শেয়ার কারসাজিতে সাকিবের নাম, যা বলছে বিএসইসি

দেশসেরা ক্রিকেটার সাকিব নানা ব্যবসায় যুক্ত হওয়ার পর নামেন পুঁজিবাজারে।

শেখ আবু তালেববিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 Sept 2022, 03:19 PM
Updated : 14 Sept 2022, 03:19 PM

শেয়ার কারসাজির অভিযোগে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) এক তদন্ত প্রতিবেদনে নাম উঠেছে ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের; যাকে বাজার উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে ২০১৭ সালে শুভেচ্ছা দূত করেছিল বিএসইসি।

ব্যক্তিগতভাবে ও মালিকানায় থাকা প্রতিষ্ঠানের বিও হিসাবের মাধ্যমে সাকিবের বিরুদ্ধে শেয়ার কারসাজির অভিযোগটি তদন্ত করছে বিএসইসি।

ইতোমধ্যে সাকিবের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। আর কারসাজিতে জড়িত প্রমাণিত হলে কেউ শাস্তি এড়াতে পারে না, বলছেন বিএসইসির মুখপাত্র রেজাউল করিম।

দেশসেরা ক্রিকেটার সাকিব নানা ব্যবসায় যুক্ত হওয়ার পর নামেন পুঁজিবাজারে, যৌথ অংশীদারিত্বে খোলেন ব্রোকারেজ হাউজ মোনার্ক হোল্ডিংস।

সাকিব এখন ওয়েস্ট ইন্ডিজে রয়েছেন বলে তার কোনো বক্তব্য পাওয়া পাওয়া যায়নি। এর আগে মোনার্ক হোল্ডিংস সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলেও তিনি বলেছিলেন, তিনি খেলা ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে মন্তব্য করবেন না।

২০১৭ সালে ‘বিশ্ব বিনিয়োগকারী সপ্তাহ’ পালনের এক অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা দূত হিসেবে সাকিবের সঙ্গে চুক্তির ঘোষণা দিয়েছিলেন তৎকালীন বিএসইসি চেয়ারম্যান এম খায়রুল হোসেন। ওই অনুষ্ঠানে সাকিবও বক্তব্য দিয়েছিলেন। এখন তিনিই তদন্তের মুখে।

বিএসইসিতে জমা পড়া একাধিক প্রতিবেদন দেখতে পেয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। আর সাকিবকে কারণ দর্শানোর একটি নোটিস বিএসইসির ওয়েবসাইটেও প্রকাশিত হয়েছে।

সম্প্রতি ওয়ান ব্যাংক, বিডিকম, সোনালী পেপারস, ফরচুন শুজসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের শেয়ারদর অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ার কারণ খতিয়ে দেখতে উদ্যোগ নেয় পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা।

প্রাইমারি রেগুলেটর হিসেবে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জও (ডিএসই) তদন্ত দল গঠন করে অভিযোগটি খতিয়ে দেখে। দুটি প্রতিবেদনেই সাকিব এবং তার মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ‘মোনার্ক হোল্ডিংস’র নাম আসে।

Also Read: বেটিং সাইটের সঙ্গে সাকিবের সংযোগ খতিয়ে দেখছে বিসিবি

Also Read: সোনার ব্যবসায় সাকিব

Also Read: সাকিবের কোম্পানিকে বিএসইসির নোটিস

ওয়ান ব্যাংকের শেয়ার কারসাজি

গত বছরের শেষের দিকে তালিকাভুক্ত ওয়ান ব্যাংকের শেয়ারদরের অস্বাভাবিক বাড়ার কারণ দেখতে ডিএসই একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে।

ব্যাংকটির শেয়ারদর গত বছরের ১৫ থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে ১২ টাকা ৬০ পয়সা থেকে বেড়ে ২০ টাকা ১০ পয়সা বা ৫৯ দশমিক ৫২ শতাংশ বাড়ে, যা অস্বাভাবিক মনে হয় বাজার সংশ্লিষ্টদের কাছে।

এই সময়ে ব্যাংকটির প্রধান ক্রেতাদের তালিকা করে ডিএসইর তদন্ত কমিটি দেখতে পায়, ১৫ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান সর্বোচ্চ সংখ্যক শেয়ার কেনাবেচা করেছে, যার ফলে এই স্বল্প সময়ের মধ্যে শেয়ারটির দর বেড়ে যায়।

এরমধ্যে শুধু সাকিব আল হাসান কেনাবেচা করেছেন ৮৫ লাখ ২১ হাজার শেয়ার, যার মধ্যে ৭৫ লাখের বেশি শেয়ার কেনা হয়।

শেয়ারটি কেনাবেচায় জড়িত অন্যরা হচ্ছে পুঁজিবাজারে সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে আলোচিত প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মচারী সমবায় অধিদপ্তরের (বিসিএস ক্যাডার ৩১ ব্যাচ) ডেপুটি রেজিস্ট্রার মো. আবুল খায়ের হিরু ও তার স্ত্রী কাজী সাদিয়া হাসান, হিরুর বাবা আবুল কালাম মাতবর ও বোন কনিকা আফরোজ।

বলা হয়, এ চক্রের নেতা হিরুর মাধ্যমে ১৩টি বিও হিসাবের মাধ্যমে ওয়ান ব্যাংকের শেয়ার ‘সিরিজ ট্রেডিং’ করে কৃত্রিমভাবে দর বাড়ানো হয়। শেয়ার কেনাবেচায় সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয় আবুল খায়ের হিরুর বাবা আবুল কালাম মাতবরের বিও হিসাব।

এ দলকে ডিএসইর প্রতিবেদনে ‘আবুল কালাম মাতবর অ্যান্ড হিজ অ্যাসোসিয়েটস’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এই সময়ে একটি দিনে ওয়ান ব্যাংকের লেনদেন হওয়া শেয়ারের প্রায় ৮৫ শতাংই কিনেছিল এই চক্র। সরাসরি বাজার থেকে শেয়ার কেনাবেচার পাশাপাশি ‘ব্লক’ মার্কেট  থেকেও একইভাবে কেনা হয়।

আবার চক্রটির সদস্যরা নিজেদের মধ্যেও শেয়ার কেনাবেচা করেছে বলে ডিএসইর তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

এভাবে শেয়ারদর বাড়িয়ে চক্রটি ১৪ কোটি ৩৫ লাখ টাকার বেশি ক্যাপিটাল গেইন অর্থাৎ শেয়ার বিক্রি করে মুনাফা করেছে শুধু ১৫ দিনেই। দর বাড়ার কারণে তাদের হাতে থাকা শেয়ার বিক্রি করে আরও ১৪ কোটি ৩৮ লাখ টাকা মুনাফা করার সুযোগ রয়েছে।

এটিকে ‘সিরিজ ট্রেড’ উল্লেখ করে বিএসইসির তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘‘যা দি সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অর্ডিন্যান্স, ১৯৬৯ এর অনুচ্ছেদ ১৭ এর লঙ্ঘন।”
ওই অনুচ্ছেদে বলা আছে, সরাসরি বা পরোক্ষাভাবে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কোনো শেয়ার এমনভাবে ক্রয়-বিক্রয় করতে পারবে না, যাতে তার দর বৃদ্ধি বা সুবিধা কেউ নিতে পারে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, “এটি প্রমাণ হয়েছে যে আবুল কালাম মাতবর অ্যান্ড হিজ অ্যাসোসিয়েটেস প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দুইভাবেই ১৩টি বিও হিসাব ব্যবহার করে ওয়ান ব্যাংকের শেয়ার সিরিজ ট্রেডিং ও দর বৃদ্ধি করেছে।”

বিধি লঙ্ঘনের জন্য ‘আবুল কালাম মাতবর অ্যান্ড হিজ এসোসিয়েটস’কে গত ২ অগাস্ট বিএসইসি ৩ কোটি টাকা জরিমানা করে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

বিডিকমের শেয়ার কারসাজি

বিডিকম নামের তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ারে কারসাজির অভিযোগও তদন্ত করেছে ডিএসইর গঠন করা তদন্ত কমিটি।

সেই তদন্ত কমিটির তথ্য বিশ্লেষণ করে বিএসইসির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, চলতি বছরের গত ৭ মার্চ থেকে ১০ মার্চ পর্যন্ত সময়ে বিডিকমের শেয়ার দর ২৩ টাকা ৬০ পয়সা থেকে ৩৪ টাকা ৩০ পয়সা বা ৪৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।

এই সময়ে শেয়ারটির প্রধান ক্রেতা-বিক্রেতার তালিকায় দেখা যায় আবুল খায়ের হিরু, তার স্ত্রী কাজী সাদিয়া হাসান, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান সমবায় অধিদপ্তরের ডিআইটি কো-অপারেটিভ লিমিটেডের চেয়ারম্যান হিসেবে থাকা আবুল খায়ের হিরু, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান আইসিবি (ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ), মোনার্ক হোল্ডিংস লিমিটেডের নাম।

মোনার্ক হোল্ডিংসের অংশীদারদের মধ্যে সাকিব ছাড়াও রয়েছেন আবুল খায়ের হিরুর স্ত্রী কাজী সাদিয়া হাসান, হিরুর বাবা আবুল কালাম মাতবর, হিরুর বোন কনিকা আফরোজ।

এ বছরের শুরুতেই মোনার্ক হোল্ডিংসকে ব্রোকারেজ হাউজ হিসেবে অনুমোদন দেয় পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি।

বিডিকমের ক্ষেত্রে ৫টি বিও হিসাব ব্যবহার করে সবচেয়ে বেশি লেনদেন করা হয়েছে। তা হচ্ছে ব্যক্তিগত বিও হিসাবে কাজী সাদিয়া হাসান, আবুল খায়ের হিরু ও কাজী সাদিয়া হাসানের নামের যৌথ হিসাব, মোনার্ক হোল্ডিংস লিমিটেড।

বিডিকমের শেয়ার কেনাবেচায় চেয়ারম্যান হিসেবে আবুল খায়ের হিরু সর্বোচ্চ ব্যবহার করেছেন ডিআইটি কো-অপারেটিভ লিমিটেডের বিও হিসাব।

বিডিকমের শেয়ার কারসাজি তদন্তে ডিএসইর প্রতিবেদনে এই পাঁচ বিও হিসাবধারীকে উল্লেখ করা হয়, ‘ডিআইটি কোঅপারেটিভ অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস’।

অনৈতিকভাবে শেয়ার দর বাড়ানোর বিষয়ে ডিএসইর তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির পক্ষ থেকে কারণ দর্শানোর নোটিস দেওয়া হয়েছিল। ওয়ান ব্যাংক ও বিডিকমের বিষয়ে দু’বারই সবার পক্ষে লিখিত জবাব দেন আবুল খায়ের হিরু।

জবাব দুটি গ্রহণ করে বিএসইসির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ডিআইটি কোঅপারেটিভ লিমিটেড অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস ও আবুল কালাম মাতবর অ্যান্ড হিজ অ্যাসোসিয়েটসের বক্তব্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে, উপস্থাপিত অভিযোগগুলো সঠিক।

বিডিকমের শেয়ারদর কারসাজি করে বাড়ানোয় ‘ডিআইটি কোঅপারেটিভ অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস’কে গত ২ অগাস্ট ৫৫ লাখ টাকা জরিমানা করে বিএসইসি।

বিএসইসির অভিযোগের বিষয়ে হিরুর বক্তব্য জানতে বুধবার তাকে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি ধরেননি। এসএমএস পাঠালেও তিনি সাড়া দেননি।

যা বলছে বিএসইসি

তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসইসির মুখপাত্র ও নির্বাহী পারিচালক মো. রেজাউল করিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শেয়ারদর বৃদ্ধির কারণ খুঁজতে একটি নির্দিষ্ট সময়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখে তদন্তকারীরা। সিকিউরিটিজ বিধান লঙ্ঘন হলে তার বিপরীতে তাদের ব্যাখ্যা চাওয়া হয়।

“তিনি বা তার প্রতিনিধির মাধ্যমে এর ব্যাখ্যা সশরীরে এসে কমিশনে দিতে হয়। সেই ব্যাখ্যায় সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হলেই শাস্তি দেওয়া হয়। এখানেও এই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে।”

সাকিব আল হাসানের সম্পৃক্ততার বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসইসির মুখপাত্র রেজাউল কারও নাম না ধরে বলেন, “প্রাতিষ্ঠানিকের ক্ষেত্রে মোনার্ক হোল্ডিংস বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের শেয়ার হোল্ডাররা এ শাস্তির আওতায় আসবে না। কিন্তু পরিচালক হলে তিনি শাস্তির মধ্যে পড়বেন।”