ব্যাংকের প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে। কোনো কিছু গোপন করা হয়নি, দাবি নতুন চেয়ারম্যানের।
Published : 29 Oct 2024, 12:51 AM
মাস ছয়েক আগেও ‘সবল’ ব্যাংকের তালিকায় রেখে বেসরকারি আরেকটি ব্যাংককে টেনে তোলার দায়িত্ব বর্তেছিল এক্সিম ব্যাংকের উপর; সরকারের পালাবদল হতে না হতেই সেই ব্যাংক তিন মাসেই লোকসান দিয়েছে সাড়ে ৫০০ কোটি টাকারও বেশি।
চলতি বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে বিপুল এ অর্থ লোকসান দিয়েছে শরীয়াহভিত্তিক এক্সপোর্ট ইমপোর্ট ব্যাংক অব বাংলাদেশ পিএলসি, যা এক্সিম ব্যাংক নামে পরিচিত।
ব্যাংকটি ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের আমলের প্রভাবশালী ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম মজুমদারের ব্যাংক হিসেবেও পরিচিতি পায়। ব্যাংকটির এবং ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বিএবির সাবেক এই চেয়ারম্যান গ্রেপ্তার হয়ে এখন কারাগারে।
ক্ষমতার পালাবদলের বেশি দিন না যেতেই ব্যাংকটির ক্ষত বেড়িয়ে এল বিপুল লোকসানের তথ্যে। অথচ বছরের শুরুর দিকে এটি অনিয়ম ও ঋণ কারসাজিতে ডুবতে বসা পদ্মা ব্যাংককে একীভূত করতে সম্মতি দিয়েছিল। আগের সরকারের সময় প্রভাব খাটিয়ে আর্থিক খাতের সুবিধা নেওয়া আরেক ব্যবসায়ী চৌধুরী নাফিজ সরাফত ছিলেন পদ্মা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান, যার হাতে ব্যাংকটি আরও দুর্দশায় পড়ে বলে অভিযোগ রয়েছে।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এক্সিম ব্যাংকের হঠাৎ এমন লোকসানি অবস্থার চিত্র সামনে আসে সোমবার। ব্যাংকটির সবশেষ প্রান্তিকের আর্থিক তথ্য এদিন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।
এতে দেখা যায়, সবশেষ প্রান্তিকে এক্সিম ব্যাংকটির শেয়ার প্রতি লোকসান হয়েছে তিন টাকা ৯১ পয়সা। ব্যাংকটির মোট শেয়ার ১৪৪ কোটি ৭৫ লাখ ৫৭ হাজার ৩৪৪টি। এ হিসাবে এক প্রান্তিকে লোকসান দিয়েছে ৫৬৫ কোটি ৯৯ লাখ ৪৯ হাজার টাকা।
লাভে থাকা ব্যাংকটির হঠাৎ করে লোকসানে পরিণত হওয়ার বিষয়ে বর্তমান চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম স্বপন দাবি করেছেন, ব্যাংকের প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে। কোনো কিছু গোপন করা হয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপে নজরুল ইসলাম মজুমদারকে বাদ দিয়ে পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয় গত অগাস্টে। তখন চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান স্বপন যিনি আগের চেয়ারম্যানের সময়েও পরিচালক ছিলেন।
নতুন চেয়ারম্যান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘আশা করছি আগামী ডিসেম্বর নাগাদ তারল্য সংকট কেটে যাবে। আমরা ক্লায়েন্টদের কাছে যাচ্ছি, তাদের বুঝাতে চেষ্টা করছি ব্যাংক ভালো হবে। আগের মত ঋণ কেলেঙ্কারি, দুর্নীতি- অনিয়ম হবে না।’’
তিন মাস আগে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে ব্যাংকটির কর পরবর্তী মুনাফা ছিল ৩৭৭ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে ব্যাংকটির প্রথম ছয় মাসের কর পরবর্তী মুনাফা ছিল ১৬৫ কোটি টাকা এবং বাকি ২১২ কোটি ৫৬ লাখ টাকা মুনাফায় যোগ হয় আগের বছরের ‘রিটেইন আর্নিংস’ থেকে।
অর্ধ বার্ষিক অর্থাৎ ছয় মাস পেরেনোর পরই সরকারের ক্ষমতা বদল ও অন্তবর্তকালীন সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পরের প্রান্তিকের অনিরিক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনে উল্টে গেল ‘সবল’ ব্যাংকের চিত্র।
অনীরিক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, তিন মাসের ব্যাবধানে ব্যাংকটি তীব্র তারল্য সংকটেও ভুগছে।
অথচ আগের বছরের এ সময়ে ব্যাংকটির শেয়ার প্রতি মুনাফা ছিল ৩৭ পয়সা। সব মিলিয়ে চলতি বছরের ৯ মাসে জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বরে ব্যাংকটির শেয়ার প্রতি লোকসান হয়েছে ২ টাকা ৭৭ পয়সা।
প্রথম ছয় মাসে মুনাফায় থাকায় মোট ৯ মাসের হিসাবে লোকসান কিছুটা কমেছে। তৃতীয় প্রান্তিক শেষে নিট লোকসান দাঁড়িয়েছে ৪০০ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। আগের বছর একই সময়ে কর পরবর্তী নিট মুনাফা ছিল ২২৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা।
লাভজনক ব্যাংকটি হঠাৎ লোকসানে যাওয়ায় বিনিয়োগকারীসহ অন্যরা প্রশ্ন তুলেছেন আগের সব আর্থিক প্রতিবেদনের মান নিয়েও।
অনীরিক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্যাংকটির নগদ অর্থের সরবরাহ কমে গেছে। শেয়ার প্রতি নগদ অর্থের ঘাটতি হয়েছে ১৬ টাকা ৬২ পয়সা। আগের বছরে ঘাটতি ছিল শেয়ার প্রতি এক টাকা ২৬ পয়সা। এক বছরের ব্যবধানে শেয়ার প্রতি নগদ অর্থের সরবরাহ ঘাটতি বেড়েছে ১১ দশমিক ৩৮ গুন বেশি।
এ কারণে সম্পদ মূল্যও কমেছে ব্যাংকটির। শেয়ার প্রতি সম্পদ মূল্য গত সেপ্টেম্বর শেষে দাঁড়িয়েছে ১৯ টাকা ২৪ পয়সা। আগের বছরে যা ছিল শেয়ার প্রতি ২২ টাকা ৪৪ পয়সা।
তিন মাসের ব্যবধানে বড় ধরনের লোকসান দেওয়ার বিষয়ে ব্যাংকটি বিনিয়োগকারীদের জানিয়েছে, বিনিয়োগের বিপরীতে খেলাপি হওয়া ঋণে বিভিন্ন হারে নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) সংরক্ষণ বেড়েছে জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে। আমানত কমে যাওয়া ও বিনিয়োগ বাড়ায় তারল্য সংকট তীব্র হয়েছে।
তথ্য অনুযায়ী, গত জুন শেষে খেলাপি ঋণের বিপরীতে বিভিন্ন হারে প্রভিশন রেখেছিল ২৫১ কোটি ৪১ লাখ টাকা। তৃতীয় প্রান্তিকে এসে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ আরো বেড়ে যাওয়ায় প্রভিশন সংরক্ষণও বেড়েছে।
গত জুন মাসে ব্যাংকটির আমানতের স্থিতি ছিল ৪৭ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকা। খেলাপির হার ছিল ৪ শতাংশে।
১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এক্সিম ব্যাংক পরে শরিয়াহ ধারার ব্যাংকিং চালু করে। ২০০৪ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকটির সারাদেশে শাখা রয়েছে ১৪৭টি। নজরুল ইসলাম মজুমদার ২০০৭ সাল থেকে এক টানা ১৭ বছর ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন। পাশাপাশি ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব ব্যাংকস, বিএবি এরও চেয়ারম্যান ছিলেন।
গত ৫ অগাস্ট ছাত্র-জনতার গণ আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান। এরপর সরকারের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক থাকা ব্যবসায়ীরা আত্মগোপনে চলে যান। নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান ও এক্সিম ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদারও সরকার ঘনিষ্ট হওয়ায় আত্মগোপনে চলে যান। পরে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
বিএবি চেয়ারম্যান থাকাকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে ঘনিষ্ট হয়েছিলেন নজরুল ইসলাম। ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করে পরিচালকদের মেয়াদ বাড়ানো ও এক পরিবার থেকে চার পরিচালক করার প্রক্রিয়ায় মূল ভূমিকা রেখেছিলেন তিনি বলে আলোচনা ছিল।
ছয় মাস আগে চলতি বছরের গত মার্চে নানা অনিয়ম ও ঋণ কেলেঙ্কারিতে ডুবতে বসা বেসরকারি পদ্মা (সাবেক ফার্মাস) ব্যাংক শরীয়াহভিত্তিক এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে ‘মার্জ’ বা একীভূত করতে চুক্তি হয়েছিল।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যস্ততায় এ উদ্যোগ নেয়ার সময় লোকসানি ব্যাংক অধিগ্রহণকে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব হিসেবে দেখার কথা বলেছিলেন নজরুল ইসলাম।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেছিলেন, ‘‘সব ব্যাংকই রাষ্ট্রের সম্পদ। এখন রাষ্ট্রের প্রয়োজনেই তাকে রক্ষা করতে হবে। রক্ষার দায়িত্বটি পালন করতে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এটিই বড় কথা, আমরা বড় ব্যাংক হিসেবে সেই দায়িত্ব নিচ্ছি।’’
ঝুলে গেছে 'ব্যাংক মার্জার', অকূল পাথারে পদ্মা
মজুমদারের 'অর্থ পাচারের' অনুসন্ধানে সিআইডি
গুলশান থেকে গ্রেপ্তার নজরুল ইসলাম মজুমদার
১৭ বছর পর নজরুল ইসলাম মজুমদার মুক্ত এক্সিম ব্যাংকের পর্ষদ
সস্ত্রীক নাফিজ সরাফাত ও নজরুলের ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ