স্বপ্নের ভেলায় চেপে কাতারে যাবে মেসির আর্জেন্টিনা

বিশ্বকাপের তৃতীয় শিরোপা জয়ের জন্য মুখিয়ে আছে ‘লা আলবিসেলেস্তারা।’

স্পোর্টস ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 Oct 2022, 03:18 PM
Updated : 5 Oct 2022, 03:18 PM

টানা ৩৫ ম্যাচের অজেয় যাত্রা, কোপা আমেরিকা দিয়ে দীর্ঘ শিরোপা খরা কাটানোর তৃপ্তি, দলে লিওনেল মেসির মতো নির্ভরতা, সর্বোপরি একটা দল হয়ে ওঠার বাড়ন্ত আত্মবিশ্বাসে ভর করে কাতার বিশ্বকাপে নোঙর ফেলবে আর্জেন্টিনা। স্বপ্ন, প্রত্যাশা, লক্ষ্য একটাই-আরও একবার বিশ্বকাপের ট্রফিতে চুমু আঁকা, ১৯৮৬ বিশ্বকাপের পর যে ট্রফি আর ছুঁয়ে দেখা হয়নি।

ব্রাজিলের ঐতিহ্যবাহী মারাকানা স্টেডিয়ামে ২০২১ সালে কোপা আমেরিকার শিরোপা জয়ের পর আর্জেন্টিনার স্বপ্ন ডানা মেলতে শুরু করে আরও প্রবলভাবে। একটা লক্ষ্যই ঘুরপাক খাচ্ছে তাদের মাথায়, বিশ্বকাপের তৃতীয় ট্রফি উঁচিয়ে ধরা।

মেসি থাকায় লক্ষ্যপূরণের বিশ্বাস পাচ্ছে আরও শক্ত ভিত। ৩৫ বছর বয়সী এই ফরোয়ার্ডের শৈল্পিক পা জোড়া বিশ্বকাপের আঙিনায় এ নিয়ে পঞ্চমবারের মতো পড়তে যাচ্ছে। খুব সম্ভবত এটাই শেষবার। তবে শুধু মেসির উপস্থিতি নয়, আরও অনেক কারণে এবারের শিরোপার দাবিদারদের একটি আর্জেন্টিনা।

কোপা আমেরিকার আগে-পরে বিশ্বকাপ বাছাইয়ে ধুন্ধুমার পারফরম্যান্স দেখিয়ে আর্জেন্টিনা জানান দিয়েছে সামর্থ্যের। ১১ জয় ও ৬ ড্রয়ে ৩৯ পয়েন্ট নিয়ে লাতিন আমেরিকা অঞ্চলের বাছাইয়ে দ্বিতীয় হয় তারা। পয়েন্ট টেবিলে আর্জেন্টিনার ওপরে ছিল ব্রাজিল (৪৫ পয়েন্ট)। তৃতীয় স্থানে থাকা উরুগুয়ের চেয়ে ১১ পয়েন্ট এগিয়ে ছিল লিওনেল স্কালোনির দল।

মুগ্ধতা ছড়ানো সব পরিসংখ্যান, বাছাইয়ে দলের দাপুটে পারফরম্যান্স এবং গত বছর কোপা আমেরিকা জয়-এগুলো আর্জেন্টাইনদের মনে আরেকটি বিশ্বকাপের স্বপ্ন দেখার আত্মবিশ্বাসের বীজ বুনে দেয়।

২০১৪ সালে ব্রাজিলের আসরে ফাইনালে উঠে ইতিহাস গড়ার খুব কাছাকাছি পৌঁছে শেষ মুহূর্তে হেরে যাওয়ার তীব্র কষ্ট এবং পরের দুই বছরে কোপা আমেরিকার দুই ফাইনালে হারের হতাশা পেয়ে বসেছিল আর্জেন্টিনাকে। এরপর ২০১৮ সালের রাশিয়া বিশ্বকাপে শেষ ষোলোয় ফ্রান্সের বিপক্ষে হেরে বিদায়।

সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বারবার আক্ষেপ নিয়ে ফেরা একটা প্রজন্মের বিদায় ‘লা আলবিসেলেস্তাদের’ বিষন্ন করে তুলে। উত্তরসূরিদের সম্ভাবনা নিয়েও জাগে দ্বিধা। কিছু নামকরা কোচও আর্জেন্টিনার মহাভার কাঁধে তুলতে চাননি। মুখ ফিরিয়ে নেন!

এমন কঠিন সময়ে স্কালোনির দৃশ্যপটে আসেন। আর্জেন্টিনা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের (এএফএ) সভাপতি ক্লাওদিও তাপিয়া আস্থা রাখেন অপরীক্ষিত এই কোচের উপর। ২০১৮ সালে আর্জেন্টিনার তখনকার কোচ হোর্হে সাম্পাওলির কোচিং স্টাফে ছিলেন স্কালোনি।

আনকোরা স্কালোনিই দলকে অনুপ্রাণিত করলেন দুর্দান্তভাবে। চার বছর পর তার হাত ধরেই আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপে যাচ্ছে তুমুল আত্মবিশ্বাস নিয়ে, হতাশায় মোড়ানো বছরগুলো পেছনে ফেলে এবং মনস্তাত্ত্বিক যে বাধাগুলো ছিল, সেগুলো ডিঙিয়ে।

মেসির নেতৃত্বে থিতু একটা লাইন-আপ পেয়েছে তৃতীয় বিশ্বকাপের স্বপ্নে বিভোর আর্জেন্টিনা। নতুন একটা প্রজন্মও আছে; যাদের সামর্থ্য আছে এই ঐতিহ্যবাহী জার্সির প্রতি সুবিচার করার। স্কালোনির মতো কৌশলী, তীক্ষ্ণবুদ্ধির কোচ তো আছেই।

স্কালোনির পরিকল্পনা ও কৌশল

প্রথমবারের মতো জাতীয় দলের দায়িত্ব নেওয়া স্কালোনি এরই মধ্যে অবিস্মরণীয় কিছু করে ফেলেছেন। যখন বাঘা বাঘা কোচ আর্জেন্টিনার দায়িত্ব নিতে চাননি, ২০১৮ সালে আর্জেন্টিনা অনূর্ধ্ব-২০ দলকে লা’আলকুদিয়া ইন্টারন্যাশনাল ফুটবল টুর্নামেন্টে শিরোপা এনে দেওয়া স্কালোনি এগিয়ে এলেন; অন্তর্বর্তীকালীন কোচ হিসাবে ধরলেন দিকহারা আর্জেন্টিনার হাল।

দুইবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের জন্য যেটা খুব প্রয়োজন ছিল, সেটাই শুরুতে করলেন স্কালোনি। আগের প্রজন্মকে ছেঁটে নতুনের সন্নিবেশ ঘটালেন দলে; এমনকি কোচিং স্টাফেও। শুরুতে জুটেছিল স্বল্পমেয়াদী চুক্তি, ২০১৯ সালের কোপা আমেরিকা পর্যন্ত দায়িত্ব। ওই আসরে সবাইকে উজ্জীবিত করে দলকে তুললেন সেমি-ফাইনালে। ব্রাজিলের কাছে হেরে ছিটকে গেলেও আর্জেন্টিনার সামনের পথচলার ভিতটা তৈরি হয়ে গেল সেবারই।

২০২০ কোপা আমেরিকা এবং ২০২২ কাতার বিশ্বকাপের জন্য প্রধান কোচের পদে টিকে গেলেন স্কালোনি। করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে ২০২০ সালের কোপা আমেরিকা মাঠে গড়াল পরের বছর। ততদিনে স্কালোনিও নতুন মুখের সমাবেশ ঘটিয়ে মেসিকে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হতে সহযোগিতা করার মতো আঁটসাঁট, শক্তপোক্ত একটা দল গুছিয়ে ফেললেন।

পোস্টের নিচে এলেন এমিলিয়ানো মার্তিনেস। ক্রিস্তিয়ান রোমেরোকে সুযোগ দেওয়া হলো সেন্ট্রাল ডিফেন্সে থিতু হওয়ার এবং লেয়ান্দ্রো পারেদেস আগের ভূমিকা বদলে হয়ে উঠলেন বিশ্বস্ত সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার। আক্রমণভাগে লাউতারো মার্তিনেস তার দক্ষতা দেখালেন; আনহেল দি মারিয়া হয়ে উঠলেন ম্যাচ উইনার। যেন আমূল বদলে গেল আর্জেন্টিনা। পরিণত হলো দারুণ অনুপ্রাণিত, উজ্জীবিত, উদ্বুদ্ধ একটা দলে।

সাফল্যও এলো সূত্র মেনে। ব্রাজিলকে তাদের মাঠেই হারিয়ে ২৮ বছর পর ভুলে যাওয়া কোপা আমেরিকা শিরোপার স্বাদ ফিরে পেল আর্জেন্টিনা; ইউরোর চ্যাম্পিয়ন ইতালিকে হারিয়ে ফিনালিস্সিমা ট্রফিও জিতল তারা এবং দীর্ঘ খরায় ভোগা আর্জেন্টিনা সাফল্যের বর্ষণে সিক্ত হলো ‘অপ্রত্যাশিতভাবে’ কোচ হওয়া স্কালোনির হাত ধরে।

তবে মেসি-মার্তিনেসদের পা ঠিকই আছে বাস্তবের শক্ত জমিনে। এখন বিশ্বকাপের ‍চূড়ান্ত লক্ষ্য পূরণে স্কালোনিকে কাজে লাগাতে হবে একই রেসিপি।

চাবিকাঠি লিওনেল মেসি

৩৫ বছর বয়সেও তিনি আগের মতোই অনুপ্রেরণাদায়ী। সময়ের সাথে সাথে ১০ নম্বর জার্সিটা তার সঙ্গে মানিয়ে গেছে দারুণভাবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, কাতার বিশ্বকাপ অভিযানে তিনিই হবেন আর্জেন্টিনার কাণ্ডারি।

অনেক অপেক্ষার ক্ষণ পেরিয়ে, সমালোচনার স্রোত ডিঙিয়ে আর্জেন্টিনার হয়ে শিরোপার স্বাদ মেসি পেয়েছেন কোপা আমেরিকা ট্রফি জিতে। কিন্তু আসল স্বপ্ন পূরণ এখনও বাকি। অর্জনের লম্বা শোকেসে ভুরিভুরি ট্রফি আলো ছড়ালেও সেখানে নেই বিশ্বকাপ। মেসির শূন্যতার এই হাহাকার ঘুচিয়ে দিতে মুখিয়ে আছে অনেক নতুনে সাজানো স্কালোনির আর্জেন্টিনা।  

বয়স বেড়েছে, প্রকৃতির নিয়ম মেনে তার কিছুটা ছাপও পড়েছে। তবে বার্সেলোনা ছেড়ে পিএসজিতে যাওয়ার পর মেসির পারফরম্যান্স ঘিরে যে দুর্ভাবনা জেঁকে বসেছিল, তা দূর হতে শুরু করেছে। চলতি মৌসুমে যেন আবারও সেই পুরনো মেসিকে ফিরে পেতে শুরু করেছে ফুটবল।

এখনও তিনি ম্যাচের নির্ণায়ক হয়ে উঠতে পারেন সুযোগ তৈরি করে, সুযোগ কাজে লাগিয়ে। এ নিয়ে প্রশ্ন বা সন্দেহের অবকাশ নেই।

তার জাদুকরী বাঁ পা নিয়ে বলার কিছু আর নেই বাকি। তার মেধা, সেট-পিসের দক্ষতা, দূরদৃষ্টি ম্যাচ পড়তে পারার সক্ষমতা বা গোল করার সামর্থ্য, চোখ ধাঁধানো ড্রিবলিং, প্রতিপক্ষের ছোটখাটো ভুলের সুযোগ নেওয়ার অবিশ্বাস্য পারদর্শিতা-সব কিছু নিয়ে গল্প লেখা হয়েছে দিনের পর দিন। বৈশ্বিক ফুটবলের চূড়ায় প্রায় দুই দশক ধরে বসে আছেন মেসি, তিনিও এবার কাতারে পা ফেলবেন অপ্রাপ্তি ঘোচানোর দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে। বিশ্বকাপকে পাখির চোখ করে।

চোখ থাকবে হুলিয়ান আলভারেসের ওপরও

মেসি তো আছেনই; বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার স্বপ্ন পূরণে নির্ণায়ক হয়ে উঠতে পারেন তরুণ আলভারেসও।

রিভার প্লেটের হয়ে আলো ঝলমলে পারফরম্যান্স দিয়ে পাদপ্রদীপের আলোয় উঠে আসা আলভারেসের। রিভার প্লেটের লিগ জয়ের পথে মূল্যবান সব গোল করে অবদান রেখেছিলেন ২২ বছর বয়সী এই ফরোয়ার্ড। নজরে পড়েন ম্যানচেস্টার সিটির কোচ পেপ গুয়ার্দিওলার। সিটির জার্সিতেও এরই মধ্যে নিজের সামর্থ্যের ছাপ রেখেছেন আলভারেস। আরও এগিয়ে যাওয়ার বার্তা তিনি দিয়ে চলেছেন ধারাবাহিকভাবে।

গুয়ার্দিওলার কণ্ঠেও আলভারেসকে নিয়ে উচ্ছ্বাসের কমতি নেই। তরুণ এই আর্জেন্টাইনের বলের সঙ্গে সারাক্ষণ সেঁটে থাকার সামর্থ্যে মুগ্ধ সিটি কোচ।

“আমরা হুলিয়ানকে নিয়ে দারুণ খুশি। সবাই আর্লিং হলান্ডকে নিয়ে কথা বলে এবং আমরা তাকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত, কিন্তু হুলিয়ান দুর্দান্ত একজন খেলোয়াড়।”

“সে খুবই বিনয়ী, সবসময় ইতিবাচক এবং অনুশীলনে সবটুকু নিংড়ে দেয়। এমন খেলোয়াড়কে আমি পছন্দ করি। সে সবসময় বলের কাছে থাকে এবং সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় থাকার সহজাত প্রবৃত্তি তার আছে। খেলার সুযোগ পেলেই সে দেখায় যে কী করতে পারে।”

এছাড়াও চোখ রাখতে হবে বেনফিকার এনসো ফের্নান্দেসের ওপর। ২১ বছর বয়সী এই মিডফিল্ডার সবে আন্তর্জাতিক ফুটবলের আঙিনায় পথচলা শুরু করেছেন, তবে তিনিও স্কালোনির দলে প্রভাব রাখতে পারেন। যাই হোক, প্রথম পছন্দের লাউতারো মার্তিনেসকে সঙ্গ দেওয়ার মতো নির্ভরযোগ্য দ্বিতীয় পছন্দের ফরোয়ার্ড না থাকার অর্থ হচ্ছে, কাতার বিশ্বকাপে আসলে আলভারেসের ওপর আর্জেন্টিনার নির্ভরতা থাকবে বেশি।

আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ ইতিহাস

সবশেষ রাশিয়া বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বেই ভজঘট পেকে গিয়েছিল আর্জেন্টিনার। ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে পীড়াদায়ক হারে তারা গ্রুপ রানার্সআপ হয়ে শেষ ষোলোয় মুখোমুখি হয়েছিল ফ্রান্সের। ৭ গোলের রোমাঞ্চকর ম্যাচটি আর্জেন্টিনা শেষ করেছিল ৪-৩ ব্যবধানের হারের বিষাদে ডুবে।

তাদের ওই হার ছিল সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে লাতিন আমেরিকার দলগুলোর হতাশাজনক পরাজয়ের একটি।

আর্জেন্টিনার জন্য এর চেয়ে কষ্টের ছিল ২০১৪ বিশ্বকাপের ফাইনালে জার্মানির কাছে অতিরিক্ত সময়ের গোলে হেরে যাওয়া। ২০০৬ সালের আসরে কোয়ার্টার-ফাইনালে এই জার্মানির কাছেই টাইব্রেকারে চুরমার হয়েছিল স্বপ্ন; অথচ সেবার মনে হচ্ছিল, নির্ধারিত সময়ে অনায়াসে জার্মান যন্ত্রকে বিকল করে জয়ের উচ্ছ্বাসে ভাসবে আর্জেন্টিনা!

যাই হোক, আর্জেন্টিনা এবং মেসি চেষ্টা চালিয়ে যাবে। হতে পারে, এটাই মেসির শেষ বিশ্বকাপ। ১৯৮৬ সালে মেক্সিকো বিশ্বকাপে দিয়েগো আরমান্দো মারাদোনার অর্জনের পুনরাবৃত্তি করতে মুখিয়ে থাকবেন ‘লা পুলগা।’ সেবার শেষ আটের লড়াইয়ে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মারাদোনার সেই কীর্তি, ‘হ্যান্ড অব গড’ খ্যাত গোল-এখনও সব আর্জেন্টাইনদের মুখে মুখে ফেরে, সেবারই ‘লা আলবিসেলেস্তারা’ দ্বিতীয় বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ পেয়েছিল।

প্রথম শিরোপা তারা জিতেছিল ১৯৭৮ সালে, নিজেদের মাঠে।

এবার বিশ্বকাপের লড়াই কাতারে। মধ্যপ্রাচ্যের মরুদ্যানে মেসি এবং আর্জেন্টিনা সাফল্যের ফুল ফোটাতে পারে কি-না, সেটাই এখন দেখার অপেক্ষা।