমূল্যায়ন করে বাজারমুখী করার সময় হয়েছে।”
বিনিয়োগকারী আকর্ষণে পুঁজিবাজারে অপ্রদর্শিত আয় (কালো টাকা) বিনিয়োগের সুযোগ ও নতুন বিনিয়োগকারীদের তিন বছর করমুক্ত ঘোষণা করার দাবি জানান তিনি।
পুঁজিবাজারে ২০১০ সালের মহাধস পরবর্তী উন্নয়নে স্টক এক্সচেঞ্জের মালিকানা থেকে ব্যবস্থাপনা বিভাগকে পৃথক (ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন) করে আইনি কাঠামো দেওয়া হয়। আইন অনুযায়ী, স্টক এক্সচেঞ্জের ১৩ পরিচালকের মধ্যে সাতজনই হবেন স্বতন্ত্র এবং চেয়ারম্যান হবেন স্বতন্ত্র পরিচালকদের মধ্যে থেকে। আর চারজন হবেন শেয়ারহোল্ডার পরিচালক, যারা ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠানের মালিক।
ডিএসইর পরিচালনা পর্ষদের সাতজন পরিচালক স্বতন্ত্র হওয়ায় বাজারমুখী অনেক সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
পরিচালক পর্ষদে শেয়ারহোল্ডার পরিচালক চারজন থাকায় সিদ্ধান্ত তাদের পক্ষে আসছে না জানিয়ে সাইফুল ইসলাম বলেন, “ডিমিউচুয়ালাইজেন আইনের পর ১০ বছর পার হয়েছে। এখন আইন হালনাগাদ করা দরকার। পরিচালকদের নিয়োগ দিতে আরো ক্ষমতা দেওয়া হোক ডিএসইকে।”
ট্রেডিং কর শতকরা ৫ পয়সা থেকে কমিয়ে আড়াই পয়সা করে এই আগাম করকে (এআইটি) চূড়ান্ত কর হিসেবে ধরার প্রস্তাব দিয়েছে ডিবিএ।
রাষ্ট্রায়ত্ব প্রতিষ্ঠানকে তালিকাভুক্ত করতে বাজেটে পথনকশা দেওয়ার দাবি করে ডিবিএ সভাপতি বলেন, “ক্যাপিটাল গেইন ট্যাক্স নির্ধারণের আগে অংশীজন হিসেবে কারো সঙ্গেই আলোচনা করা হয়নি। এতে বাজারের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। আমরা কয়েক জায়গা থেকে আশ্বস্ত হয়েছিলাম এবার করটি বাসানো হবে না।”
আগামী অর্থবছর থেকে ক্যাপিটাল গেইন বাসানোর দাবি করেছে সংগঠনটি।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ফ্লোর প্রাইস প্রত্যাহারের পর থেকে পুঁজিবাজারে দরপতন চলছে। এই সময়ে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকার বাজার মূলধন হারিয়েছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)। পতন ঠেকাতে তিন শতাংশের সার্কিট ব্রেকার দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি।
তারপরও ধারাবহিক দর পতন ঘটছে বড় শেয়ার বাজার ডিএসইতে। মঙ্গলবার ডিএসইতে লেনদেন হয় ৪৩১ কোটি টাকা; সোমবার লেনদেন আরো কমে হয়েছিল ৩১৮ কোটি ৭৮ লাখ টাকার।
লেনদেন হওয়া শেয়ারের মধ্যে দর এগিয়েছে ৫১টির, কমেছে ৩৫টির ও আগের দরে লেনদেন হয় ৩০৮টি প্রতিষ্ঠানের।
প্রধান সূচক ডিএসইক্স প্রায় ৩৬ পয়েন্ট হারিয়ে লেনদেন শেষ করে ৫ হাজার ৭০ পয়েন্টে। সোমবার যেখানে ডিএসইএক্স ৬৫ পয়েন্ট হারিয়ে লেনদেন শেষ করেছিল ৫ হাজার ১০৫ পয়েন্ট।
সেখান থেকে মঙ্গলবার সকালে লেনদেন শুরু করে প্রধান সূচকটি সর্বোচ্চ ৫ হাজার ১২৩ পয়েন্ট উঠেছিল ২২ মিনিট পড়ে। এরপর থেকে ধীরে ধীরে পতন চলতে থাকে। সোয়া ১২টার দিকে একবার উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেও তা ধরে রাখতে পারেনি।
গত ৬ জুন জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। বাজেটে পুঁজিবাজারের শেয়ার বিক্রি করে আয় অর্থাৎ মূলধনি মুনাফা বা ক্যাপিটাল গেইন ৫০ লাখ টাকার বেশি হলে করারোপের প্রস্তাব করা হয়েছে।
এ ছাড়াও পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত নয়, এমন কোম্পানির করহার আড়াই শতাংশ কমিয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়েছে। অথচ ডিএসই এবং পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টদের দাবি ছিল, ক্যাপিটাল গেইনে করারোপ না করা এবং পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তি উৎসাহিত করতে তালিকাভুক্ত ও অতালিকাভুক্ত কোম্পানির কর ব্যবধান বাড়ানো।
পুঁজিবাজারের জন্য কোনো সুখবর না থাকায় বাজেটের পর তিন কর্মদিবসে ৩ শতাংশের বেশি সূচক কমেছে। গত রোব ও সোমবার ৬৫ করে ১৩০ পয়েন্ট পড়েছে। সব মিলিয়ে তিন দিনে সূচক হারিয়েছে ১৬৫ পয়েন্ট।
বাজারের ধারাবাহিক পতন নিয়ে ডিবিএ সভাপতি বলেন, “যেভাবে বাজার পড়ছে, তার যৌক্তিক কারণ নেই। এমনিতেই অযৌক্তিক কারণে বাজার পড়ছে, নেতিবাচক মনোভাবের কারণে পড়ছে।
“আমাদের পুঁজিবাজার প্রায় চার বছর খরার মধ্যে যাচ্ছে। উত্তরণের চেষ্টা করেও হচ্ছে না। একটা গণজাগরণের সৃষ্টি না হলে এই জায়গা থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। আমরা রুগ্ন হয়ে যাচ্ছি, হয়ে গেছি। তাহলে বাজারের হাল ধরবে কে? এর জন্য আমাদের নীতি-সহায়তা দরকার।”
এই নীতি সহায়তা আগামী অর্থবছরের বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করতে সাইফুল ইসলাম বলেন, “‘মার্জিন লস বাজারের উন্নয়নে প্রধান অন্তরায়। দীর্ঘদিন ধরে থাকা মার্জিন লসের কারণে অসংখ্য বিনিয়োগ অ্যাকাউন্ট নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে, যা তারল্য সংকটের মুখে গত কয়েকবছরে গুরুতর হয়ে উঠেছে। মার্জিন ঋণের উপর থেকে করা তুলে নেওয়ার দাবি করছি।”