বিশ্বকাপে নতুন ভূমিকায় ফ্রান্সের সাফল্যে বড় অবদান রাখছেন অঁতোয়ান গ্রিজমান।
Published : 15 Dec 2022, 05:56 PM
অঁতোয়ান গ্রিজমানের মূল পরিচয় ফরোয়ার্ড। ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ সময় তার কেটেছে উইংয়ে কিংবা স্ট্রাইকারের ঠিক পেছনে ‘নাম্বার টেন’ হিসেবে খেলে। তবে দিদিয়ে দেশমের ফ্রান্স দলে এখন তার পজিশন ভিন্ন। কাতার বিশ্বকাপে একজন ‘জেনুইন’ মিডফিল্ডার হিসেবে নিজেকে নতুন করে উদ্ভাবন করেছেন তিনি। খেলছেন ‘নাম্বার এইট’ ভূমিকায়। তাতে সাফল্যও মিলছে ঢের। সবচেয়ে বড় লাভটা হচ্ছে ফ্রান্সের। টানা দ্বিতীয়বারের মতো তারা উঠে গেছে ফাইনালে।
ফ্রান্সের ২০১৮ বিশ্বকাপ জয়ে বড় অবদান ছিল পল পগবা ও এনগোলো কঁতের। মিডফিল্ডে সুরটা বেঁধে দিতেন এই দুজন। চোটের কারণে মাঝমাঠের এই দুই সেনানীকে কাতার বিশ্বকাপে পাননি কোচ দেশম। তাই গ্রিজমানকে খেলাচ্ছেন সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার হিসেবে।
ফ্রান্সের ১৯৯৮ বিশ্বকাপ জয়ী দলের সদস্য দেশম নিজেও খেলোয়াড়ী জীবনে ছিলেন মিডফিল্ডার। নতুন ভূমিকা গ্রিজমান উপভোগ করছে বলেই জানালেন তিনি।
“তাকে বিভিন্ন বিষয়ে জিজ্ঞাসা করি আমি। তার পক্ষ থেকে কোনো সমস্যা নেই। কারণ, সে এতটাই নিঃস্বার্থ মানসিকতার যে, বল স্পর্শ করা ও পাস দেওয়া- দুটো বিষয়ই সে উপভোগ করে।”
“এই ভূমিকায় অবশ্যই সে কম গোল করবে। কিন্তু, সে ট্যাকল করতে ও বল পুনরুদ্ধার করতে পছন্দ করে। তার বাম পায়ে সে ভালো কিছু করতে পারে, সেট-পিসগুলিতে বেশ ভালো শট নিতে পারে।”
চার বছর আগে রাশিয়া বিশ্বকাপের তৃতীয় সেরা খেলোয়াড় হিসেবে গ্রিজমান জেতেন ব্রোঞ্জ বল। ৪ গোল করে পান রুপার বুটও। তার চেয়ে দুটি গোল বেশি করে গোল্ডেন বুট জেতেন ইংলিশ স্ট্রাইকার হ্যারি কেইন। সেবার গ্রিজমানের ২ অ্যাসিস্ট ছিল যৌথভাবে সর্বোচ্চ।
কাতার আসরে এখনও পর্যন্ত ৬ ম্যাচ খেলে কোনো গোল তিনি পাননি। তিউনিসিয়ার জালে বল পাঠালেও ভিএআরে সেটি বাতিল হয়ে যায় অফসাইডের কারণে। তবে ফাইনালের আগে তার ৩ অ্যাসিস্ট কেইন, লিওনেল মেসি ও ব্রুনো ফের্নান্দেসের সঙ্গে যৌথভাবে সর্বোচ্চ।
কোয়ার্টার-ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ২-১ ব্যবধানের জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল গ্রিজমানের। তার অ্যাসিস্ট থেকেই গোল দুটি করেন অহেলিয়া চুয়ামেনি ও অলিভিয়ে জিরুদ।
সেমি-ফাইনালে মরক্কোর বিপক্ষে ২-০ গোলের জয়েও গ্রিজমান অবদান রাখেন আড়ালে থেকে। এই ম্যাচে কোনো অ্যাসিস্ট তার নেই। তবে ম্যাচের সেরা তিনিই! এতেই ফুটে উঠছে ম্যাচে তার প্রভাব।
এই ম্যাচে অন্য যে কোনো খেলোয়াড়ের চেয়ে দ্বিগুণ সুযোগ তৈরি করেন গ্রিজমান। থিও এরনঁদেজের করা প্রথম গোলে রাখেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। শুরুতে তিনিই পাস দেন কিলিয়ান এমবাপেকে। প্রথমবার এই ফরোয়ার্ড ঠিকমতো শট নিতে পারেননি। তার দ্বিতীয় প্রচেষ্টায় প্রতিপক্ষের পায়ে লেগে বল চলে যায় বাঁ দিকে এরনঁদেজের কাছে। কাঁধ সমান উঁচু বলে অ্যাক্রোবেটিক শটে গোলটি করেন এসি মিলান ডিফেন্ডার।
ম্যাচটিতে জাল অক্ষত রাখায়ও গ্রিজমানের আছে বড় অবদান। তিনবার বল ক্লিয়ার, দুটি ট্যাকল করে মরক্কোর প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দেন তিনি।
মিডফিল্ডে গ্রিজমানের মাঝে কঁতের ছায়া দেখছেন পগবা। ইউভেন্তুস মিডফিল্ডার যেমন ইনস্টাগ্রামে লিখেছেন, ‘গ্রিজমানকঁতে।’
৩১ বছর বয়সী গ্রিজমান নিজেও নতুন ভূমিকায় খেলাটা উপভোগ করছেন। কৃতজ্ঞ তিনি কোচের প্রতি।
“এই নতুন ভূমিকায় আমি পুরোপুরি স্বাধীন। এখানে আমি অবশ্যই ডিফেন্স ও আক্রমণভাগের মাঝে যোগসূত্র হতে পারি। আমার সামনে তিন খেলোয়াড় আছে (এমবাপে, জিরুদ ও উসমান দেম্বেলে), তাই বিকল্পও বেশি। কাজটা তাই আমার জন্য সহজ।”
"জাতীয় দলে সবকিছুর জন্য তার (দেশম) কাছে আমি ঋণী। আমি ফ্রান্সের জন্য সবকিছুই দিয়েছি- এই জার্সির জন্য, তার জন্যও। আমি সবকিছু করার চেষ্টা করছি, যাতে তিনি আমার প্রতি আস্থা রাখেন। আমার প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি ম্যাচ তার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতাস্বরূপ। আমি চাই, তিনি আমার জন্য গর্বিত হতে পারেন।”
গ্রিজমান শুধু বিশ্বকাপেই জ্বলে ওঠেন না। ২০১৬ ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে ফরোয়ার্ড পজিশনে খেলে গোল্ডেন বুট জিতেছিলেন ৬ গোল করে। তার গোল সংখ্যা অন্য যে কোনো খেলোয়াড়ের চেয়ে ছিল দ্বিগুণ। টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় হয়েছিলেন তিনিই।
দেশের জার্সিতে তার গুরুত্ব প্রমাণিত হয় আরেকটি তথ্যে। ফ্রান্সের সবশেষ ৭৩ ম্যাচেই খেলেছেন তিনি। এর আগে টানা ৪৪ ম্যাচ খেলে রেকর্ডটি ছিল পাত্রিক ভিয়েইরার।
২০১৪ সালে ফ্রান্সের জার্সিতে অভিষেক থেকে এখনও পর্যন্ত ১১৬ ম্যাচ খেলে ৪২ গোল করেছেন গ্রিজমান। তার চেয়ে বেশি গোল আছে কেবল থিয়েরি অঁরি (৫১) ও জিরুদের (৫৩)। গ্রিজমানের ২৮ অ্যাসিস্ট দেশের রেকর্ড। বড় টুর্নামেন্টে ২৯ ম্যাচ খেলে ১১ গোলের সঙ্গে তার অ্যাসিস্ট ৭টি।
ক্লাব ক্যারিয়ারের পুরোটায় তিনি খেলছেন স্পেনে- রিয়াল সোসিয়েদাদ, বার্সেলোনা ও আতলেতিকো মাদ্রিদে।
মাদ্রিদের দলটি থেকে ২০১৯ সালে কাম্প নউয়ে যোগ দিয়ে তেমন প্রভাব তিনি রাখতে পারেননি। মাঝে ধারে পাঠানো হয় আতলতিকোয়। চুক্তির নানা টানাপোড়েনও ছিল। এরপর পাকাপাকিভাবে তাকে কিনে নেয় আতলেতিকো। এখন আবার তিনি ফুটবল উপভোগ করছেন, জাতীয় দলে নতুন ভূমিকাও।
টানা দুইবার বিশ্বকাপ জিততে তার ও ফ্রান্সের চাই স্রেফ আর একটি জয়। আগামী রোববার ফাইনালে আর্জেন্টিনার মুখোমুখি হবে দেশমের দল।