টানা কাজের ক্লান্তি ভর করেছে শরীরে। পেয়ে বসেছে মানসিক অবসাদ। তিল তিল করে গড়ে তোলা দলের অভ্যন্তরে ‘বিভক্তির সুর’, নানা পক্ষের অযাচিত ‘হস্তক্ষেপ’ অতিক্রম করেছে সহ্যের সব সীমা! মেয়েদের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশকে প্রথম শিরোপা এনে দেওয়া কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন তাই দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনকে (বাফুফে) অবশ্য এখনও চিঠি দেননি ছোটন। এক-দু’দিনের মধ্যেই জানিয়ে দেবেন বলে জানালেন তিনি। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আলাপচারিতায় মন খুলে কথা বললেন ছোটন। আড়াল করলেন না রাগ, ক্ষোভ, হতাশা, উষ্মা কোনোটাই।
জাতীয় দলের তারকা ফরোয়ার্ড সিরাত জাহান স্বপ্না বৃহস্পতিবার ফেইসবুকে পেশাদার ফুটবলকে বিদায় দেওয়ার বার্তা পোস্ট করেন। একই দিনে জাতীয় দলের কোচের পদ ছাড়ার ইঙ্গিত দেন ছোটনও; যার হাত ধরেই মেয়েদের ফুটবলে বাংলাদেশের সব সাফল্যের গল্প লেখা।
২০০৮ সালে বয়সভিত্তিক দলে কাজ করার পরের বছর জাতীয় দলের হাল ধরেন ছোটন। ৫৪ বছর বয়সী এই কোচের অধীনে গত সেপ্টেম্বরে দক্ষিণ এশিয়ার মেয়েদের ফুটবলের সর্বোচ্চ আসর সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জেতে বাংলাদেশ।
ওই সাফল্যের পর থেকে জাতীয় দলের খেলা নেই। সবশেষ অলিম্পিক বাছাইয়ে মিয়ানমারে বাফুফে দল পাঠায়নি আর্থিক সংকটের কথা বলে। এছাড়া আরও অনেক বিষয় নিয়ে ক্লান্ত বলে জানালেন ছোটন।
“এখনও আমি আগের সিদ্ধান্তেই (সরে দাঁড়ানোর) আছি। ২৯ কিংবা ৩০ তারিখের দিকে চিঠি দিয়ে বাফুফেকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানাব। এই দায়িত্বে অনেক দিন তো হলো, ছয়-সাত বছর ধরে একের পর এক টুর্নামেন্ট, সবকিছু মিলিয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে আমি ক্লান্ত। প্রথমে বিশ্রাম নেব, এরপর কাজ খুঁজব।”
“(সরে দাঁড়ানোর পেছনে) অনেক কারণই আছে। গত সেপ্টেম্বরে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ হয়েছে, এরপর আর কোনো খেলা নেই। অন্য দলগুলো একের পর এক ম্যাচ খেলছে আর আমরা বসে আছি। আমরা অলিম্পিকের বাছাইয়েও খেলতে পারলাম না। প্রতিদিন সকালে যখন আপনি খেলোয়াড়দের অনুশীলন করাবেন, তারা যখন জিজ্ঞেস করবে-অনুশীলন কেন করছি? কোন ম্যাচের জন্য? তখন তো আমাকে জবাব দিতে হবে।”
দলের প্রধান কোচ হলেও ছোটন সর্বেসর্বা নন। জাতীয় দল কিংবা বয়সভিত্তিক পর্যায়ে টুর্নামেন্ট কাভার করা গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে পরিচিত দৃশ্য ডাগআউট থেকে বাফুফের টেকনিক্যাল ও স্ট্র্যাটেজিক ডিরেক্টর পল স্মলির নির্দেশনা দেওয়ার বিষয়টি।
এমন সব ‘হস্তক্ষেপ’ এখন আর মানতে পারছেন না ছোটন। দলের মধ্যে ভাঙনের সুরও শুনতে পাচ্ছেন তিনি, যদিও এজন্য মেয়েদের দায় দিচ্ছেন না তিনি একটুও।
“সুযোগ থাকলে তো যে কেউ হস্তক্ষেপ করবেই। আমরা তো সবকিছু সহ্য করে এসেছি। এখন আর পারছি না। বয়স হয়েছে, অতিরিক্ত পরিশ্রম হচ্ছে, এখন আর অযাচিত বিষয়গুলো… ২০-২৫ বছর বয়সে এগুলো মেনে নেওয়া যায়, ৫৪ বছর বয়সে মেনে নেওয়া যায় না। মানুষ বাঁচেই কতদিন?”
“মেয়েরা এখন আর নিয়ন্ত্রণে থাকছে না অন্য কারণে। যদি একটা নিয়মের মধ্যে চলা যায়, তাহলে একরকম আর বিভিন্ন জন যখন বিভিন্ন রকম করে চালাতে চায়, তখন অন্যরকম হয়ে ওঠে পরিস্থিতি। মেয়েরা তখন তো বিভ্রান্ত হবেই। যদি দলের মধ্যে আমরাই পাঁচভাগে বিভক্ত থাকি, তাহলে সেটা তো শুধু মেয়েদের দোষ নয়।”
তবে এতদিনে স্নেহে-শাসনে গড়ে তোলা মেয়েদের জন্য খারাপ লাগার কথাও জানালেন ছোটন। সময়ের সঙ্গে তারা বাস্তবতার সঙ্গে মানিয়ে নেবে বলেও মনে করেন তিনি।
“২০১৭ সালে আমার মা মারা গেলেন। তাকে মাটি দিয়ে তিন দিন পরই সিঙ্গাপুর গেলাম সফরে। শোক নিয়েই তো গিয়েছিলাম। পরে তো ঠিকই নিজের কাজটুকু করলাম। আমার চলে যাওয়ার খবরে মেয়েদেরও খারাপ লাগবে, আমার নিজেরও খারাপ লাগবে, কিন্তু আস্তে আস্তে সবাই বাস্তব জীবনে মানিয়েও নেবে।”
পরিবারের সঙ্গে আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলেও জানালেন ছোটন। ভবিষ্যৎ ভাবনার চেয়ে ক্লান্ত, বিক্ষিপ্ত মন ও শরীরকে একটু বিশ্রাম দেওয়ার তাড়না ঘুরেফিরেই শোনা গেল তার কণ্ঠে। বসুন্ধরা কিংসের দায়িত্ব নেওয়ার গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে, এমন প্রশ্নে দিলেন ‘না-সূচক’ উত্তর।
“পরিবারের সঙ্গে সবার আগে আলোচনা করেছি। আমিও তো মানুষ। এখানে এমনও দিন গেছে, আমি বিছানা থেকে উঠতে পারিনি, কিন্তু মেয়েদের অনুশীলন করাতে হয়েছে। এখন আমি শারীরিক, মানসিক সবভাবেই ক্লান্ত।”
“ভবিষ্যৎ নিয়ে এখনও ভাবিনি। গত নভেম্বরে সুযোগ ছিল, তখন তো ফেডারেশন ছাড়েনি। এখনও জাতীয় দলের দায়িত্বে আছি, এটা ছাড়ার পর বিশ্রাম নেব, তারপর চাকরি খুঁজব। কেননা, আমি না যাওয়াতে বসুন্ধরা কিংস কোচ নিয়ে নিয়েছে, এখন আমাকে নেবে কিনা, তা তো জানি না।”