লেখাপড়া বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু ইঞ্জিনিয়ার না হয়ে আবু নাঈম সোহাগ এলেন ফুটবলে। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) সাধারণ সম্পাদক। ২০০৫ সালে হেড অব কম্পিটিশন্স পদে যোগ দেওয়ার পর ২০১১ সালে পান ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব। ২০১৩ সালে পুরোপুরি হাল ধরেন। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তিনি শোনালেন ফুটবলের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার গল্প। কথা বললেন চলমান বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়শিপ লিগের পাতানো ম্যাচের অভিযোগ থেকে শুরু করে বিদেশি খেলোয়াড়দের ওয়ার্ক-পারমিট ছাড়া বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে খেলার মতো স্পর্শকাতর ইস্যু নিয়ে।
Published : 14 Jun 2022, 11:47 AM
২০১১ সালে বাফুফের সেসময়কার সাধারণ সম্পাদক আল মুসাব্বির সাদী মরণব্যাধী ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করলে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান সোহাগ। দুই বছর পর পুরোপুরি এই দায়িত্ব তার কাঁধে তুলে দেয় বাফুফের নির্বাহী কমিটি। সেই থেকে আলোচনা, সমালোচনার স্রোতের মধ্যে এ পদে দায়িত্ব পালন করে আসছেন তিনি।
প্রশ্ন: বুয়েটে পড়াশোনা করেছেন, ইঞ্জিনিয়ার না হলে ফুটবলে এলেন কিভাবে?
সোহাগ: সত্যি বলতে বড় হয়ে ইঞ্জিনিয়ার কিংবা ডাক্তার হওয়ার যে চাওয়াটা মানুষের থাকে, আমার এগুলো ছিল না। সবসময় মনে হতো, সঠিক কিছু করব, যেটা আমার ভালো লাগবে। ওই সময় আমার সামনে দুটো পথ খোলা ছিল। ভর্তি পরীক্ষায় একই সঙ্গে বুয়েটে এবং চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং ইনিস্টিটিউটে সুযোগ পেলাম, আমার চাওয়া ছিল চট্টগ্রামে গিয়ে কম্পিউটার সাইন্স পড়ার, কিন্তু ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে যেতে দিতে রাজি হয়নি পরিবার। ওই সময় সিদ্ধান্তটা নেওয়া কঠিন ছিল। শেষ পর্যন্ত বুয়েটে ভর্তি হলাম। মনে হতো, পড়া শেষ করি, এরপর দেখা যাবে কী করা যায়। পড়া শেষ করে একটা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কিছুদিন যুক্ত ছিলাম। তখনও আমার চিন্তা ছিল জাতিসংঘ, আইএনজিও, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠনে কাজ করা এবং এগুলো নিয়ে আমি সবসময় উৎসুক ছিলাম।
এগুলো খোঁজ করতে করতে ফুটবল ফেডারেশনে সুযোগ এলো। চেষ্টা করলাম এবং সবকিছু ক্লিক করল। প্রথাগত গৎবাঁধা নয়, আরও বেশি মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকা, আরও বেশি মানবিক কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকার চাওয়াটা পূরণ হয়ে গেলো। হেড অব কম্পিটিশন্স হিসাবে যোগ দেওয়ার পর দেখলাম, এখানে অনেক বেশি ডাইনামিজম এবং কাজের ক্ষেত্র অনেক প্রশস্ত। ফুটবল তখন আরও বেশি প্রোফেশনালিজমের দিকে যাচ্ছে। ফিফা এবং অঙ্গসংগঠন, বিদেশিদের সঙ্গে কাজ করার অবারিত সুযোগ, এডুকেশন কোর্স, খেলা পরিচালনার জন্য ম্যাচ অফিসিয়াল হিসেবে দায়িত্ব পালন করা- দেখলাম কাজের ক্ষেত্র অনেক বিস্তৃত। মনে হলো যদি কারো আগ্রহ এবং নিবেদন থাকে, তাহলে ফুটবলে অনেক অবদান রাখতে পারে।
এর মধ্যে অন্য ভাবনাও কাজ করছিল, যেহেতু তখনও গা থেকে ছাত্র গন্ধ যায়নি! স্কলারশিপ নিয়ে বাইরে যাব, এমবিএ করব, এরই মধ্যে বন্ধুদের সঙ্গে বুয়েটে এমএসে ভর্তি হয়ে সেটা শেষও করে ফেললাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ফুটবলের সঙ্গেই থেকে গেলাম।
প্রশ্ন: বাফুফেতে যখন যোগ দিলেন, তখন বাফুফে কেমন ছিল, বিশেষ করে এর প্রফেশনালিজমের দিকগুলো?
অফিস টাইম ছিল দুপুর ২টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত, যেটা সময়ের সঙ্গে খুব একটা সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না। ২০০৭ সালে পেশাদার লিগ শুরু হলো। ওই সময় বাইলজ তৈরি করা, ম্যাচ পরবর্তী সংবাদ সম্মেলন থেকে শুরু করে পেশাদার ফুটবলের সঙ্গে জড়িত বিষয়গুলো, কোড অব কন্ডাক্ট, ডিসিপ্লিনারির এমন অনেক কিছু কাগজে-কলমে প্রস্তুত করে আন্তর্জাতিক ফুটবলের মানের সঙ্গে সমন্বয় করে বাস্তবায়ন করা-সব মিলিয়ে এগুলো চ্যালেঞ্জিং ছিল।
তবে সবসময়, সব কাজে ফেডারেশনের সবার, ফিফা-এএফসিরও সহযোগিতা পেয়েছি। মনে আছে, ২০০৬ সালে সিঙ্গাপুরে এএফসির অর্থায়নে বাফুফের প্রতিনিধি হিসেবে সিঙ্গাপুরে গিয়েছিলাম ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও আর্সেনালের (সম্ভবত) প্রীতি ম্যাচ দেখতে, দুই সপ্তাহে সিঙ্গাপুরের পেশাদার লিগ কীভাবে হয়, পেশাদার ফুটবলের কাঠামো কেমন হওয়া প্রয়োজন, ওদের বিপনন ব্যবস্থা, ফাইন্যান্স, লজিস্টিকসের কাজগুলো ধরে ধরে শেখানো হয়েছিল। যেহেতু পরের বছরই আমাদের পেশাদার লিগ শুরু হবে, এটা কিভাবে আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হবে, সেটা ওই দুই সপ্তাহে হাতেখড়ি হয়েছিল। সেগুলো আমাদের লিগে প্রয়োগের চেষ্টা করেছি।
প্রশ্ন: পুরান প্রথা ভাঙতে বাধার মুখোমুখি হতে হয়নি?
সোহাগ: এটা প্রয়োগ করতে গিয়েও প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। ক্লাবগুলোর সঙ্গে সবসময় যোগাযোগ রাখা, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সেমিনার করে বারবার তাদেরকে বোঝাতে হয়েছে। ফিফার প্রজেক্টের আওতায় বি-লিগ নামে আমাদের পেশাদার লিগ শুরু হয়েছিল। এই ‘বি-লিগ’ নাম নিয়ে একটা কনফিউশন শুরু হলো, অনেকের মনে হলো এটা দ্বিতীয় বিভাগ লিগ। দুই বছর পর বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ নামকরণ করা হলো, প্রকল্পের নাম ছিল ‘ভিশন বাংলাদেশ’। ওই প্রকল্পের আওতায় কাজ করার সময় ক্লাবগুলোর কাজ থেকে ভালো সাড়া ছিল, কিন্তু এক ধারা থেকে আরেকটা ধারায় যাওয়ার জন্য বড় সমস্যা ছিল, ওই সময় ক্লাবগুলোর সেক্রেটারিয়েটে যারা কাজ করত, তাদের নিয়ে। তাদের অনেকের যোগাযোগের ক্ষেত্রে, নিয়মকানুনগুলো অনুসরণ করতে সমস্যা হয়েছে।
প্রশ্ন: বিদেশি ফুটবলারদের প্রসঙ্গ যখন এলো, ওয়ার্ক পারমিট না নিয়ে এসে লিগে খেলা শুরু করে দেওয়ার স্পর্শকাতর ঘটনাও আছে।
সোহাগ: আগে যেটা হতো, কোনোভাবে একজন খেলোয়াড় অন-অ্যারাইভাল ভিসা নিয়ে এসেছে, বা ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে, তখন তাকে (ক্লাবের হয়ে খেলা শেষ করে) দেশে ফেরার পথে ‘ইল্লিগ্যাল স্টে’র জন্য বিমানবন্দরে একটা জরিমানা দিয়ে যেতে হতো। কিন্তু এখন এরকম নেই। দলবদলের মৌসুম শেষ হয়ে গেলে বিদেশি খেলোয়াড়, কোচ, অফিসিয়াল যারা আসবে, তালিকা আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বিভিন্ন ইন্টেলিজেন্স সংস্থা, বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে দিতে হয়। সেগুলো অনুমোদন পেলেই তারা আসার অনুমতি পায়।
কারা এসেছে, বিভিন্ন কর্তৃপক্ষকে আমাদেরকে সেটাও জানাতে হয়। এরপর কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট ক্লাবগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। ট্র্যাকিং করে, ভিসার মেয়াদ শেষের আগে আগাম সতর্ক করে দেয় এবং ক্লাবগুলোকেও এসব বিষয়ে দায়বদ্ধ থাকতে হয়। ভিসার মেয়াদ শেষ হলে ক্লাবগুলো উদ্যোগী হয়ে বাকি কাজটুকু করতে হয়।
বিদেশি খেলোয়াড়দের ভিসার মেয়াদ, ওয়ার্ক-পারমিট, অবৈধভাবে সে যেন দেশে না থাকে-এসব তথ্যগত বিষয়গুলো ঠিক রাখার জন্য ক্লাবগুলোকে বাফুফে সবসময় উৎসাহ দেয়। এ মুহূর্তে এই সমস্যাগুলো নেই বললেই চলে।
গত দুই বছর ধরে আমরা খেলোয়াড়দের ওয়ার্ক পারমিট, আয়কর দেওয়া-এসব বিষয়ে ভীষণ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছি। একেবারে যে কাজ হচ্ছে না, তা নয়। সবক্ষেত্রে যে হচ্ছে না, সেটাও স্বীকার করছি। কারা এগুলো মেইনটেইন করছে না, সেটাও আমরা জানি, পেশাদার লিগে শীর্ষদলগুলোর অধিকাংশ এই কাজগুলো ঠিকঠাক করছে, নিচের দিকের দলগুলোর অনেকের পুরো পদ্ধতি অনুসরণ করতে নানা কারণে সমস্যা হয়। তবে এক্সট্রা এফোর্ট দিচ্ছি। গুটিকয়েক ক্লাব এগুলো অনুসরণ করতে পারছে না, আশা করি সেটাও ঠিক হয়ে যাবে।
প্রশ্ন: পুরনো প্রসঙ্গে ফেরা যাক...সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নেওয়ার শুরুর দিকের চ্যালেঞ্জগুলো ….
সোহাগ: সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পাওয়ার পর প্রথম দুই বছর মনে হয়েছিল, এটা খুবই কঠিন চাকরি। বিভিন্ন কম্প্লাইন্স মেইনটেইন করা, ক্লাবগুলোর সঙ্গে নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা, ফুটবল খেলা মানেই মতো রাফ অ্যান্ড টাফ খেলা-বলতে চাচ্ছি এখানে তো নানা ইস্যু থাকে, মাঠে খেলোয়াড়দের নানা সমস্যা, রেফারিং নিয়ে অভিযোগ, পাতানো ম্যাচ ইস্যু, তর্ক-বিতর্ক, ফেডারেশনের নির্বাচন থেকে শুরু করে আবাহনী-মোহামেডান কিংবা তৃতীয় বিভাগের একটি ম্যাচ নিয়েও সবকিছু সরগরম থাকে।
প্রশ্ন: দীর্ঘসময় এই দায়িত্বে আছেন, কোন কাজগুলো নিয়ে সন্তুষ্টি আছে?
সোহাগ: প্রথমত বাফুফেকে পেশাদার প্রতিষ্ঠান হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে…এখানে অবশ্যই সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনসহ, সিনিয়র সহ-সভাপতি, নির্বাহী কমিটির কর্মকর্তাদের সহযোগিতা পেয়েছি। এখন বাফুফের সাত থেকে আটটি সেক্রেটারিয়েট ডিপার্টমেন্ট আছে। এগুলো কিন্তু আমাদের গড়ে নিতে হয়েছে। অল্প কয়েকজন নিয়ে শুরুর পর এখন বাফুফের প্রায় ৯০ জনের বেশি কর্মকর্তা।
সবশেষ বিশ্বকাপ ট্রফির একটি ঘটনাই বলি। আসা এবং যাওয়ার সময় ট্রফিটা বিমানবন্দরে ওরা দুইবার পরীক্ষা করেছে, ওদের প্রশ্ন ছিল, তোমরা যে এই ট্রফি নিয়ে এলে, এটাই যে ফেরত নিবে তার গ্যারান্টি কী, যদি বদলে অন্য কিছু পাঠিয়ে দাও! তো এমন অনেক বিষয় সীমিত সামর্থ্যের মধ্যে থেকে মসৃণভাবে করাটা শিখেছি আমরা।
প্রশ্ন: আর্থিক সমস্যার কথা বলছিলেন, কখনও কী মনে হয়নি বাফুফের নিজস্ব তহবিল থাকা উচিত আপদকালীন সময়ের জন্য?
সোহাগ: বাফুফের ফান্ড থাকা উচিত, আরও স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া উচিত-এটা প্রবলভাবে মনে হয়েছে। বিষয়টি এভাবে বলতে চাই, এশিয়ার জাপান, কোরিয়ার ফেডারেশনের কথা বাদ দিয়ে আমরা যদি মালয়েশিয়া বা ইন্দোনেশিয়ার কথাও ধরি, ওদের ফেডারেশনেরও কিন্তু আর্থিক সমস্যা নেই। স্পন্সর প্রতিষ্ঠান এসে ওদের কাছে বসে আছে, ওরা বাছাই করছে কাদের পৃষ্ঠপোষকতা নেবে। অথচ আমাদেরকে স্পন্সর প্রতিষ্ঠানের টেবিলে গিয়ে বসে থাকতে হয়, তাদেরকে বোঝাতে হয়, রাজি করিয়ে ফুটবলের প্রতি আকৃষ্ট করতে হয়। আসলে ওদের দলগুলো ভালো করছে, এর কারণে ওদেরকে স্পন্সরের কাছে যেতে হয় না, আমাদের যেতে হয়।
সারাবিশ্বেই ফুটবল একটা ‘গোল্ডেন প্রোডাক্ট।’ আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, এই পণ্য আমরা বিক্রি করতে পারি না। একটা সময় সভাপতি সাহেব বড় বড় স্পন্সর এনেছেন, এখনও আনেন। এখন আমাদের সঙ্গে ইউনিসেফ, ঢাকা ব্যাংক, বসুন্ধরা কিংসসহ আরও অনেকে আছে। গ্রামীণফোন, মধুমতি ব্যাংক, বেক্সিমকোর সঙ্গেও কাজ করেছি, কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, আমাদের আসলে দরকার শক্ত ভিত।
এজন্য আমরা সরকারের যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সাড়ে ৪শ কোটি টাকার একটি প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করছি। পাঁচ বছর মেয়াদে যদি আমরা টাকাটা পাই, তাহলে আমরা আমাদের বর্তমান কার্যক্রমগুলো বাস্তবায়ন করব। আমরাও চাই আমাদের ক্লাবগুলো অ্যাডিডাসের বল দিয়ে খেলুক, একটা বলের দাম ২০-২৫ হাজার টাকা, আমাদের কয়টা ক্লাবের এই সামর্থ্য আছে? এখন জার্সি হচ্ছে ‘ড্রাই ফিট’, খেলার সময় এই জার্সি পরলে একজন খেলোয়াড় ঘামবে না, জার্সি ঘাম টেনে নিয়ে বাতাসে ছেড়ে দিবে, শট নেওয়ার সময় ড্রেসের অস্বস্তির কারণে যেন মনোযোগ নষ্ট না হয়। ফুটবল এখন এই পর্যায়ে চলে গেছে এবং এখানে অর্থকড়ির বিষয়টি ব্যাপকভাবে জড়িত।
পর্যাপ্ত অর্থ না পেলে ভালো পরিকল্পনা সম্ভব নয়। আমরা চাই জাতীয় দল ভালো করুক, জাতীয় দল ভালো করলে স্পন্সর পাওয়া আমাদের জন্য কোনো ব্যাপারই নয়।
প্রশ্ন: এত বড় দায়িত্বে থেকে কোর্স করে ম্যাচ কমিশনার হয়েছেন। উদ্দেশ্য কি ছিল?
সোহাগ: কোর্সটি করেছিলাম ২০১৩ সালে। আসলে ফিফার স্ট্র্যাটেজিক, উইমেন্স, প্লানিং এমন অনেক শাখায় কনসাল্টেন্ট হিসেবে কাজ করার সুযোগ আছে। অভিজ্ঞদের ফিফা-এএফসি মূল্যায়ন করে এবং আমার মনে হলো ফুটবলের সঙ্গে থেকেই এ কাজগুলো করা যায়, এর সঙ্গে সম্মানের বিষয়ও জড়িত।
প্রশ্ন: দেশের বাইরে আপনি যেভাবে স্বাধীনভাবে ম্যাচ কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেন, আমাদের কমিশনারদের দেখা যায় অনেক ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তের জন্য বাফুফের দিকে তাকিয়ে থাকতে।
সোহাগ: দেখুন, ম্যাচ কমিশনারের দায়িত্ব হচ্ছে পুরো বিষয়টির সমন্বয় করা। যে কোনো ইস্যুতে সে ফিফা-এএফসিকে জানায়, কখনও সেটা লিখিতভাবে জানায়, সিদ্ধান্ত তারাই দেয়। তবে আমরাও চাই, আমাদের ম্যাচ কমিশনাররা আরও বেশি দায়িত্ব তারা অনুভব করুক, আরও সুন্দরভাবে কাজ করুক।
আমাদের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। দেশের বাইরে কোর্স করতে গিয়ে সিঙ্গাপুরে গিয়ে অন্যরকম অভিজ্ঞতা হয়েছিল। আমাকে একজন ম্যাচ কমিশনারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলো, পরে জানলাম উনি একজন প্রফেসর। ফুটবলের আইনকানুন থেকে নানা বিষয় নিয়ে তিনি কাজ করেন। খেলাটির প্রতি তার আগ্রহ, ভালোবাসা এবং দায়িত্ব পালনের যোগ্যতা থাকার কারণে তাকে ওরা দায়িত্ব দিয়েছে। এমন শিক্ষিত, ফুটবল নিয়ে আগ্রহী, নিয়মকানুন খুব ভালোভাবে জানা মানুষের সংখ্যা আমাদের একটু কম। আমাদের যেসব রসদ আছে, তাদের নিয়ে কাজ করতে হয়। এখন যারা দায়িত্ব পালন করছে, তাদের মোটেও ছোট করছি না। এখন আমাদের অনেক কোর্স আছে, সেখানে যারা অংশ নিচ্ছে, তাদের মধ্যে থেকে বাছাই করে আমরা আস্তে আস্তে কিছু ম্যাচ কমিশনার তৈরি করব, যারা আরও ভালোভাবে দায়িত্ব পালন করবে।
প্রশ্ন: চলমান বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে পাতানো ম্যাচের অভিযোগ উঠেছে। এসব ক্ষেত্রে ম্যাচ কমিশনারের ভূমিকা কি? বাফুফেরও ভাবনা কী?
সোহাগ: যারা রেফারি, রেফারির সহকারী, ম্যাচ কমিশনার, অফিসিয়াল, তাদের ম্যাচ পাতানো, বয়স চুরি এইসব বিষয় নিয়ে বলার এখতিয়ার তাদের নেই। তাদের দায়িত্ব লজ অব দা গেম অ্যাপ্লাই করা। পাতানো ম্যাচের ইস্যুটি ইন্ট্রিগ্রিটি বিভাগ খুব নিরবে দেখভাল করে। তারা কখনই চোখের সামনে আসে না। তারা আপনার-আমার মতোই খেলা দেখে, কাজটা নিরবে করে যায়। ফিফা-এএফসি কাজটি তৃতীয় পক্ষ দিয়ে করায়, তাদের রিপোর্ট, তথ্য-উপাত্ত-প্রমাণ দেখে ফিফা-এএফসি-ফেডারেশন সিদ্ধান্ত নেয়।
এখানে বলতে চাই, পাতানো ম্যাচ, বয়স চুরি, এসব বিষয়ে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। একা বাফুফের পক্ষ থেকে কিছু করা সম্ভব নয়। প্রতিটি অফিসিয়াল, খেলোয়াড়, কর্মকর্তা সবাইকে ‘হুইসেল ব্লোয়ারের’ ভূমিকা নিতে হবে, জানাতে হবে যে আমার একটা ফোন এসেছে, আমাকে অজ্ঞাত একজন প্রস্তাব দিয়েছে কিংবা আমার দুই সতীর্থকে চুপিসারে এগুলো নিয়ে কথা বলতে শুনেছি। বাফুফে সবসময় এই বিষয়গুলো গোপনীয়তার সঙ্গে মেইনটেইন করে এবং তাদের সেই পরিমাণ নিরাপত্তাও দেয়।
স্বীকার করছি, এগুলো পর্যবেক্ষণ করার জন্য চার-পাঁচজনকে নিয়ে যে একটা ইউনিট করব, তেমন সুসংহত বিভাগ নেই। তবে একটা শক্তিশালী কমিটি আছে, যারা কোনো ম্যাচ নিয়ে যদি ছোট্ট অভিযোগও ওঠে, সেটা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে তদন্ত করে।
প্রশ্ন: আপনি দায়িত্বে থাকাকালীন সময়ে কয়েকটি একাডেমি শুরু হলেও মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। এখন কমলাপুরে একটা শুরু করেছেন।
সোহাগ: এ বছরই আমরা একজনকে (মিরাজুল ইসলাম, মোহামেডান) ১০ লাখ টাকায় বিক্রি করেছি, সরকারের কাছে আমরা যে সাড়ে চারশ কোটি টাকার প্রজেক্ট (ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট) দিয়েছি, সেখানে আরও তিনটি জেলাতে তিনটি একাডেমি করার বিষয়টি আছে। সেখানে ৫০-৬০ জন করে খেলোয়াড় নিয়ে কাজ হবে। বিদেশি কোচ, ট্রেনার থাকবে এবং সেখান থেকে বাফুফের আয়ের সুযোগও তৈরি হবে।
প্রশ্ন: আগের একাডেমিগুলো যদি চালিয়ে নেওয়া যেত…এমন আক্ষেপ হয় না?
সোহাগ: আমরা খুব করে চেয়েছিলাম। সিলেট বিকেএসপিতে, ফর্টিসেও একই উদ্যোগ নিয়েছিলাম, কিন্তু নানা কারণে সেটা চালিয়ে নিতে পারিনি। এখন যেমন কষ্ট করে হলেও কমলাপুরে চালিয়ে নিচ্ছি, তখন আমরা পারিনি। কারণ বিভিন্ন স্পন্সরদের কাছ থেকে যে আর্থিক সহযোগিতা পাওয়ার আশা ছিল, তখন আমরা সেটা পাইনি। যদিও ওই একাডেমিগুলো থেকে বেশ কিছু ফুটবলার উঠে এসেছে, কিন্তু আমরা যেটা চেয়েছিলাম, সেটা অর্জন করতে পারিনি। তবে এখন আমরা অনেক কিছু গুছিয়ে এনেছি, উয়েফার কাছ থেকে খেলোয়াড়দের জন্য একটা বাস এনেছি, সব মিলিয়ে কষ্টের মধ্যে কমলাপুরের একাডেমিটা চালিয়ে নিতে পারার কারণে আরও তিনটি একাডেমি করার সাহস, উৎসাহ পাচ্ছি।
প্রশ্ন: একটু অন্য প্রসঙ্গ। টার্ফ খেলার অনুপোযোগী ও ঝুঁকিপূর্ণ অভিযোগ করে বসুন্ধরা কিংস ফেডারেশন কাপে খেলেনি। ক্লাবটির পৃষ্ঠপোষকদের পৃষ্ঠপোষকতায় চ্যাম্পিয়নশিপ লিগ হলো সেই টার্ফেই!
সোহাগ: এটা নিয়ে আমি কোনো মন্তব্য করব না। বিষয়টা আমি এভাবে বলতে চাই, সংস্কার কাজ চলায় বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম আমাদের হাতে নেই। যদি বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম প্রস্তুত থাকত, তাহলে স্বাধীনতা কাপ, ফেডারেশন কাপসহ অনান্য টুর্নামেন্টও সেখানে হত। মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে, বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের খেলার মাঠ এবং দুটি ড্রেসিংরুম প্রস্তুত হলেই আমরা সেখানে ফিরে যাব। এটাও মনে রাখতে হবে, আমরা তো ক্যালেন্ডারের সঙ্গে কম্প্রোমাইজ করছি না, খেলা এগিয়ে নিতে কিছু ছাড় দিতে হচ্ছে।
প্রশ্ন: অনেকে মনে করেন, ক্রীড়াবান্ধব প্রধানমন্ত্রীর কাছে সেভাবে চাইলে বাফুফে এতদিন একটি নিজস্ব স্টেডিয়াম পেয়ে যেত। এত লম্বা সময় দায়িত্বে থেকেও সেটা কেন সম্ভব হয়নি?
সোহাগ: কিছুদিন আগেও যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলাপ-আলোচনা হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ‘গো অ্যাহেড’ ফিডব্যাক নিয়ে বাফুফে সভাপতি পূর্ত মন্ত্রণালয়ে আলোচনা করেছেন, পুর্বাচলে স্টেডিয়াম নির্মাণের জন্য বাফুফেকে যেন জায়গা দেওয়া হয়। জায়গা পাওয়াই আসলে কঠিন। এটা পেয়ে গেলেই হয়ে যাবে। এছাড়া ফিফা ফরোয়ার্ড প্রকল্পের আওতায় আমরা কক্সবাজারে টেকনিক্যাল সেন্টার (এখন থেকে সেন্টার অব এক্সিলেন্স) করা হচ্ছে ২০-২৫ একর জায়গায়, আশা করি এক-দু সপ্তাহের মধ্যেই আমরা জায়গাটা পেয়ে যাব।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এতকিছু করার পরও সবাই ফুটবলটাকে বিচার করে জাতীয় দলের পারফরম্যান্স, সাফল্য দিয়ে। জাতীয় দল কয়টা ট্রফি আনল, সবশেষ কবে ট্রফি পেয়েছি, এই সভাপতি বা কমিটির সময়ে কি পেল, সবাই এভাবেই মূল্যায়ন করে। আমরা কিন্তু সব সুবিধাই দলকে দিচ্ছি, ফাইভ স্টার হোটেল, প্রোপার ট্রেনিং, দেশের বাইরে ক্যাম্প, প্রীতি ম্যাচ আয়োজন সবই করছি। এখন জাতীয় দল যদি আমাদের ফল এনে দিতে পারে, তাহলে হয়ত সবার মনোভাব বদলাবে, সবাই বিশ্বাস করবে বাংলাদেশের ফুটবল ভালো করছে।
প্রশ্ন: ঘাটতির জায়গাটা তাহলে কোথায়?
সোহাগ: কাউকে দোষারোপ করছি না, সবাই তার জায়গা থেকে কাজ করছে। তবে আমার মনে হয়, খেলোয়াড়দের আরেকটু দায়িত্ব নিতে হবে। তাদের অনুপ্রাণিত করার জন্য আমাদের যদি আরও কিছু করার থাকে, তাহলে সেটা করতে হবে। যেমন, খেলোয়াড়দের যদি মাসিক পারিশ্রমিকের আওতায় আনা যায়, কিংবা জাতীয় দলের পুলে যে ২৫-৩০ জন খেলোয়াড় থাকবে, তাদের যদি হ্যান্ডসাম স্যালারি দেওয়া যায়, সেটা দুই-চার লাখ টাকা নয়, মিনিমাম ৫ থেকে ৭ লাখ টাকার চুক্তি করা যায়, তাহলে আমি মনে করি, সবাইকে আরও দায়িত্ববান এবং জবাবদিহিতার আওতায় আনা সম্ভব হবে এবং সেটা হবে একটা পেশাদার কাঠামো। তখন আমরাও বলতে পারব, ক্লাবে তুমি যেভাবে পারফর্ম করছো, এখানেও সেভাবে করতে হবে, যেহেতু আমরা তোমাদেরকে সাপোর্ট দিচ্ছি।
প্রশ্ন: কোন না পারাটা সবচেয়ে বেশি পোড়ায়?
সোহাগ: বাফুফের সব কার্যক্রম ডিজিটাল, পেপারলেস না করতে পারা। জাতীয় দল আরও ভালো করলে আমাদের মনে হয়, আরও বেশি উৎসাহ পেতাম, আরও বেশি অর্থ আনা, গ্ল্যামার যোগ করা, সবই পারতাম। আমাদের প্রধানমন্ত্রী ক্রীড়াবান্ধব, তিনি আমাদের দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছেন। কিন্তু সেটা নেওয়ার জন্য যেটা ডেলিভার করার প্রয়োজন, যেভাবে দেওয়া প্রয়োজন, মানে জয়, ট্রফি…সেটা জাতীয় দল দিতে পারছে না। জাতীয় দলের রেজাল্ট হলেই আমরা অর্থকড়ি, স্পন্সর সবকিছু আনতে পারব।
মেয়েরা কিছুদিন আগে মেয়েরা ভারতে হারিয়ে অনূর্ধ্ব-১৯ চ্রাম্পিয়ন হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী ১৯ জুন তাদের সংবর্ধনা দেবেন, আর্থিক পুরস্কার দিবেন। যদি রেজাল্ট থাকে, তাহলে কোনো কিছুর কমতি থাকে না। তবে পারছি না বলে আমরা হাল ছাড়ছি না, হতাশ নই। আমরাও লেগে আছি, পুশ করছি।
প্রশ্ন: নিজেকে যদি সাধারণ ফুটবল অনুসারী বা সমর্থক ধরে নিন, তাহলে বাফুফে সাধারণ সম্পাদকের কাছে আপনার চাওয়া কি থাকবে?
সোহাগ: (হাসি) আমি প্রথমে সাধারণ সম্পাদকের কাছে চাইব ফুটবলের যেন গ্ল্যামার বাড়ে। এখন পেশাদার লিগে যেভাবে হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে ভিত্তিতে খেলা হয়, সেটা যথাযথ পদ্ধতি নয়। প্রোপার হোম-অ্যাওয়ে হচ্ছে বরিশাল, রাজশাহী, সিলেট বা খুলনার দল তাদের নিজেদের মাঠে খেলবে, রাজশাহী ম্যাচ খেলতে বরিশাল যাবে, বরিশাল যাবে সিলেট। এমন নয় যে, রহমতগঞ্জ সিলেটে গিয়ে সিলেটের দল হয়ে খেলবে, হোম ভেন্যু হিসাবে ব্যবহার করবে। আটটা বিভাগে সব সুবিধাসহ ভালো স্টেডিয়াম থাকবে, দল থাকবে, ড্রেসিং রুম, সাউন্ড সিস্টেম, সপ্তাহান্তে খেলা হবে, আমাকে জানাতে হবে আমার দল অমুক দিন রাজশাহীতে গিয়ে খেলবে, তাহলে আমি রাজশাহী যেতে পারব, যদি মাঠে না যেতে পারি, তাহলে টিভিতে দেখানোর ব্যবস্থা করতে হবে এবং সেজন্য সম্প্রচারের উন্নতমানের প্রোডাকশন লাগবে। সঠিক প্রচার-প্রচারনা থাকবে।
এগুলো কিন্তু অসম্ভব নয়! খেলোয়াড়রা উন্নতমানের ও ভালো ব্র্যান্ডের জার্সি পরে খেলবে, ভিএআর সিস্টেম থাকবে, উন্নতমানের বল দিয়ে খেলবে, ভালো মাঠে খেলবে-এই কাজগুলো যদি তিনি করেন, তাহলে ফুটবলপ্রেমীদের মধ্যে সাড়া পড়ে যাবে। তখন আলোচনা হবে ঢাকা কেন ফেভারিট? বরিশাল কেন হারল? এসব নিয়ে। এই দ্বৈরথ পেশাদার লিগে ছড়িয়ে দিবে। দুই-তিনমাস ব্যাপী হলেও ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগও আয়োজন করবে।