জার্মানি আসর দিয়ে যে পথ চলার শুরু তা এক ধরনের পূর্ণতা পেল কাতারে।
Published : 25 Nov 2022, 06:03 PM
বিশ্ব মঞ্চে খেলতে পারবে কিনা, একটা সময় শঙ্কায় ছিল পর্তুগাল। শেষ পর্যন্ত বাছাইয়ের কঠিন চ্যালেঞ্জ পেরিয়ে তারা জায়গা করে নেয় কাতার আসরে। এতেই ক্রিস্তিয়ানো রোনালদো পেয়ে যান বিশ্বকাপ ইতিহাসে ‘অনন্য’ হওয়ার সুযোগ। কীর্তি গড়তে পর্তুগিজ মহাতারকা সময় নিলেন না মোটেও। নিজেদের প্রথম ম্যাচেই রেকর্ডের এমন এক পাতায় নাম লেখালেন, যেখানে তিনি ছাড়া নেই আর কেউ!
দোহার স্টেডিয়ামে ৯৭৪-এ বৃহস্পতিবার ঘানার বিপক্ষে ম্যাচের ৬৫ মিনিটেই সুবর্ণ সেই সুযোগ পেয়ে যান রোনালদো। ডি-বক্সে তাকে ফাউল করায় পেনাল্টির বাঁশি বাজান রেফারি ইসমাইল ইলফাথ।
স্পট-কিকটি নিতে আসেন রোনালদো নিজেই। কোনো ধরনের ভুল করেননি পর্তুগাল অধিনায়ক। বল জালে পাঠিয়ে করেন সেই চিরচেনা উদযাপন। সতীর্থদের নিয়ে মাতেন উল্লাসে। ব্যস! এতেই গড়া হয়ে গেল ইতিহাস।
বিশ্বকাপের টানা বা ভিন্ন পাঁচ আসরে গোল করা একমাত্র ফুটবলার এখন ৩৭ বছর বয়সী রোনালদো। রেকর্ডের পর রেকর্ড গড়া এই ফরোয়ার্ডের জন্যও নিশ্চিতভাবেই এটি অবিশ্বাস্য এক অর্জন। ঘানাকে ৩-২ গোলে হারানো ম্যাচের সেরা হয়ে রোনালদো নিজেও বলেন একই কথা।
বিশ্বকাপের চার আসরে গোল করে এতদিন পেলে, মিরোস্লাভ ক্লোসা, উয়ি সিলার ও লিওনেল মেসির পাশে ছিলেন রোনালদো। এবার সবাইকে ছাড়িয়ে পাঁচবারের বর্ষসেরা ফুটবলার উঠে গেলেন নতুন উচ্চতায়।
চলতি বিশ্বকাপে ঘানার বিপক্ষে ম্যাচে নেমে আরেকটি অর্জনেও নাম লেখান রোনালদো। পাঁচটি বৈশ্বিক আসরে খেলা ৮ ফুটবলারের একজন এখন তিনি। বাকিরা হলেন-জার্মানির লোথার মাথেউস, মেক্সিকোর আন্তোনিও কারবাহাল, রাফায়েল মার্কুয়েস, আন্দ্রেস গুয়ার্দাদো ও গিয়েরমো ওচোয়া, ইতালির জানলুইজি বুফ্ফন এবং আর্জেন্টিনার মেসি।
আন্তর্জাতিক ফুটবলে রোনালদোর পথচলা শুরু ২০০৩ সালে। বিশ্বকাপে প্রথম খেলার সুযোগ পান ২০০৬ সালে। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত প্রতিটি আসরেই পর্তুগাল দলের হয়ে মাঠে নেমেছেন তিনি। ১৮ ম্যাচে গোল করেছেন ৮টি।
রোনালদোকে হাতছানি দিচ্ছে আরেকটি রেকর্ড। আর একটি গোল করলেই বিশ্ব মঞ্চে পর্তুগালের হয়ে সবচেয়ে বেশি গোল করা ইউজেবিওর পাশে বসবেন তিনি। এই কিংবদন্তি ৯টি গোলই করেছিলেন ১৯৬৬ সালের বিশ্বকাপে। তাকে ছাড়িয়ে রেকর্ডটি নিজের করে নেওয়ার সুযোগও রয়েছে রোনালদোর।
বিশ্ব মঞ্চে রোনালদোর রেকর্ড গড়া পথচলা নিয়ে এই আয়োজন। তুলে ধরা হলো তার পাঁচটি বিশ্বকাপের পারফরম্যান্স।
২০০৬ জার্মানি আসর, ৬ ম্যাচে ১ গোল
আফ্রিকার দল অ্যাঙ্গোলার বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে বিশ্বকাপ অভিষেক হয় রোনালদোর। আসরে দলের প্রথম ম্যাচে খেলার সুযোগ পেয়ে তা কাজে লাগাতে পারেননি এই ফরোয়ার্ড। ৬০ মিনিট খেলে ফেরেন খালি হাতে। ম্যাচটি ১-০ গোলে জেতে পর্তুগাল।
পরের ম্যাচেই অবশ্য বিশ্বকাপে নিজের প্রথম গোলটি উপহার দেন রোনালদো। ইরানের বিপক্ষে সফল স্পট-কিকে দলের হয়ে দ্বিতীয় গোলটি করেন তিনি। ২-০ তে জিতে মাঠ ছাড়ে পর্তুগিজরা। গ্রুপ পর্বের তৃতীয় ম্যাচে মেক্সিকোর বিপক্ষে রোনালদোকে থাকতে হয়ে বেঞ্চে।
শেষ ষোলোর লড়াইয়ে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ১-০ গোলে জেতা ম্যাচে ৩৪ মিনিট খেলেন রোনালদো। কোয়ার্টার-ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে নির্ধারিত সময়ের পর অতিরিক্ত সময়ে গড়ানো ড্র হওয়া ম্যাচে পুরো ১২০ মিনিট খেলেন তিনি। পরে টাইব্রেকারে ১-৩ ব্যবধানে পর্তুগালের জয়সূচক শটটি নেন রোনালদো।
ওই গোলটি বিশ্বকাপের বছর খানেক আগে মারা যাওয়া বাবা দিনিস আভেইরোকে উৎসর্গ করেন তিনি। আকাশের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘তুমি সেখানে…এটা তোমার জন্য।’
সেমি-ফাইনালে ৯০ মিনিট খেলেও গোলের দেখা পাননি রোনালদো। আসরে তার পা থেকে আসে ওই একটি গোলই। শেষ চারে ফ্রান্সের কাছে ১-০ গোলে হেরে বিশ্বকাপ স্বপ্ন শেষ হয় পর্তুগালের।
২০১০ দক্ষিণ আফ্রিকা আসর, ৪ ম্যাচে ১ গোল
দক্ষিণ আফ্রিকা আসরের আগে ছন্দের খোঁজে ছিলেন রোনালদো। অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে এখন তার গোল করার হারের কারণে। তবে পর্তুগালের হয়ে দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে গোল না করে ২০১০ বিশ্বকাপ শুরু করেছিলেন তিনি!
আসরের শুরুটাও ভালো হয়নি তার। কোত দি ভোয়ার বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে পাননি গোলের দেখা। দল করে গোলশূন্য ড্র। পরের ম্যাচে উত্তর কোরিয়াকে গোল বন্যায় ভাসায় পর্তুগাল। ৭-০ গোলে জেতা ম্যাচে ষষ্ঠ গোলটি করেন রোনালদো। অবসান হয় দেশের হয়ে তার লম্বা সময়ের গোল খরার।
শেষ ষোলোতে স্পেনের বিপক্ষে ১-০ গোলে হেরে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে যায় পর্তুগাল। পরে স্পেনই জেতে শিরোপা।
২০১৪ ব্রাজিল আসর, ৩ ম্যাচে ১ গোল
রোনালদোর জন্য বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে হতাশাজনক আসর ছিল ২০১৪। সেবার দল গ্রুপ পর্ব থেকে ছিটকে পড়ে। আর হাঁটুর চোট প্রভাব ফেলে রোনালদোর পারফরম্যান্সে।
গ্রুপ পর্বে তিনটি ম্যাচেই অবশ্য পুরো ৯০ মিনিট খেলেন রোনালদো। জার্মানির বিপক্ষে ৪-০ তে উড়ে যাওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে ২-২ গোলে ড্র করে পর্তুগাল। এই দুই ম্যাচে গোল না পাওয়া রোনালদো জালের দেখা পান ঘানার বিপক্ষে শেষ ম্যাচে। ২-১ গোলে আফ্রিকার দলটিকে হারানোর পথে দ্বিতীয় গোলটি করেন তিনি।
২০১৮ রাশিয়া আসর, ৪ ম্যাচে ৪ গোল
৩৩ বছর বয়সে ক্যারিয়ারের সেরা বিশ্বকাপটি কাটান রোনালদো। রাশিয়া আসরে ৪ ম্যাচে চারটি গোল করেন তিনি।
২০১৮ বিশ্বকাপে পর্তুগিজ তারকা নিজেদের প্রথম ম্যাচেই দেখান ঝলক। স্পেনের সঙ্গে ৩-৩ ড্রয়ে দলের সবগুলি গোলই করেন তিনি। গড়েন বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি বয়সী (৩৩ বছর ১৩০ দিন) খেলোয়াড় হিসেবে হ্যাটট্রিক করার কীর্তি।
পরের ম্যাচে মরক্কোর বিপক্ষে জয়ের ম্যাচেও দলের একমাত্র গোলটি করেন রোনালদো। গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে পেনাল্টি মিস করেন তিনি। ইরানের বিপক্ষে ১-১ গোলে ড্র করে পর্তুগাল।
তাতে অবশ্য শেষ ষোলোতে উঠতে অসুবিধা হয়নি তাদের। কিন্তু সেখানে তারা উরুগুয়ের কাছে হেরে যায় ২-১ গোলে। চারটি ম্যাচেই পুরো ৯০ মিনিট খেলেন রোনালদো।
২০২২ কাতার আসর, এখন পর্যন্ত ১ ম্যাচে ১ গোল
এবার ইউরোপের বাছাইয়ে নিজেদের গ্রুপ থেকে সরাসরি বিশ্বকাপে জায়গা করে নিতে পারেনি পর্তুগাল। তাতে শঙ্কা জাগে বিশ্ব মঞ্চে তাদের খেলা নিয়ে।
পরে ইউরোপের ১০ গ্রুপের রানার্সআপ ও নেশন্স লিগের সেরা দুই গ্রুপ জয়ী মিলে ১২ দলের ‘প্লে-অফে’ লড়ে তারা পায় কাতার আসরের টিকেট।
ঘানার বিপক্ষে জয় দিয়ে আসর শুরু করে পর্তুগাল। গোলশূন্য থেকে দুই দল প্রথমার্ধ শেষ করার পর দ্বিতীয়ার্ধে ছড়ায় রোমাঞ্চ। ম্যাচের ‘ডেকলক’ ভাঙেন রোনালদো। সফল স্পট-কিকে তিনি দলকে এগিয়ে নিলে এরপর দুই দল মিলে গোল করে আরও চারটি।
রোনালদো ওই গোলেই নাম লেখান বিশ্বকাপ ইতিহাসের নতুন এক পাতায়। কাতারে আর কতবার উল্লাসে ভাসাবেন তিনি দলকে, তা তোলা থাকল সময়ের হাতে।