বছরের শুরুতে যে দল ফেডারেশন কাপে সাফল্যের আলোয় ভেসেছিল; বছরের শেষে সেই বসুন্ধরা কিংস একই টুর্নামেন্টে পেল শাস্তি! মাঝের সময়ে ঘটেছে নানা ঘটনা। প্রিমিয়ার লিগ কখনও পিছিয়েছে, কখনও মহামারীর তোয়াক্কা না করে চলেছে! ছেলেদের সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে ব্যর্থতার পর শ্রীলঙ্কার আমন্ত্রণমূলক টুর্নামেন্ট থেকে খালি হাতে ফেরার বেদনা সঙ্গী হয়েছে। আছে জাতীয় দলের কোচ তিন দফা বদলের বিস্ময়কর ব্যাপার। ঘটনাবহুল ২০২১ সালে দেশের ফুটবলে সেরা সাফল্য এসেছে মারিয়া-মগিনিদের হাত ধরে। সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে সেরা বাংলাদেশ।
Published : 28 Dec 2021, 07:38 AM
বছরের অন্যতম আলোচিত ঘটনা ছিল জেমি ডের ‘ছুটির গল্প।’ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের পনের দিন আগে হুট করেই এই ইংলিশ কোচকে ছুটি দেয় বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে)। সাফ ফুটবলে জাতীয় দল খেলে বসুন্ধরা কিংস কোচ অস্কার ব্রুসনের কোচিংয়ে। দক্ষিণ এশিয়ার সর্বোচ্চ আসরে দলের ব্যর্থ মিশন শেষে শ্রীলঙ্কার আমন্ত্রণমূলক টুর্নামেন্টের জন্য দায়িত্ব পান আবাহনী কোচ মারিও লেমোস। এই পর্তুগিজ কোচও পারেননি সাফল্য এনে দিতে। এই ‘কোচ কাহিনীর’ সবচেয়ে বাজে দিক হচ্ছে-বাংলাদেশ দল এখন কোচহীন! যা বেশ বিরল ঘটনা বৈকি।
মেয়েদের ফুটবলে আছে প্রাপ্তির শিহরণ। তারকা ফরোয়ার্ড সাবিনা খাতুন এ বছরই লিগে গোলের সেঞ্চুরি পূরণ করেছেন। মেয়েরা জিতেছে সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা। বছর জুড়ে ফুটবলের বাঁকে বাঁকে বয়ে চলা নানা গল্প এক নজরে পড়ে নেওয়া যাক।
জয়ে শুরু, শাস্তি দিয়ে শেষ
গত ১৮ ডিসেম্বরে কমলাপুরের শহীদ সিপাহী মোস্তফা কামাল স্টেডিয়ামের টার্ফে স্বাধীনতা কাপের ফাইনালে আবাহনী লিমিটেডের কাছে হেরে মুকুট হারায় তারা।
ফেডারেশন কাপের চলতি আসরে না খেলায় শাস্তি পেয়েছে কিংস! নিয়ম বর্হিভূতভাবে সূচি পরিবর্তন আর কমলাপুরের টার্ফ শীর্ষ পর্যায়ের ফুটবল খেলার উপযোগী নয়- বলে বাফুফেকে তারা চিঠি দিয়ে না খেলার সিদ্ধান্ত জানিয়েছিল। সিদ্ধান্তে অনড় থেকে উদ্বোধনী দিনে স্বাধীনতা ক্রীড়া সংঘের বিপক্ষে খেলতে আসেনি তারা। ফলে সোমবার বাফুফের ডিসিপ্লিনারি কমিটি সিদ্ধান্ত জানিয়েছে, আগামী ফেডারেশন কাপে খেলতে পারবে না কিংস। পাঁচ লাখ টাকা জরিমানাও করা হয়েছে তাদেরকে।
জুলাইয়ে তিনবার স্থগিত প্রিমিয়ার লিগ
প্রায় ১০ মাস ধরে চলা লিগে সবচেয়ে নাটকীয় মাস ছিল জুলাই। সে সময় তিনদফা স্থগিত হয় লিগ। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচতে দেশজুড়ে কঠোর লকডাউনের সিদ্ধান্ত দেয় সরকার, কিন্তু লিগ চালিয়ে নেওয়ার অদ্ভূতুড়ে অবস্থান নেয় বাফুফে। পরে এখান থেকে সরে এসে ১ জুলাই মাঝ রাতে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে লিগ স্থগিতের সিদ্ধান্ত জানায় দেশের ফুটবলের নিয়ন্তা সংস্থাটি। এরপর ২৪ জুলাই লিগ শুরুর কথা বলে ২৩ জুলাই ফের তা স্থগিত করে দেয় তারা। পরে ৩০ জুলাই ফের শুরুর ঘোষণা দেয় বাফুফে। ম্যাচ শুরুর স্রেফ এক ঘণ্টা আগে হঠাৎ লিগ স্থগিত করে বিতর্কের জন্ম দেয় তারা।
অবশেষে লিগ শেষ হয় গত সেপ্টেম্বরে। ২৪ ম্যাচে ২১ জয়, দুই ড্র ও এক হারে ৬৫ পয়েন্ট নিয়ে শিরোপা জিতে কিংস। ৫২ পয়েন্ট নিয়ে দ্বিতীয় হয় শেখ জামাল ধানমণ্ডি ক্লাব। ৪৭ পয়েন্ট নিয়ে তৃতীয় আবাহনী। ঘরোয়া ফুটবলের আরেক ঐতিহ্যবাহী দল মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব ৪৩ পয়েন্ট নিয়ে লিগ শেষ করে ষষ্ঠ স্থানে থেকে।
কোচ কাণ্ড ও সাফে ব্যর্থতা
তপু বর্মনের একমাত্র গোলে শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে শুরুটাও হয় আশা জাগানিয়া। ইয়াসিন আরাফারের শেষ দিকের গোলে ভারতের বিপক্ষে ড্র প্রত্যাশার পালে দিল বাড়তি হাওয়া-আগের চার আসরের গ্রুপ পর্ব পেরুতে না পারার বৃত্ত বুঝি ভাঙছে এবার! কিন্তু সে আশা গুড়েবালি। মালদ্বীপের কাছে ২-০ গোলে হারে জাগে স্বপ্ন ভাঙার শঙ্কা। নেপালের বিপক্ষে বাঁচা-মরার লড়াইয়ে ১-১ ড্রয়ে সে স্বপ্ন যায় গুঁড়িয়ে। জেমি থাকলেন ছুটিতেই, জাতীয় দলের অন্তর্বর্তীকালীন কোচের দায়িত্ব ছাড়লেন ব্রুসনও।
ব্যর্থ শ্রীলঙ্কা মিশনে মালদ্বীপকে হারানোর আনন্দ
লেমোসের অধীনে বাংলাদেশের লঙ্কা মিশন শুরু হয় আফ্রিকার দল সিশেলসের বিপক্ষে শেষ মুহূর্তে গোল হজম করে ১-১ ড্র দিয়ে। তবে পরের ম্যাচেই দারুণ এক প্রাপ্তির আনন্দে ভাসে বাংলাদেশ। জামাল ও তপুর গোলে মালদ্বীপকে ২-১ হারায় বাংলাদেশ। ২০০৩ সালে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে সবশেষ মালদ্বীপের বিপক্ষে জয়ের ১৮ বছর পর ফের উৎসবে মাতে দল। গত অক্টোবরের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে হারের ক্ষতেও পড়ে কিছুটা প্রলেপ। কিন্তু শেষটা মেলেনি চাওয়া অনুযায়ী। ফাইনাল খেলতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ড্রয়ের প্রয়োজন ছিল, কিন্তু দল হেরে যায় ২-১ গোলে। এ ম্যাচেই তপু মিস করেন পেনাল্টি।
মারিয়া-মনিকা-রিপাদের উৎসব
দ্বিতীয় ম্যাচ থেকে অবশ্য আর পিছু ফিরে তাকাননি মারিয়া-মগিনি-রিপারা। ভুটানকে ৬-০ গোলে উড়িয়ে দেওয়ার পর ভারতকে হারান ১-০ গোলে। এরপর শ্রীলঙ্কাকে ১২-০ গোলে ভাসিয়ে ওঠেন ফাইনালের মঞ্চে। সেখানে আনাই মগিনির একমাত্র গোলে আবারও ভারতকে হারানোর আনন্দে ডানা মেলে বাংলাদেশ। প্রতিযোগিতার সর্বোচ্চ গোলদাতা (৫টি) ও সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জিতে নেন শাহেদা আক্তার রিপা। এক হিসাবে বাংলাদেশও ধরে রাখে মুকুট। ২০১৮ সালে এ প্রতিযোগিতাটি হয়েছিল অনূর্ধ্ব-১৮ বছর বয়সীদের নিয়ে; সেবারও শিরোপা জিতেছিল ছোটনের দল।
মেয়েদের ফুটবলে ক্লাব পর্যায়ে লিগের মুকুট ধরে রাখে বসুন্ধরা কিংসের মেয়েরা। কৃষ্ণা রানী সরকার হন লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা। এ বছরই লিগে গোলের সেঞ্চুরি পূরণ করেন তারকা ফরোয়ার্ড সাবিনা খাতুন।
এছাড়া করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বন্ধ থাকা মেয়েদের আন্তর্জাতিক ফুটবলে দুই বছর পর পা পড়ে বাংলাদেশের। যদিও ৯ সেপ্টেম্বর নেপালের বিপক্ষে দুই প্রীতি ম্যাচে সাবিনাদের অভিজ্ঞতা সুখের ছিল না মোটেও। প্রথম ম্যাচে ২-০ গোলে হারের পর দ্বিতীয় ম্যাচে গোলশূন্য ড্র করে দল। নেপাল থেকে উজবেকিস্তানে এএফসি এশিয়ান কাপের বাছাই খেলতে গিয়েও হয় তিক্ত অভিজ্ঞতা। জর্ডান ও ইরান-দুই দলের কাছে হার ৫-০ গোল ব্যবধানের। এরপর সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে অবশ্য হংকংয়ের বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচে একই ব্যবধানে জিতেন সাবিনা-কৃষ্ণারা।
টার্ফে এসে টালমাটাল ফুটবল
২৫ ডিসেম্বর প্রতিযোগিতা শুরুর আগের দিন বাফুফেকে চিঠি দিয়ে নিয়ম ভেঙে সূচি তৈরি ও টার্ফ খেলার অনুপোযোগী উল্লেখ করে না খেলার সিদ্ধান্ত জানায় কিংস। টার্ফ নিয়ে অভিযোগ তোলে উত্তর বারিধারা, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্রও। উদ্বোধনী দিনে মাঠে কিংস ও উত্তর বারিধারার অনুপস্থিতি দিয়ে জটিলতার শুরু। এরপর দল দুটিকে ফেডারেশন কাপের পরবর্তী আসরে নিষেধাজ্ঞা দেয় বাফুফের ডিসিপ্লিনারি কমিটি। গত সোমবার মুক্তিযোদ্ধা সংসদও আসেনি মাঠে। এই তিন দল বাইরে রেখে নতুন সূচি দিয়ে ফেডারেশন কাপ চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে অনড় থাকা বাফুফে।
এমন পরিস্থিতিতে সোমবার আরেক কাণ্ড ঘটে মোহামেডান ও স্বাধীনতা ক্রীড়া সংঘের মধ্যেকার ম্যাচে। কিংসের অনুপস্থিতিতে এই দুই দলের ‘এ’ গ্রুপে থেকে কোয়ার্টার-ফাইনাল খেলা নিশ্চিত হয়েছিল আগেই; তারা এদিন মুখোমুখি হয়েছিল গ্রুপ সেরা হওয়ার লড়াইয়ে। নির্ধারিত সময়ের খেলা ১-১ সমতার পর খেলোয়াড়রা ছেড়েছিলেন মাঠ। কেউ কেউ টিম বাসেও উঠেছিলেন। নিভে গিয়েছিল স্টেডিয়ামের ফ্ল্যাড লাইট। পরে খেলোয়াড়দের ডেকে এনে, আলো জ্বালিয়ে টাইব্রেকার আয়োজন করা হয়! তাতে কে গ্রুপ সেরা তা শেষ পর্যন্ত ঠিক করা গেছে বটে কিন্তু ফুটবলের তলানির অন্ধকারটুকু বছর শেষে আড়াল করা যায়নি কোনোভাবেই।