বিশ্বকাপ জিতলেই কেবল পূর্ণতা পাবে মেসির বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার।
Published : 27 Nov 2022, 10:32 PM
ড্রেসিং রুমে টেবিলের ওপরে এমিলিয়ানো মার্তিনেস নাচছেন আর গাইছেন। আশেপাশে কোচ লিওনেল স্কালোনি, অধিনায়ক লিওনেল মেসি, অন্য খেলোয়াড় ও কোচিং স্টাফরা। সবাই দুই হাত শূন্যে ছুঁড়ছেন আর গাইছেন- “বন্ধুরা, এখন আমরা আবার রোমাঞ্চিত, তৃতীয় বিশ্বকাপ জিততে চাই, বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হতে চাই।”
লুসাইল স্টেডিয়ামে মেক্সিকোর বিপক্ষে জয়ের পর মাঝরাতে আর্জেন্টিনার ড্রেসিং রুমের দৃশ্য এটি। তাদের উদযাপনের ওই ভিডিও রোববার দিন জুড়ে ঘুরছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
মেসিদের অমন উদযাপনে অনেকের হয়তো মনে হতে পারে, আর্জেন্টিনা কি বিশ্বকাপ জয়ের খুব কাছে চলে গেছে নাকি! নাহ, তেমন কিছু এখনও হয়নি। বিশ্বকাপ জিততে বরং পাড়ি দিতে হবে আরও দীর্ঘ পথ। তবে ওই উদযাপন, ওই আনন্দ একটা ফাঁড়া কেটে যাওয়ার, কাঁধ থেকে বিশাল এক বোঝা নেমে যাওয়ার, ক্যারিয়ারের গোধূলি লগ্নে চলে আসা মেসির একটি বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখার।
দারুণ প্রতিভাবান একটি দল নিয়ে এবার কাতারে পা রাখে আর্জেন্টিনা। যেখানে সাড়ে তিন বছরের অপরাজেয় পথচলা, ৩৬ ম্যাচের অপরাজিত যাত্রা, মাঝে কোপা আমেরিকা জিতে দেশের ২৮ বছরের শিরোপা খরা কাটানোর তৃপ্তি তাদের সঙ্গী। কিন্তু সবকিছু যেন এক নিমিষেই ধূলিসাৎ হতে বলেছিল।
টুর্নামেন্টের ফেভারিট দলগুলির একটি হিসেবে বিশ্বকাপ শুরু করে প্রথম ম্যাচেই আলবিসেলেস্তেদের দেখতে হয় মুদ্রার উল্টো পিঠ। শক্তি-সামর্থ্য, ইতিহাস-ঐতিহ্য, র্যাঙ্কিং- সবকিছুতে যোজন যোজন পিছিয়ে থাকা সৌদি আরবের বিপক্ষে হেরে বসে দুবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা। সঙ্গত কারণেই চার দিকে পড়ে যায় ‘হায় হায়’ রব! এই আর্জেন্টিনা কতদূরই বা যাবে।
শিরোপা তখন অনেক দূরের বাতিঘর তো বটেই, গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায়ের চোখ রাঙানি তাদের সামনে। পিঠ ঠেকে যায় দেয়ালে। মেক্সিকোর বিপক্ষে হারলে স্বাগতিক কাতারের পর দ্বিতীয় দল হিসেবে বেজে যেত বিদায় ঘন্টা। ড্র হলেও সম্ভাবনা ঝুলতে থাকত অনিশ্চয়তার সুতোয়।
প্রথমার্ধে মেসি-মার্তিনেসদের বিবর্ণ পারফরম্যান্স সেই শঙ্কা যেন আরও ঘনীভূত করে তোলে। এরপরই মেসির জাদু। ক্লাব কিংবা জাতীয় দল, লম্বা ক্যারিয়ারে কতবারই না দলকে খাদের কিনারা থেকে টেনে তুলেছেন তিনি, মুহূর্তের ঝলকে পাল্টে দিয়েছেন ম্যাচের চিত্র। ৩৫ বছর বয়সে এসে, খুব কঠিন মুহূর্তে আরও একবার তিনি দেখালেন তার জাদুকরী বাঁ পায়ের কারিশমা। বক্সের বাইরে থেকে অসাধারণ এক গোল করে দলের মাঝে বইয়ে দিলেন স্বস্তির হাওয়া। পরে একটি গোল করালেন এনসো ফের্নান্দেসকে দিয়ে।
ক্লাব ক্যারিয়ারে মেসি জিতেছেন সম্ভাব্য সব শিরোপাই। আর্জেন্টিনার হয়ে তার একটি শিরোপার অপেক্ষাও ঘুচেছে কোপা আমেরিকা দিয়ে। কিন্তু বিশ্বকাপ এখনও রয়ে গেছে অধরা। এই নিয়ে পঞ্চমবার বিশ্বকাপের আঙিনায় তার পদচারণা, সম্ভাব্য শেষ সুযোগ।
সবকিছুর ইতি ঘটে যেতে পারত প্রথম দুই ম্যাচেই। মেক্সিকোকে হারিয়ে স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখার পর মেসির কণ্ঠে তাই স্বস্তির সুর, “আমাদের কাঁধ থেকে বোঝা নেমে গেল।”
এটিকে বিশ্বকাপে নিজেদের নতুন শুরু হিসেবেও দেখছেন আর্জেন্টিনা অধিনায়ক, “আজ থেকে আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ শুরু হলো।”
কাতার আসরে এখন পর্যন্ত আর্জেন্টিনার তিন গোলের দুটিই মেসির। দুই ম্যাচে একটি করে। মেক্সিকোর বিপক্ষে গোলটি করেই তিনি ছুট দেন গ্যালারির দিকে। গোলে সহায়তা করা আনহেল দি মারিয়ার কোলে উঠে পড়েন। তার চোখ ছলছল করছিল তখন জলে। তার ছোটবেলার ‘আইডল’, বর্তমানে দলের সহকারী কোচ পাবলো আইমার বেঞ্চে তো বসে কেঁদেই দিলেন।
এই ম্যাচে মেসি দুটি জায়গায় পাশে বসেছেন কিংবদন্তি দিয়েগো মারাদোনার। বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার হয়ে মারাদোনার সবচেয়ে বেশি ২১ ম্যাচ খেলার রেকর্ড এখন যৌথভাবে মেসিরও। একক নৈপুণ্যে দেশকে ১৯৮৬ বিশ্বকাপ জেতানো মারাদোনা বিশ্ব মঞ্চে গোল করেছিলেন ৮টি, মেসির গোলের সংখ্যাও এখন তাই।
রেকর্ড-কীর্তিতে হয়তো মারাদোনার পাশে বসেছেন মেসি, কিন্তু সত্যিকার অর্থেই কি ‘৮৬ বিশ্বকাপ কিংবদন্তির পাশে বসতে পেরেছেন তিনি?
তর্কাতীতভাবে তেজস্বী মারাদোনার চেয়ে শান্ত স্বভাবের মেসির ক্যারিয়ার বেশি সমৃদ্ধ। আর্জেন্টিনার সর্বকালের সর্বোচ্চ স্কোরার তিনি। গত বছর জিতেছেন কোপা আমেরিকা। রেকর্ড সাতবার হাতে তুলেছেন বর্ষসেরার পুরস্কার ব্যালন ডি’অর।
পিএসজিতে পাড়ি জমানোর আগে বার্সেলোনায় প্রায় দুই দশকের ক্যারিয়ারে ক্লাবটির হয়ে করেছেন রেকর্ড ৬৭২ গোল। শিরোপা জিতেছেন মোট ৩৫টি। এর মধ্যে আছে চারটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, ১০টি লা লিগা শিরোপা।
তবে মারাদোনার পাশে বসতে এখনও তাকে জিততে হবে বিশ্বকাপ। এমনও সময় ছিল যখন মারাদোনার চেয়ে মেসিকে ভালোবাসা কঠিন মনে করেছে আর্জেন্টাইনরা। শৈশবে স্পেনে চলে যাওয়া, তার অন্তর্মুখী স্বভাব এবং দেশকে বিশ্বকাপ এনে দিতে না পারাই যার মূল কারণ। এমন প্রশ্নও উঠতে শুরু করেছিল, বার্সেলোনায় যতটা নিজেকে উজাড় করে দেন মেসি, জাতীয় দলেও কি দেন ততটা।
সময় বদলেছে। সেসব এখন অতীত। মেসিও এখন আর্জেন্টাইনদের প্রিয়। মেসি নিজেও দেখিয়েছেন, আর্জেন্টিনার জার্সির প্রতি তিনি কতটা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। প্রায় তিন দশকের শিরোপা খরা কাটিয়ে গত বছর দেশকে কোপা আমেরিকা জেতানোর পর তার কান্নায় ভেঙে পড়ার দৃশ্যটিও তাই বলে।
দুই বছর আগে ওপাড়ে পাড়ি জমানো মারাদোনার চেয়েও মেসির নাম, তার মুখসহ পতাকা ও ব্যানার আছে বেশি। বিশ্বকাপে জিতলে তাকেও মারাদোনার পাশে বসাতে দ্বিধা থাকবে না কারও।
আর যদি সেটা না পারেন মেসি? হয়তো মারাদোনার ছায়াতেই থাকতে হবে তাকে আজীবন। অনেক আর্জেন্টাইনের কাছে আবার মেসিই তাদের মারাদোনা। মেক্সিকো ম্যাচের পর রদ্রিগো কাস্ত্রো নামে এক আর্জেন্টাইন ভক্তের কথায়ও ফুটে উঠল তা।
“দেখেছেন গোল করার পর সে কীভাবে আমাদের কাছে দৌড়ে এসে উদযাপন করল? এই আমাদের মেসি। এখন সে আমাদের মারাদোনাও। তারা দুজন এক!”
আবেগের জায়গা থেকেই হয়তো কথাটি বলেছেন তিনি। দুজনই এক হবেন, মেসি হয়তো পূর্বসূরিকে ছাপিয়েও যেতে পারেন, যদি আগামী ১৮ ডিসেম্বর লুসাইল স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপের সোনালী ট্রফিটি তার হাতে উঠতে পারে।
স্বপ্নটা এখনও বেঁচে আছে!