আমি চাই মোহামেডান মোহামেডানের মতো দল হোক: আলফাজ

চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের হারিয়ে ফেডারেশন কাপের শিরোপা জয়ের পথ ধরে মোহামেডান এগিয়ে যাবে বলে আশা দলটির কোচ আলফাজ আহমেদের।

মোহাম্মদ জুবায়েরমোহাম্মদ জুবায়েরবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 May 2023, 10:50 AM
Updated : 31 May 2023, 10:50 AM

ক্লাবের ভেতরে আম গাছের তলায় কিছু চেয়ার আর একটা টেবিল পাতা। বিক্ষিপ্তভাবে। টেবিলের উপর একটা ফুলের তোড়া। ২০১৪ সালের পর মোহামেডানকে ভুলতে বসা শিরোপা স্বাদ ফিরিয়ে দেওয়া কোচ আলফাজ আহমেদ এলেন। চোখে মুখে উচ্ছ্বাসের ছিটেফোঁটাও নেই তার! ‘সাদা-কালো’ জার্সিধারীদের কোচ সাদা-মাটাভাবেই বলে গেলেন চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আবাহনীকে হারানোর তৃপ্তি, সামনের মৌসুম নিয়ে ভাবনাসহ আরও অনেক কিছু। 

কুমিল্লার শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্টেডিয়ামে মঙ্গলবার ফেডারেশন কাপের শ্বাসরুদ্ধকর ফাইনালে আবাহনীকে টাইব্রেকারে ৪-২ গোলে হারায় মোহামেডান। ভরপুর উত্তেজনা ও পেন্ডুলামের মতো দুলতে থাকা ম্যাচের নির্ধারিত ও অতিরিক্ত সময়ের খেলা শেষ হয়েছিল ৪-৪ সমতায়।

মর্যাদা আর ঐতিহ্যের লড়াই জেতা আলফাজের কথা শুনতে তাই মোহামেডান ক্লাবের আঙিনায় বুধবার ভর দুপুরে পা রাখা। বাতি লাগানোর কাজ চলছে, ভেতরে দুটো ব্যানার টাঙানো, সেখানে অভিনন্দন বার্তা লেখা, যদিও ব্যানারে ফেডারেশন কাপ জয়ী দলের বা কোচের ছবি নেই! ১৪ বছর পর ফেডারেশন কাপ এবং ২০১৪ সালের পর প্রথম ট্রফি জয়ের উন্মাদনার আচঁও পাওয়া গেল না তেমন! তবে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আলাপচারিতায় আলফাজ কথা বললেন মনের আগল খুলে। 

এখানে তেমন কোনো আয়োজন দেখছি না…

আলফাজ আহমেদ: (হাসি) দিনের বেলা বলে বাতি জ্বালাতে পারছে না। রাতে এলে উৎসব দেখতে পারবেন। সামনে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ (২ জুনের লিগ ম্যাচের প্রতিপক্ষ বসুন্ধরা কিংস) আছে, সে কারণেই ক্লাব কর্মকর্তারা সেভাবে উদযাপন করতে চায়নি। ছোটখাট উদযাপন হয়েছে।

জমজমাট ফাইনাল হলো, সেখানে উদযাপন-উন্মাদনার কমতি ছিল না, ঢাকা ডার্বি ফুটবলের নতুন জাগরণ ঘটাতে পেরেছে বলে মনে করেন?

আলফাজ: অবশ্যই পেরেছে। মোহামেডান-আবাহনীর ডার্বির যে উত্তেজনা, সেটা নতুনভাবে ফিরে এসেছে। নতুন প্রজন্ম এটা হয়ত আগে উপলব্ধি করতে পারেনি, কিন্তু গণমাধ্যমের প্রচার-প্রচারণার কারণে নতুন প্রজন্ম এটা নতুন করে জানতে পেরেছে। যে সমর্থকরা ফুটবলমুখী ছিল না, ঘুমিয়ে ছিল, অনেক দিন ট্রফি না জেতায় মোহামেডানের খবর ঠিকঠাক রাখত না, খবর নিতেও চাইত না, যেহেতু তারা জানত মোহামেডানের কোনো রেজাল্ট নাই…তারাও জেগে উঠেছে। ফুটবল খেলায় যে আনন্দ আছে, কাল সেটার প্রমাণ হয়েছে।

ফাইনালে মাঠে দর্শকের উপস্থিতি ছিল বেশ। এমন ফাইনালের পর ফুটবল সমর্থকদের মাঠমুখী করা সম্ভব?

আলফাজ: অবশ্যই সম্ভব। ৪-৪ গোলের ড্র, উত্থান-পতন ছিল ম্যাচজুড়ে। সবকিছু মিলিয়ে যদি দেখেন, আসলে সবশেষ বিশ্বকাপের খেলার মতো মিল ছিল। আমার মনে হয়, এখানে যারা দর্শক ছিল মাঠে এবং টিভির সামনে, তারা এই খেলা উপভোগ করেছে। এখন ক্লাব, ফেডারেশন সবার উচিত এই ফাইনালকে ঘিরে ফুটবলকে আরও সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা। আমি করি, এখন এটা খুবই কাজে দিবে। 

একটু পেছন ফিরে তাকানো যাক, ধুঁকতে থাকা মোহামেডানের দায়িত্ব নিয়েছিলেন মৌসুমের মাঝ পথে। কোন স্পর্শে দলকে বদলে দিলেন?

আলফাজ: চেষ্টা করেছি কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে ছেলেদের ফিটনেস লেভেল এবং স্ট্যামিনা উঁচুতে তোলার। প্রথম লেগে (প্রিমিয়ার লিগে) আমাদের ছেলেদের মধ্যে এই বিষয়গুলোর অভাব ছিল। স্ট্রেন্থে ঘাটতি ছিল, টিম স্পিরিট- সবদিকে প্রথম লেগের চেয়ে দ্বিতীয় লেগে পার্থক্য ছিল। ফিটনেস, স্ট্যামিনা নিয়ে কাজ করেছি। রোজার মাসেও ছেলেরা কঠোর পরিশ্রম করেছে, তাদের মধ্যে কোনো জড়তা ছিল না। ওই সময় আমার মনে হয়েছে, খেলোয়াড়রা ক্লাবের জন্য কিছু একটা করতে চায়। লিগে একটা পজিশনের ব্যাপার আছে, ফেডারেশন কাপ ছিল, এখানে তারা কিছু একটা করতে চায়। সে অনুযায়ী তারা পরিশ্রম করেছে এবং সেই পরিশ্রমের ফল এই সাফল্য।

আর কিছু?

আলফাজ: টিমের ৩২ জন খেলোয়াড়কে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করেছি। ছেলেদের বোঝাতে পেরেছি, আমরা যদি সবাই এক হয়ে চেষ্টা করি, তাহলে ভালো কিছু সম্ভব। ছেলেরাও খুব শৃঙ্খলার মধ্যে ছিল, সদিচ্ছা ছিল ভালো কিছু করার। আমি মনে করি, এই সাফল্যের পুরো কৃতিত্ব খেলোয়াড়দের।

বিশেষ করে আমি ধন্যবাদ জানাব শন লেনকে। দুই বছর তার সাথে কাজ করেছিলাম। অনেক কিছু শিখেছি। ফুটবলে সাফল্যের মূল চাবিকাঠি হচ্ছে পরিশ্রম, এর কোনো বিকল্প নেই। ফুটবলারদের আমি বুঝিয়েছি, কঠোর পরিশ্রম করতে হবে এবং তারা সেটা করেছে বলে ফল পেয়েছে।

খেলোয়াড় হিসেবে আগেও সাফল্য পেয়েছেন। কোচ হিসেবে এই প্রথম। ডাগআউটের চাপ কেমন অনুভব করলেন, বিশেষ করে ফাইনালে?

আলফাজ: আসলে ২-০ গোলে পিছিয়ে পড়ার পর ভাবছিলাম কিভাবে ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব। কোথায় কাকে ইন করাবো, কাকে আউট করব, এগুলো নিয়ে ভীষণ চিন্তিত ছিলাম। একসময় এমনও মনে হচ্ছিল, এই ম্যাচটাতে মনে হয় ঘুরে দাঁড়াতে পারব না। বিরতির সময় ড্রেসিংরুমে গিয়ে তিনটা পরিবর্তন করলাম। যাকে যে দায়িত্ব দিয়েছিলাম, তারা সেটা পূরণ করেছে। ওই একটা মোমেন্টাম, শাহরিয়ার ইমন ও জাফর ইকবাল আক্রমণাত্মক মুডে ছিল, একটা গোল খাওয়ার পর ওই সময়টা আবাহনীর ডিফেন্স আরও পাজল হয়ে গিয়েছিল। আসলে এগুলোই খেলার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে।

খেলোয়াড়দের মধ্যে এই বিশ্বাসটুকু তৈরির চেষ্টা করেছি যে, তোমরা পারো, তোমরা পারবে, তোমরা এই ম্যাচটাও জিততে পারবে। ছেলেরা বিশ্বাস করেছিল বলেই ফাইনালে আবাহনীকে হারানো সম্ভব হয়েছে।

কিন্তু দায়িত্ব নেওয়ার সময় আপনি কি বিশ্বাস করেছিলেন শিরোপা নিয়ে মৌসুমটা শেষ করবে মোহামেডান?

আলফাজ: আমি যখন দায়িত্ব নেই, তখন অবশ্য আমাদের টিম ফেডারেশন কাপের কোয়ার্টার-ফাইনালে উঠে গিয়েছিল। তবে সত্যি বলতে, ট্রফি জিততে পারব, এমনটা আশা করিনি। কিন্তু আত্মবিশ্বাস ছিল ভালো অবস্থানে থাকব।

এখন সামনের মৌসুমের লক্ষ্য কী? মোহামেডান কি এই সাফল্যের ছোঁয়ায় নতুন করে জেগে উঠবে? নাকি…

আলফাজ: আমি একজন ফুটবলার ছিলাম, এখন কোচ, কিন্তু সংগঠক নই। মোহামেডান ক্লাবের কর্মকর্তারা আছেন, তাদের উদ্যোগ নিতে হবে, কিভাবে মোহামেডান টিম সামনের দিকে চলবে, সামনে এগুবে-এগুলো তাদের ব্যাপার। আমাকে যদি দায়িত্ব দেওয়া হয়, তাহলে কোচ হিসেবে নিজের সেরাটুকু দেওয়ার চেষ্টা করব।

ফেডারেশন কাপ জয়ের সুবাদে এএফসি কাপের পরের মৌসুমে খেলার সুযোগ পাবে মোহামেডান। কিন্তু ক্লাব লাইসেন্স নেই বর্তমানে…

আলফাজ: আশা করি, সামনের দিকে অবশ্যই ক্লাব এটা করবে। তারা অবশ্যই উদ্যোগ নেবে। অনেক দিন পর এএফসির প্রতিযোগিতায় খেলার সুযোগ মোহামেডানের অবশ্যই নেওয়া উচিত এবং আমি মনে করি, ক্লাবের যদি সুযোগ থাকে সেটা নেওয়ার, ক্লাব নিবে।

আগামী মৌসুমেও কি আপনাকে দেখা যাবে মোহামেডানের ডাগআউটে?

আলফাজ: এখনও আমার সাথে সেরকম কথাবার্তা হয়নি। ক্লাব যদি আমাকে চায়, তাহলে আগামী বছরে থাকব। 

যদি রাখে, তাহলে কী চাইবেন, বিশেষ করে দল গঠন নিয়ে?

আলফাজ: যদি আমাকে রাখে, আমি চাইব মোহামেডান মোহামেডানের মতো দল হবে। লিগ শিরোপার দ্বারপ্রান্তে যেতে পারি বা শিরোপা জিততে পারি। শক্তিশালী দল তৈরি করবে ক্লাব কর্তৃপক্ষ।