সৌদি আরবের বিপক্ষে হারার পর আর ভুল করার কোনো সুযোগ নেই লিওনেল মেসি-আনহেল দি মারিয়াদের।
Published : 22 Nov 2022, 09:11 PM
সেই ২০১৯ সালের ২ জুন, চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিলের বিপক্ষে হেরে কোপা আমেরিকার সেমি-ফাইনাল থেকে বিদায়- সেদিনের সেই কষ্টটাকে যেন শক্তিতে রুপান্তর করেছিল আর্জেন্টিনা। সুন্দর, দাপুটে, চোখ জুড়ানো ফুটবলের যাত্রায় হারের স্বাদ কেমন লাগে, তা হয়তো ভুলেই গিয়েছিল তারা। কিন্তু, আকাশছোঁয়ার অভিযানে নেমেই লাগল প্রচণ্ড এক ধাক্কা। শক্তিতে অনেক পিছিয়ে থাকা সৌদি আরবের গতিময় ফুটবল এলো দমকা হাওয়ার বেশে। তাতে টালমাটাল এতদিনের ছুটে চলা রথ।
দলে তারকার কমতি নেই। মধ্যমণি লিওনেল মেসি তো আছেনই, সঙ্গে আনহেল দি মারিয়া ও লাউতারো মার্তিনেস মিলে আক্রমণভাগ ভয়ঙ্কর। চোট কাটিয়ে ওঠার পথে পাওলো দিবালা। তিনি ফিরলে দলের আক্রমণভাগ হয়ে উঠবে আরও বিধ্বংসী।
রক্ষণ আর মাঝমাঠে তেমন কোনো বড় তারকা না থাকলেও, দলের প্রয়োজনে তারা দারুণ কার্যকর। গত সাড়ে তিন বছরে দলকে অপ্রতিরোধ্য করে তোলার পথেই নিজেদের কার্যকারিতাকে প্রমাণ করেছেন তারা। পোস্টের নিচে দারুণ বিশ্বস্ত, কোচের আবিষ্কার এমিলিয়ানো মার্তিনেস।
আর সবাইকে একসুতোয় গাঁথা কোচ লিওনেল স্কালোনি তো আছেনই। তিন বছর আগেও তিনি ছিলেন ‘অখ্যাত’ এক নাম। কিন্তু তারুণ্য আর অভিজ্ঞতার মিশেল ঘটিয়ে দলটিকে তিনিই তো করে তুলেছিলেন অপ্রতিরোধ্য।
হ্যাঁ, তুলেছিলেনই বলতে হচ্ছে। কারণ, এক ম্যাচেই যে উড়তে থাকা দলটিকে মাটিয়ে নামিয়ে এনেছে ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে ৫১ নম্বর সৌদি আরব।
২৮ বছরের ট্রফি খরা কাটানো দলটিকে ঘিরে প্রতিটি আর্জেন্টাইনের বুকে নতুন করে বাসা বাঁধে পুরনো সেই স্বপ্ন, ‘৩৬ বছরের খরা কাটবে এবার, আবারও মিলবে বিশ্বকাপ, মেসির মাথায় উঠবে বিশ্ব সেরার মুকুট।’ এক হারেই যেন জ্বলন্ত প্রদীপটা নিভু নিভু করছে।
বিশ্বকাপ শুরুর তিন দিন আগে শেষ প্রস্তুতি ম্যাচেও আর্জেন্টিনা ধরা দেয় চেনা রূপে; সংযুক্ত আরব আমিরাতকে ৫-০ গোলে ভাসায় তারা। ওই ম্যাচে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি ছিল চোট কাটিয়ে ফেরা আনহেল দি মারিয়ার অসাধারণ পারফরম্যান্স। ইউভেন্তুস তারকা খেলেছিলেন মাত্র ৪৫ মিনিট, তাতেই জোড়া গোল করে সুর বেঁধে দেন তিনি।
আর মেসি ছিলেন বরাবরের মতোই নান্দনিক। গোল করে ও করিয়ে দলকে নেতৃত্ব দেন সামনে থেকে।
মূল মিশনে নেমেও তিনি হাজির হলেন স্বরূপে। দ্বিতীয় মিনিটেই শাণালেন আক্রমণ, নিলেন শট। সৌদি গোলরক্ষকের দৃঢ়তায় সে যাত্রায় বিমুখ হতে হলেও দলকে বেশিক্ষণ অপেক্ষায় রাখলেন না তিনি। দশম মিনিটেই সফল স্পট কিকে এগিয়ে নিলেন দলকে।
টুর্নামেন্ট শুরুর আগে আর্জেন্টিনাকে নিয়ে কেন এত সম্ভাবনার বেলুন ফুলানো হচ্ছে, কেনইবা সেরা দুই ফেভারিটের একটি হিসেবে ধরা হচ্ছে তাদেরকে-সব উত্তর যেন মিলে গেল ওই গোলে। এবার সময়টা আর্জেন্টিনার, সময়টা এবার মেসির।
আক্রমণাত্মক ফুটবলে তারা নাজেহাল করে তোলে প্রতিপক্ষকে। পরের ২৫ মিনিটে মেসি-মার্থিনেস মিলে আরও তিনবার জালে বল পাঠান। কিন্তু প্রতিবারই ওঠে অফসাইডের পতাকা।
তাতে আর গোল না মিললেও প্রতিপক্ষকে ঠিকই চেপে ধরে রাখতে সক্ষম হয় আর্জেন্টিনা। তবে, সৌদিদের মোটেও নাড়িয়ে দিতে পারেনি তারা। যার প্রমাণও মিলে যায় দ্বিতীয়ার্ধ শুরু হতেই।
বিরতির পর খেলা শুরুর তৃতীয় মিনিটেই আর্জেন্টিনার জালে বল; সৌদি শিবিরে উল্লাস আর আর্জেন্টাইন শিবিরে নীরবতা। ওই ধাক্কা কাটিয়ে উঠবে কী, পাঁচ মিনিট পর আবারও গোল খেয়ে বসে ফেভারিটরা। ম্যাচের শুরু থেকে গলা ফাটানো আর্জেন্টাইন সমর্থকরা হতবাক, স্তব্ধ।
মেসি-মার্তিনেস-দি মারিয়ারাও তাই। চ্যাম্পিয়ন হতে হলে চ্যাম্পিয়নের মতোই তো ঘুরে দাঁড়াতে হবে। কিন্তু তারা তা পারলেন না। মাঝমাঠের সুর গেল কেটে, তাতে তৈরি হলো না আক্রমণ। সুযোগ পেয়ে দাপট দেখাল ষষ্ঠবারের মতো বিশ্ব মঞ্চে খেলতে আসা সৌদি আরব।
গত বিশ্বকাপে রাশিয়ার বিপক্ষে ৫-০ এবং ২০০২ আসরে জার্মানির বিপক্ষে ৮-০ গোলে হারের তিক্ত স্বাদ পাওয়া সৌদিদের বিপক্ষে এভাবে পথ হারানোর দায়টা কার? ম্যাচের পরপরই লাওতারো মার্তিনেস যেমন স্বীকার করে নিয়েছেন, নিজেদের ভুলেই হারতে হয়েছে তাদের, “প্রথমার্ধে আমাদের একাধিক গোল করা উচিত ছিল।”
সত্যিই তো তাই। প্রথম ৪৫ মিনিটে এতটা দাপুটে ফুটবল খেলেও কেন মাত্র একটি গোল। এটা ঠিক যে, তিনবার জালে বল তারা ঠিকই পাঠিয়েছিল; কিন্তু কাটা পড়ে অফসাইডে। তারা কিছুটা যে অভাগা ছিল, তা বলতেই হবে।
কিন্তু, কেবলই কি দুর্ভাগ্য?
ডিফেন্স অনেক উপরে এনে সৌদি আরব মারাত্মক ঝুঁকি নিয়েছিল নাকি কৌশলগত ফাঁদ পেতেছিল-সেটা বলা মুশকিল। কিন্তু মেসিরা বারবার কেন একই ভুল করলেন, কেন এড়াতে পারলেন না ফাঁদ?
যে দারুণ চাতুর্য্যে প্রতিপক্ষের জন্য ফাঁদ পেতেছিল ‘পুঁচকে’ দলটি, তাতে তাদের রক্ষণ এবং কৌশল আঁটা সৌদি কোচ এহবি হোনাহকে কৃতিত্ব দিতেই হবে। কিন্তু ঘুরেফিরে মেসি-মার্তিনেস-দি মার্তিনেসদের দায়টা চোখে সামনে উঠে আসছে বারবার। প্রথমার্ধে মোট সাতবার তারা এই এই ভুল করেছে, ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপের শেষ ষোলো থেকে বিদায় নেওয়ার আগে করেছিল এর চেয়ে একটি কম।
আর্জেন্টিনা দলের অধিকাংশ খেলোয়াড়ই ইউরোপীয় লিগে খেলেন, যেখানে প্রতিদ্বিন্দ্বতার মাত্রা চরম। আর সৌদি আরব দলটি গড়া হয়েছে তাদের ঘরোয়া লিগের খেলোয়াড়দের নিয়ে। তাদের সঙ্গে ট্যাকটিক্যালিও পেরে উঠল না তারকাখচিত আর্জেন্টিনা। পেরে উঠলেন না স্কালোনি।
যার কাঁধে চড়ে বিশ্ব জয়ের স্বপ্ন দেখছে আর্জেন্টিনার মানুষ এবং সারা বিশ্বে তাদের লাখো কোটি সমর্থক, সেই রেকর্ড সাতবারের ব্যালন ডি’অর জয়ী মেসিও কি দায় এড়াতে পারবেন?
শুরুর বাঁশি বাজতেই প্রতিপক্ষ শিবিরে ভীতি ছড়ানো, আট মিনিট পর নিখুঁত স্পট কিকে ক্যারিয়ারের ৯২তম মিনিটে গোলের আনন্দে ডানা মেলে দেওয়া-সব কিছু তো পরিকল্পনা মতোই হলো। কিন্তু এই ম্যাজিশিয়ানও বিরতির পর তার জাদুকরী ছোঁয়া ভুলে গেলেন। বলের ওপর থেকে যেন চোখ সরিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। কয়েকবার তাকে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে বল হারাতেও দেখা গেছে।
টুর্নামেন্ট শুরুর অনেক আগে থেকেই মেসিসহ আর্জেন্টিনা দলের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছিল, আসরের প্রথম ম্যাচটা ‘ট্রিকি’ হতে পারে। হলোও তাই। তাতে আন্তর্জাতিক ফুটবলে ইতালির টানা ৩৭ ম্যাচ অপরাজিত থাকার রেকর্ড ছোঁয়া হলো না।
তবে, মূল লক্ষ্য তো বিশ্বকাপ জয়। সে লক্ষ্যে টিকে থাকতে, এগিয়ে যেতে আর ভুল করার সুযোগ নেই আলবিসেলেস্তেদের সামনে।
তারা অনুপ্রেরণা খুঁজে নিতে পারে ১৯৯০ আসর থেকে। সেবার প্রথম ম্যাচে ক্যামেরুনের বিপক্ষে ১-০ গোলে হারের পর কোনোমতে নকআউট পর্বে উঠেছিল আর্জেন্টিনা। পরে তারা উঠেছিল ফাইনালে; যদিও শিরোপা লড়াইয়ে তাদের হারিয়ে দিয়েছিল পশ্চিম জার্মানি।
হতাশা, মলিনতা ঝেড়ে ফেলে ঘুরে দাঁড়ানোর লক্ষ্যে আগামী শনিবার মেক্সিকোর মুখোমুখি হবে আর্জেন্টিনা। ‘সি’ গ্রুপে তাদের আরেক প্রতিপক্ষ পোল্যান্ড।