বর্ণবিদ্বেষ ও শ্রেণিষৈম্যের সমাজে দরিদ্র পরিবেশ থেকে উঠে আসা কৃষ্ণাঙ্গ ফুটবলার এদসন আরান্তেস দো নাসিমেন্তোই দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ব্রাজিলের সফলতার মহানায়ক, যিনি বিশ্বের বুকে লাখো কোটি ফুটবলপ্রেমীর কাছে পেলে নামেই পরিচিত।
ষাটের দশকে অস্থির রাজনীতি আর স্বৈরশাসনের দিকে না তাকিয়ে পেলে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন ফুটবলের মাঠে, অনন্য কসরত আর অসাধারণ নেতৃত্বে ব্রাজিলকে এনে দিয়েছেন তিনটি বিশ্বকাপ।
সেইসঙ্গে শ্রেণিবিভাজন দূরে ঠেলে ফুটবল দিয়েই একটি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন তিনি, সমাজের উঁচু-নিচু ভেদাভেদ দূর করে ব্রাজিলের মানুষকে নিয়ে এসেছিলেন এক কাতারে।
বৃহস্পতিবার রাতে ফুটবলের এই ‘মহারাজা’ পেলের প্রয়াণের খবর আসতেই সাও পাওলোর আলবার্ট আইনস্টাইন হাসপাতালে ঢল নামে মানুষের; শোকার্ত ভক্ত-অনুরাগীদের অনেকের গায়ে ছিল পেলের ১০ নম্বর জার্সি; হাসাপাতালের বাইরে ব্যানার টাঙিয়ে লেখা হলো ‘চিরঞ্জীব রাজা পেলে’।
মাসখানেক ধরে ওই হাসপাতালেই চিকিৎসাধীন ছিলেন পেলে। তার মেয়ে কেলি নাসিমেন্তো ইনস্টাগ্রামে পেলের ছবি পোস্ট করে তার শারীরিক অবস্থার কথা ভক্তদের জানাচ্ছিলেন। ফুটবলের রাজার খবর পেতে প্রত্যেক পোস্টই ব্যাপক আগ্রহের সঙ্গে দেখছিলেন বিশ্বের লাখো ভক্ত।
ক্যান্সারের সঙ্গে পেলের সে লড়াই শেষ হয় বৃহস্পতিবার; হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এক বিবৃতিতে জানায়, কোলন ক্যান্সারের প্রভাবে একসঙ্গে শরীরের অনেক অঙ্গ বিকল হয়ে গত হয়েছেন তিনি।
বিবিসি এক প্রতিবেদনে লিখেছে, পেলের এই প্রস্থানের খবর কেবল একটি মেডিকেল বুলেটিন ছিল না, তা ছিল আরও বেশি কিছু। হাসপাতালের পক্ষ থেকে পেলের মৃত্যুতে শোক ও তার পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানানো হয়।
ব্রাজিলিয়ানদের জন্য পেলে কতোটা গুরুত্বপূর্ণ, তারই একটি নমুনা এটি। পেলে অবশ্যই বিশ্বের একজন ফুটবল কিংবদন্তি, আর ব্রাজিলিয়ানদের জন্য তার চেয়েও বেশি কিছু।
ব্রাজিলের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট লুলা ডা সিলভা শোক প্রকাশ করে বলেছেন, কিংবদন্তি পেলের খেলা দেখার সৌভাগ্য তার হয়েছে; সেটা নিছক ‘খেলা’ নয়, সেটি ছিল রীতিমত এক ‘প্রদর্শনী’।
রোববার প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিতে যাওয়া লুলা টুইটে বলেন, “পেলে ব্রাজিলের নাম যতটা বিশ্বের বুকে তুলে ধরতে পেরেছেন, খুব কম ব্রাজিলিয়ানই সেটা করতে পেরেছেন। তার মতো ‘১০ নম্বর’ আর কেউ ছিল না।”
বিবিসি লিখেছে, প্রত্যেক ব্রাজিলিয়ানের কাছে পেলে মানে বিশেষ কিছু। পুরনো প্রজন্ম তাকে একজন খেলোয়াড় হিসাবে মনে রেখেছে, তরুণ ব্রাজিলিয়ানদের কাছে পেলের অসাধারণ দক্ষতার গল্প রয়েছে; কিন্তু আসলে তিনি এই ফুটবল জাতির মানুষকে একত্রিত করেছিলেন।
ব্রাজিলকে বোঝানো হয় ফুটবল দিয়েই। বিশ্বকাপের সময় ব্রাজিলিয়ানদের ছুটি দেওয়া হয়। এবারের কাতার বিশ্বকাপেও হাসপাতালের বিছানা থেকে পেলে তাদের উৎসাহ যুগিয়েছেন, মঙ্গল কামনা করেছেন। আর এ টুর্নামেন্টের পর তিনবার বিশ্বকাপ জেতা বিশ্বের একমাত্র ফুটবলারের মৃত্যুর ঘটনা আরও হৃদয়বিদারক।
ফুটবলে আগ্রহ নেই বা আগ্রহ কম এমন লোকেরাও পেলেকে ফুটবলের রাজা হিসেবে বর্ণনা করেন। মনেপ্রাণে তিনি ব্রাজিলিয়ান ছিলেন। বিদেশি ক্লাবগুলোতে খেলার পরিবর্তে দীর্ঘদিন ব্রাজিলের ফুটবল ক্লাব সান্তোসের হয়ে খেলে গেছেন।
ব্রাজিলের সাবেক প্রেসিডেন্ট জানিও কোয়াদ্রোস ক্যাস্তেলিনো ১৯৬১ সালে পেলেকে ‘জাতীয় সম্পদ’ ঘোষণা করেন। এর ফলে বছরের পর বছর ধরে বিদেশি ক্লাবের হয়ে তাকে খেলার জন্য পাঠানো যায়নি। জাতীয় নায়কের মর্যাদা ও গুরুত্ব ছিল তার।
দক্ষিণ আমেরিকার দেশটিতে বর্ণবিদ্বেষ ও শ্রেণিবিভাজন এখনও চরমে; আর এমন পরিস্থিতিতেও সমাজের দরিদ্র পরিবেশ থেকে উঠে আসা কৃষ্ণাঙ্গ এই ফুটবলারই অবিশ্বাস্য সফলতার মহানায়ক।
বর্ণবিদ্বেষ নিয়ে খুব কমই কথা বলতেন পেলে, যার কারণে একসময় সমালোচনাও হয়েছে। কিন্তু দরিদ্র ব্রাজিলিয়ানদের সুযোগ করে দিতে, সমগ্র জাতিকে এক করার ক্ষেত্রে তিনি ফুটবলের শক্তিকে কাজে লাগিয়েছেন।
রাজনীতির প্রশ্নে নীরব থাকতেন পেলে। অনেকে আবার তার ব্যাপক প্রভাবের মধ্যে একে একটি দুর্বল জায়গা ভাবতেন। ব্রাজিলে ১৯৬৪ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত ২১ বছরের স্বৈরতন্ত্র ও অশান্ত রাজনৈতিক পরিবেশ প্রত্যক্ষ করে গেছেন পেলে।
এখন আবার রাজনীতিতে ক্রমশ বিভক্ত হয়ে ওঠা ব্রাজিলে পেলের এই নীরবতা তাকে রাজনীতি থেকেও অনেক দূরে নিয়ে যায়, মাঠ এবং মাঠের বাইরেও ব্রাজিলিয়ানদের রাজা হিসেবে সর্বজনীনভাবে তাকে জনপ্রিয় ও সম্মানিত করে তোলে।
সর্বকালের সেরা এই ফুটবলারের সময় শেষে হয়ে গেছে, কিন্তু ব্রাজিলে তার স্মৃতি আর অবদান চিরন্তন।
আরও খবর