ছুটি নিয়ে দুটি উপাখ্যান সবার কাছে বেশ পরিচিত। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ছোট গল্প ‘ছুটি’ এবং সিনেমা ‘ছুটির ঘণ্টা’। গল্প এবং সিনেমা-দুটি ক্ষেত্রেই পরিণতি বিয়োগাত্মক। ছুটির আরেকটি গল্প আছে বাংলাদেশের ফুটবলে। ‘কাগজে-কলমে’ বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) কোচ থাকা জেমি ডে আছেন ছুটিতে। এই গল্পের পরিণতি ২০২১ সালের শেষ দিন পর্যন্তও আছে ঝুলে!
Published : 31 Dec 2021, 08:55 PM
এই ছুটির গল্পের শুরু ২২ সেপ্টেম্বর থেকে, সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ শুরুর দিন আটেক আগে। যেদিন জেমিকে ‘ছুটি’ দিয়ে সাফ ফুটবলের জন্য বাংলাদেশ দলকে তুলে দেওয়া হয়েছিল সেসময়কার বসুন্ধরা কিংস কোচ অস্কার ব্রুসনের হাতে।
এরপর শ্রীলঙ্কায় ‘প্রাইম মিনিস্টার মহিন্দা রাজাপাকসে’ চার জাতি টুর্নামেন্টে জাতীয় দলের ভার তুলে দেওয়া হয় সেসময়কার আবাহনী লিমিটেড কোচ মারিও লেমোসের হাতে। সাফ এবং চার জাতি টুর্নামেন্টে ব্যর্থ মিশনে শেষে দুই অন্তর্বর্তীকালীন কোচ ব্রুসন ও লেমোস ফিরেছেন নিজেদের ক্লাবে। ফেরা হয়নি কেবল জেমির। ছুটি এখনও শেষ হয়নি তার!
২০১৮ সালের মে মাসে বাংলাদেশ দলের দায়িত্ব নেন জেমি ডে। পরের বছর এই ইংলিশ কোচের সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হয় এক বছরের জন্য, যা শেষ হয় ২০২০ সালের মে মাসের মাঝামাঝিতে। তবে মেয়াদ ফুরালেও করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে ইংল্যান্ডে বসে ভার্চুয়ালি কাজ চালিয়ে যান ৪২ বছর বয়সী এই কোচ। এক ফাঁকে তার সঙ্গে ভার্চুয়ালি এক বছরের নতুন চুক্তিও সেরে নেয় বাফুফে, যে মেয়াদের শুরু ২০২০ সালের ১৪ অগাস্ট থেকে।
আগের দুই পর্বে দফায়-দফায় ছুটি নেওয়ার কারণে আলোচনা-সমালোচনার খোরাক হয়েছিলেন জেমি। একাধিকবার দেশের বাইরে থেকে দল ফিরেছে ঢাকায়, ছুটি নিয়ে সেখান থেকে কোচ চলে গেছেন ইংল্যান্ডে। এরপর দলের খেলা থাকলে সময়-সুযোগ অনুযায়ী ফিরেছেন। এসব নিয়ে খোদ বাফুফে কর্তাদের কেউ কেউ ছিলেন নাখোশ। কিন্তু ২০২০ অগাস্টে নতুন চুক্তির পর থেকে তার ছুটির দিনসংখ্যা বা দলের সঙ্গে না থাকার পরিসংখ্যান চোখ কপালে তোলার মতো!
৫০৪ দিনের মধ্যে ৩০০ দিন অনুপস্থিত!
কাতার বিশ্বকাপ ও এশিয়ান কাপের বাছাই ফের শুরুর কথা ছিল গত বছর অক্টোবর থেকে। কিন্তু করোনাভাইরাসের ছোবলে গাজীপুরে শুরু করা ক্যাম্প বাতিল করতে বাধ্য হয় বাফুফে। ইংল্যান্ডে থাকা কোচ জেমিকেও ফিরতে হয়নি ঢাকায়। নতুন চুক্তির শুরুতে ১৪ অগাস্ট থেকে ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত মোট ৭৫ দিন দলের সঙ্গে ছিলেন না তিনি। অবিশ্বাস্য, কিন্তু সত্যি!
মহামারীর মধ্যে ২০২০ সালের ৪ ডিসেম্বরে কাতারের বিপক্ষে বিশ্বকাপ ও এশিয়ান কাপের বাছাইয়ের ম্যাচ খেলে বাংলাদেশ। ম্যাচটিতে জামাল-জিকোরা উড়ে যায় ৫-০ গোলে। দোহা থেকে জেমিও উড়াল দেন ইংল্যান্ডের উদ্দেশে। এবার দলের সঙ্গে তার অনুপস্থিতির মেয়াদ ৫ ডিসেম্বর থেকে ১৪ জানুয়ারি, মোট ৪০ দিন।
বিশ্বকাপ বাছাইয়ের আগে মার্চে নেপালে ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্টে অংশ নেয় বাংলাদেশ। তিন ম্যাচে কিরগিজস্তান অনূর্ধ্ব-২৩ দলের বিপক্ষে জয়ই ছিল একমাত্র প্রাপ্তি। বাকি দুই ম্যাচে নেপালের বিপক্ষে গোলশূন্য ড্র এবং ফাইনালে ২-১ গোলের হার। ওই টুর্নামেন্টের পর ৫ এপ্রিল থেকে ছুটি শুরু হয়ে যায় জেমির, যা চলে ৯ মে পর্যন্ত। এই দফায় আরও ৩৫ দিন!
অনিশ্চয়তার মেঘ সরিয়ে গত ৩ জুন থেকে শুরু হয় বাছাই। এ পর্বে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ১-১ ড্র, ভারত এবং ওমানের বিপক্ষে যথাক্রমে ২-০ ও ৩-০ গোলে হারে বাংলাদেশ। সব মিলিয়ে বাছাই শেষ করে আট ম্যাচে দুই ড্র ও ছয় হারে ২ পয়েন্ট নিয়ে গ্রুপের তলানিতে থেকে। এরপর ২৩ জুন থেকে ১১ অগাস্ট পর্যন্ত মোট ৪৯ দিনের দলের সঙ্গে ছিলেন না জেমি।
সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে শুরু হয় কিরগিজস্তানের তিন জাতি কাপ। সেখানেও তিন ম্যাচে হারে দল। অক্টোবরে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ শুরুর আগে ২২ সেপ্টেম্বর জেমিকে ছুটিতে পাঠায় বাফুফে। ৩১ ডিসেম্বর ২০২১ পর্যন্ত তা ১০১ দিন। সব মিলিয়ে ২০২০ সালের ১৪ অগাস্ট থেকে ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ৫০৪ দিনের মধ্যে জেমির নেওয়া এবং বাফুফের দেওয়া ছুটির দিন ৩০০টি!
যা ভাবছেন সাবেকরা
ইউরোপ, লাতিন আমেরিকার অনেক ফুটবল কোচ জাতীয় দলের খেলা না থাকলে তাদের খেলোয়াড়দের ক্লাবের ম্যাচগুলো দেখতে যান নিয়মিতই। সেই দেখা থেকেও সাজান আগামীর পরিকল্পনা। তাই জাতীয় দলের খেলা থাক বা না থাক, দলের সঙ্গে কোচের থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন সাবেক তারকা ফুটবলার এবং কোচ গোলাম সারোয়ার টিপু। দেশের ফুটবলের এই কিংবদন্তি পেশাদার দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে ধরলেন নানা দিক।
“জার্মানিতে যখন আমি কোর্স করতে গেলাম, আমার যে ইনস্ট্রাক্টর ছিলেন, তিনি বলেছিলেন, তোমরা যখন ক্লাব বা জাতীয় দলকে কোচিং করাবে, তখন প্রয়োজনে খেলোয়াড়দের বাড়িতে যাবে, তাদের বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলবে। সে কী খায় বা খেতে পছন্দ করে, কিভাবে চলে, কথা বলে, তার লাইফ-স্টাইল কেমন জানবে, ট্রেনিংয়ের সময় সেগুলোও খুটিয়ে খুটিয়ে দেখবে। আমাদের দেশে বিদেশি কোচ যারা আসেন, তারা হয়ত এগুলো করেন না, কিন্তু খেলোয়াড়দের সংস্পর্শে না থাকলে তো তাদের এসব জানাই হয় না।”
সাবেক তারকা ফুটবলার কায়সার হামিদ, আশরাফ উদ্দিন চুন্নু, আলফাজ আহমেদ কেউই মনে করতে পারেননি, তাদের সময়ে কোচের এমন ছুটি এবং অনুপস্থিতি দেখার স্মৃতি। এক ধরনের কোচহীনতায় যে সার্বিকভাবে জাতীয় ফুটবল দল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, অপেশাদার মনোভাবের প্রতিফলন ঘটছে, তা নিয়ে একমত সবাই।
দলের সঙ্গে না থাকলে ভার্চুয়ালি অনেক সময় কাজ করেছেন জেমি। কিন্তু খেলোয়াড়দের সঙ্গে এই ভার্চুয়াল যোগাযোগটাকে খুব একটা ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখেন না বাংলাদেশের ইতিহাসের সেরা ডিফেন্ডারদের একজন কায়সার হামিদ।
“আমাদের সময়ও দুই-তিন মাস জাতীয় দলের চুক্তিবদ্ধ কোচ ছিল না। কিন্তু কোচ আছে, অথচ এরকম ছুটিতে, এটা হয়নি। যখন আপনি একজন খেলোয়াড়ের সঙ্গে মুখোমুখি কথা বলবেন, তখন বিষয়গুলো একরকম, আবার যখন ফোনে বা অন্য মাধ্যমে কথা বলবেন, তখন অন্যরকম। ভার্চুয়ালি আপনি একজন খেলোয়াড় সম্পর্কে বড়জোর একশভাগের ৬০ ভাগ জানতে পারবেন। মাঠে থাকা মানে আপনি শতভাগ এফোর্ট দিতে পারবেন। যেটা ভার্চুয়ালি কখনই সম্ভব নয়।”
চুন্নুর মতে, অনলাইনের মাধ্যমে কোচিং করানো অবাস্তব চিন্তা ছাড়া আর কিছুই নয়। খেলোয়াড়দের ফিটনেস, শারীরিক বিষয়গুলো ভার্চুয়ালি যাচাই করা, বোঝা কোনোভাবেই সম্ভব নয় বলে মত সাবেক এই তারকা উইঙ্গার।
“জাতীয় দলের খেলা না থাকলে কোচ ছুটি নিতেই পারেন। কিন্তু জাতীয় দলের খেলা না থাকলেও ক্লাবের খেলা থাকে, সেগুলোও একজন কোচের দেখা জরুরি। কিন্তু এভাবে কোচহীন থাকা ঠিক নয়। বেশ কিছু দিন ধরে দেখছি কোচ (জেমি) অনলাইনে সবকিছু করেন। অনলাইনে এসব করা আমার দৃষ্টিতে অবাস্তব চিন্তা।”
কোচের অনুপস্থিতি দলের উপর তার নিয়ন্ত্রণ নষ্ট করে বলে মনে করেন সাবেক তারকা স্ট্রাইকার আলফাজ আহমেদ। বিষয়টা তার কাছেও নেতিবাচক।
“আমরা কখনই এমন কিছু দেখিনি (কোচের দিনের পর দিন দলের সঙ্গে না থাকা)। হয়তো তার সঙ্গে এমন চুক্তি ছিল। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত মত, কোচ এভাবে ছুটিতে থাকলে দলের উপর তার কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। এটা ভালো দিক না।”
বর্ষীয়ান সংগঠক ও বাফুফের নির্বাহী কমিটির সাবেক সদস্য ফজলুর রহমান বাবুলও অতীত ঘেঁটে বলতে পারলেন না কোচের অনুপস্থিতি নিয়ে এমন কোন স্মৃতি।
“আমাদের সময় জাতীয় দল, বয়সভিত্তিক পর্যায়ে এত খেলা ছিল না। কোচ আসত টুর্নামেন্টভিত্তিক। কিন্তু কোনো কোচ এলে এভাবে যখন তখন ছুটি নিয়ে দিনের পর দিন দলের বাইরে থাকত না কেউ।”
তবু ক্ষতি দেখছে না বাফুফে
সব মিলিয়ে তার অধীনে বাংলাদেশ খেলেছে ২৯টি ম্যাচ। এর মধ্যে জয় ৯টি, ড্র পাঁচটি এবং হার ১৫টি। জেমির হাত ধরে ভারতের সল্ট লেক থেকে বিশ্বকাপ বাছাইয়ে দারুণ এক ড্র নিয়ে ফিরেছিল দল।
বাংলাদেশ কোচ হিসেবে সবচেয়ে বেশি জয় পাওয়ার পাশাপাশি তিনি বিশেষ প্রশংসা কুড়িয়েছেন খেলোয়াড়দের ফিটনেসের উন্নতি করিয়ে। পাশাপাশি, কখনও কখনও সমালোচিত হয়েছেন অতি রক্ষণাত্মক কৌশলে দলকে খেলিয়ে। কিন্তু দলের সঙ্গে পর্যাপ্ত সময় না থাকা, হুটহাট ছুটিতে যাওয়া নিয়ে হয়েছেন বেশি সমালোচিত।
৫০৪ দিনের মধ্যে মাত্র ২০৪ দিন জাতীয় দলের সঙ্গে ছিলেন জেমি। যদিও ন্যাশনাল টিমস কমিটির চেয়ারম্যান কাজী নাবিল আহমেদ মনে করেন, জেমির ছুটিতে ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি জাতীয় দল।
“জেমি এখনও কাগজে-কলমে আমাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ। শিগগিরই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। (৩০০ দিন জাতীয় দলের সঙ্গে না থাকা) তার সঙ্গে আমাদের চুক্তিটা ছিল এরকম, সপ্তাহে শুক্র-শনি এবং অনান্য ছুটি মিলিয়ে ১০০ দিনের কিছু বেশি ছুটি পাওয়ার কথা ছিল। তবে আমার মনে হয় না, কোচ এভাবে ছুটিতে থাকায় জাতীয় দল ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।”
ন্যাশনাল টিমস কমিটির চেয়ারম্যানের কথাতেও এই ‘ছুটির গল্পের’ পরিণতি বিয়োগাত্মক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তবে তার আগের হিসেব ফুটিয়ে তুলছে অবিশ্বাস্য একটি সত্যি। কাগজ-কলমের চুক্তি আছে বটে, কিন্তু বাস্তবতা বলছে, ২০২২ সালের শুরুটা বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দল করছে কোচহীন থেকে!