আলো ঝলমলে পারফরম্যান্স করেও হারের আঁধারে ডুবে যাওয়াটা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না খেলোয়াড়ররা।
Published : 01 Jul 2023, 08:37 PM
মিক্সড জোন দিয়ে একে একে বেরিয়ে যাচ্ছেন জামাল ভূঁইয়া, আনিসুর রহমান জিকোরা। বিষন্নতার ছায়া তাদের চোখে-মুখে স্পষ্ট। কেউ কথাই বলতে চাইলেন না। কেউ জানালেন দারুণ পারফর্ম করেও হেরে যাওয়ার হতাশা। কারো কণ্ঠে বেজে উঠল শুরুতেই পাওয়া সুযোগটি নষ্ট হওয়ার আক্ষেপ। কেউ বা দুষলেন ভাগ্যকে। রেফারিকেও এক হাত নিলেন অনেকে।
বেঙ্গালুরুর শ্রী কান্তিরাভা স্টেডিয়ামে শনিবার বঙ্গবন্ধু সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের প্রথম সেমি-ফাইনালে অতিরিক্ত সময়ের গোলে ১-০ ব্যবধানে কুয়েতের বিপক্ষে হেরে যায় বাংলাদেশ। ম্যাচ জুড়ে দারুণ ফুটবলের পসরা মেলেও পরাজিতের দলে বিশ্বনাথ ঘোষ, ফয়সাল আহমেদ ফাহিমরা। কথা বলার শক্তিটুকুও যেন ফুরিয়ে গেছে অনেকের।
দারুণ বিশ্বস্ততায় রক্ষণ সামলানো কাজী তারিক তাই কোনো কথাই বলতে চাইলেন না। বাসে ওঠার আগে মাথা ডানে-বায়ে বারবার ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে শুধু বলে গেলেন, ‘কিছু বলার নেই। কিচ্ছু বলার নেই।’
জামাল ভূঁইয়া ক্ষোভ উগরে দিলেন ভারতীয় রেফারি জন ক্রিস্টালের উপর। ম্যাচে রেফারির অনেক সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের বিপক্ষে গিয়েছে বলে দাবি অধিনায়কের।
“আমরা অনুভব করেছি, ১২০ মিনিট রেফারি আমাদের বিপক্ষে ছিল। একারণে আমরা একটু রাগ করেছিলাম। কুয়েতের প্লেয়াররা অনেক ভুল করেছে, কিন্তু রেফারি ফাউল দেয়নি। এ কারণে আমাদের মনে হয়েছে রেফারি আমাদের বিপক্ষে ছিল।”
দিনের দ্বিতীয় সেমি-ফাইনালে লেবাননের বিপক্ষে ভারতের ম্যাচ বলে আগেই গ্যালারিতে এসেছিলেন বেশ কিছু ভারতীয় সমর্থক। প্রথম সেমি-ফাইনাল শেষে দাঁড়িয়ে, করতালি দিয়ে জামালদের অভিনন্দন জানিয়েছেন তারা। এ নিয়ে আনন্দ থাকলেও ম্যাচ হারায় হতাশ অধিনায়ক।
“ভারতীয় সমর্থকরা আমাদের অভিনন্দন জানিয়েছে। এটি দারুণ ব্যাপার। আমি ছেলেদের নিয়ে গর্বিত। কেননা, আমরা ভালো সুযোগ পেয়েছি, কিন্তু গোল পাইনি। সব মিলিয়ে আমরা ভালো পারফর্ম করেছি। তাই (হেরেছি) বলে হতাশ।”
অধিনায়কের সুরে সুর মেলালেন অভিজ্ঞ ডিফেন্ডার তপু বর্মন। ম্যাচের ভাগ্য গড়ে দেওয়া গোলটি তার পায়ের ফাঁক দিয়েই করেন কুয়েতের ডিফেন্ডার আব্দুল্লাহ আল বোলৌশি।
“কিছুই বলার নেই, রেফারি আমাদের শেষ করে দিয়েছে। নাথিং টু সে। নাথিং টু সে।”
বদলি নামা উইঙ্গার মোহাম্মদ ইব্রাহিমের কণ্ঠে ঝরল অন্যরকম আক্ষেপ। কুয়েত ও লেবাননের মতো শক্তিশালী দল এবার অতিথি হিসেবে না এলে বাংলাদেশ ফাইনাল খেলত বলে মনে করেন তিনি।
“অনেক খারাপ লাগছে। আমরা শেষ পর্যন্ত লড়াই করেছি। অনেক ভালো খেলেছি। জয়ের জন্য মাঠে নেমেছিলাম, সবাই জান-প্রাণ দিয়ে চেষ্টা করেছে। দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কিছু বলার নেই। রেফারি আমাদের সঙ্গে অনেক ইয়ে (ভুল সিদ্ধান্ত) করেছে। অনেক ফাউল করেছে ওরা, কিন্তু রেফারি ফাউল দেয়নি।”
“একটা বিষয় একবার ভাবুন, সাফের বাইরে এই দুইটা দল যদি না আসত, তাহলে আমাদের অবস্থান কোথায় থাকত। তবে তারা এলেও আমরা সেভাবে প্রস্তুত ছিলাম। মাঠে সেভাবে খেলছিলামও, কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য।”
অবশ্য এই হার থেকে সামনের পথ চলায় অনুপ্রেরণা খুঁজে নিতে চান ইব্রাহিম। জানালেন, কুয়েতের চোখে চোখ রেখে লড়াইয়ের আত্মবিশ্বাস নিয়েই মাঠে নেমেছিলেন তারা।
“কোচ বলেছিলেন, আমরাও পারি। লেবানন ম্যাচের পর থেকে আমরা ম্যাচ বাই ম্যাচ উন্নতি করছিলাম। কোচ আমাদের বলেছিলেন, চেষ্টা করলে আমরাও পারব, আমরা সেই আত্মবিশ্বাস নিয়ে নেমেছিলাম।”
“এই হার থেকে সামনে আরও ভালো খেলার অনুপ্রেরণা অবশ্যই পাব। আমরা লেবাননের মতো দলের বিপক্ষে খেলেছি। কুয়েতের বিপক্ষে ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়েছে, আমরা ভালো খেলেছি। রক্ষণ গোছালো ছিল, সবকিছুই ভালো ছিল। এই ম্যাচ থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে সামনে আরও ভালো করতে চাই।”
তরুণ ফরোয়ার্ড ফয়সাল আহমেদ ফাহিম এক কথায় বুঝিয়ে দিলেন এই হার থেকে শিখতে চান তারা, ‘অবশ্যই এখান থেকে আমরা শিখব। ইচ্ছা তো থাকেই সামনে এগিয়ে যাওয়ার, সবাই দোয়া করবেন। আমাদের চেষ্টা ছিল, আমরা সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করেছি, কিন্তু হয়নি।’
আরও একবারে শেষ মুহূর্তের গোলে স্বপ্ন ভঙ্গের হতাশার অনলে পুড়ছেন বিশ্বনাথ ঘোষ। বুঝে উঠতে পারছেন না তাদের সঙ্গেই কেন এমন হয়। দ্বিতীয় মিনিটে মোরসালিনের সুবর্ণ সুযোগ নষ্ট করা, ৬০ মিনিটে রাকিবের শট ক্রসবার কাঁপিয়ে ফেরা নিয়ে আফসোসের শেষ নেই তার।
“সবসময় তো আমরা সান্ত্বনা নিয়েই দেশে ফিরি। এবার আমাদের আশা ছিল আরও বেশি। মাঠে নামার আগে, নামার পরে, এমনকি টিম ব্রিফিংয়ে আমি বারবার বলেছি, আমরা যদি পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা রাখি, তাহলে আমরা কুয়েত বাধা পেরুতে পারব। কিন্তু দিনটি আসলে আমাদের ছিল না।”
“শুরুতেই আমরা যে ওপেন চান্স মিস করেছি, সেটা কাজে লাগাতে পারলে হয়তো ফল আমাদের পক্ষে থাকত। আমরা বরাবরই দুর্ভাগা। মাঠে এবার রেফারিও অনেক সিদ্ধান্ত আমাদের বিপক্ষে দিয়েছে। যদি কিছু ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আমাদের পক্ষে দিত, তাহলে হয়তো আমরা ভালো কিছু করতে পারতাম।”
ডাকতেই অনুনয়ের সুরে রাকিব কথা বলতে রাজি হলেন না। কথা বলতে চাইছিলেন না দ্বিতীয় মিনিটে দলকে এগিয়ে নেওয়ার সেরা সুযোগটি নষ্ট করা মোরসালিনও। তবে এই তরুণ প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেলেন, কুয়েত ম্যাচের না পারা থেকে শিখবেন আগামীতে।
“আপনারা আমাদের জন্য দোয়া করবেন। আমরা অনেকটা সময় ভালো খেলেছিলাম, সুযোগ তৈরি করেছিলাম, কিন্তু আল্লাহ আমাদের সহায় হয়নি, চেষ্টা করব সামনে ভালো কিছু করার।”