পদ্মার চরে চাষাবাদের পাশাপাশি নতুন নতুন কর্মসংস্থান তৈরিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে বলে জানায় কৃষি বিভাগ।
Published : 07 Aug 2023, 09:28 AM
একসময় যেখানে ছিল ধু ধু বালুচর, সেখানেই এখন সবুজের সমারোহ। বন্যার গ্রাসে পদ্মায় বিলীন হয়ে যাওয়া জমি আবার জেগে ভরে উঠেছে ফল আর ফসলে।
নাটোরের লালপুর উপজেলায় জেগে ওঠা পদ্মার ১৮টি চরে এখন কেবল দেশি-বিদেশি নানা ফল ও শাকসবজিই চাষ হচ্ছে না; পালন করা হচ্ছে হাঁস-মুরগী, গরু-ছাগল, ভেড়া ও মহিষ।
চর ঘুরে দেখা গেল, বিস্তীর্ণ জমিতে ধান-পাটের পাশাপাশি চাষ হচ্ছে ভুট্টা, আখ, কুমড়া, কলা ও বাদাম। রয়েছে আম-পেয়ারার বাগানও। আধুনিক পদ্ধতির কৃষি, বিদ্যুৎ সংযোগ আর ইন্টারনেট বদলে দিয়েছে চরের পুরনো চেহারা।
বিলমাড়িয়া ইউনিয়নের আরাজী বাকনা চরের মেঠোপথ ধরে এগোতেই দেখা মেলে কুদ্দুস মোল্লার।
তপ্ত রোদে ছাতা মাথায় ভেড়ার পালের তদারকি করছিলেন তিনি। জানালেন, তার পালে ৭০টি ভেড়া রয়েছে। কৃষিকাজের পাশাপাশি ভেড়া পালেন তিনি। প্রতি বছর তার পালে ৫০টি করে ভেড়া বাড়ে।ভেড়া পালন আর কৃষিকাজ করে আর্থিকভাবে সাবলম্বী হয়ে উঠেছেন।
পাশেই কামরুল ইসলামের মিষ্টি কুমড়ার ক্ষেতে কাজ করছিলেন উজির হোসেন। দিনপ্রতি ৪০০ টাকা আয় তার। তিনি জানালেন, কুমড়া চাষে বিঘা প্রতি ১০-১২ হাজার টাকা খরচ। তবে বিক্রি হয় লাখ টাকার।
চরে তিন একর জমিতে কয়েক জাতের পেয়ারার চাষ করেন হাবিবুর রহমান। ২০১৭ সালে পেয়ারার চাষ শুরু করে এখন তার বাগানে গাছের সংখ্যা প্রায় তিন হাজার। প্রতি বিঘায় ৫০ হাজার টাকা খরচ করে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকার পেয়ারা বিক্রি করেন বলে জানান তিনি।
আরাজী বাকনা থেকে চর জাজিরার পথে মহিষ চরাচ্ছিলেন স্থানীয় কৃষক শাহীন। কথা বলতেই জানা গেল, মহিষ পালনই তার মূল পেশা হয়। পাশাপাশি ১০ বিঘা জমিতে ফসলের চাষ করেন। সকালে সাতটি মহিষ নিয়ে বের হয়েছেন, বাড়িতে রয়েছে আরও কয়েকটি।
কথা হয় চরের নহির বিশ্বাস, শিমুল আলীসহ বেশ কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে। তারা জানান, বাতানবাড়ি, ডাকসার বাতানবাড়ি, আড়াজি বাকনা, গবিন্দপুর, বন্দবস্থ গবিন্দপুরসহ লালপুরের পদ্মায় মোট চরের সংখ্যা ১৮টি।
প্রতিটি চরেই এখন বিপুল পরিমাণ ফসল উৎপাদন হচ্ছে, গবাদিপশু লালন-পালন করা হচ্ছে।
লালপুর মাজার শরিফ টিবিএম কলেজের অধ্যক্ষ ইমাম হাসান মুক্তি জানান, ১৯৭১-১৯৭৭ সাল পর্যন্ত প্রবল ভাঙনে ৫-৬ কিলোমিটার উত্তরে সরে গিয়েছিল পদ্মা। বন্যায় বিলীন হয়েছিল স্থানীয় হাজারও মানুষের বসতবাড়ী। তবে এরপর বদলাতে শুরু করে গতিপথ। ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত বিলমাড়িয়া, লালপুর ও সাঁড়ার কোল ঘেঁষে প্রবাহিত হয়ে বর্তমান অবস্থায় ফিরে আসে পদ্মা।
বর্তমানে লালপুর উপজেলার ১২ কিলোমিটার জুড়ে দুড়দুড়িয়া, বিলমাড়িয়া, লালপুর, ঈশ্বরদী ও সাঁড়া ইউনিয়নের দক্ষিণ দিক দিয়ে পদ্মা প্রবাহিত হচ্ছে। লালপুর সীমানায় জেগে উঠেছে নীমতলী, লালপুর, দিয়ার শংকরপুর, নওসারা সুলতানপুর, আরাজি বকনাই, সেকেন্দারপুর, চাকলা বিনোদপুর, রসুলপুর, মোহরকয়া চর।
ফসলের পাশাপাশি গবাদি পশু পালনেও এসব চরের বাসিন্দাদের এগিয়ে থাকার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে স্থানীয় কৃষক সাইদুল ইসলাম বলেন, “ঘাসের জন্য আমাদের চিন্তা করতে হয় না। চরে প্রচুর ঘাস হয়। অন্যান্য খাবারের সঙ্গে তাজা ঘাস পেলে গরু দ্রুত বড় হয়।”
কৃষিকাজের পাশাপাশি তিনটি গরু দিয়ে খামার শুরু করলেও এখন তার খামারে গরুর সংখ্যা আটটি বলে জানালেন তিনি।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. গোলাম মোস্তফা জানান, লালপুরে প্রায় পাঁচ হাজার মহিষ আছে। যার সিংহভাগেরই বাথান এসব চরে। পুষ্টি চাহিদা পূরণের পাশাপাশি স্থানীয় অর্থনীতিকেও শক্তিশালী করছে চরাঞ্চলের এসব গবাদিপশু।
চরে উৎপাদিত ফল-ফসল, গবাদিপশু বিক্রির পাশাপাশি স্থানীয়দের চাহিদাও পুরোপুরি মেটাচ্ছে।
সানোয়ারা খাতুন নামে এক গৃহিনী জানালেন, এখন আর শাকসবজি কিনতে বাজারে যান না তারা। নিজেদের বা প্রতিবেশীর ক্ষেত থেকেই এর জোগান আসে।
১৯৭৪ সালের বন্যার স্মৃতিচারণ করে স্থানীয় জোসনা বেগম বললেন, সেসময় চরের মানুষকে লালপুর সদরে গিয়ে আশ্রয় নিতে হয়েছিল। ১৯৯৪-৯৫ সাল থেকে ধীরে ধীরে আবার সবাই ফিরতে শুরু করেন। এখন তো পুরোদমে কৃষিকাজ শুরু হয়েছে। পরিস্থিতি একেবারেই বদলে গেছে।
নাটোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, “স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে চরে উৎপাদিত ফল-ফসল দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে যাচ্ছে। পুষ্টির চাহিদা পূরণের পাশাপাশি চরে তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন কর্মসংস্থান। যা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।”
পদ্মা চরের কৃষক ও কৃষির উন্নয়নে কৃষি বিভাগ নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছে বলেও জানান তিনি।
তবে এত কিছুর পরেও কিছু সমস্যার কথা বলছেন চরের বাসিন্দারা। যেমন যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনো কাঙ্ক্ষিত পরিমাণে উন্নত হয়নি। বাহন বলতে কেবল বাইসাইকেল, মোটরসাইকেল, ট্রলি আর আদম গাড়ি।
আবার চরে জমি সংক্রান্ত জটিলতাও আছে। সব এলাকায় এখনো বিদ্যুৎ পৌঁছেনি, ফলে সেচের ক্ষেত্রে বেশ সমস্যার মুখে পড়তে হয় বলে জানালেন চাষী নাহিদ।
উন্নত সড়ক আর সেতু, এ দুটি এখন ভীষণ প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে বলে মত দিলেন নাজমুল, সাইফুল হক, এজাজুলসহ আরও কয়েকজন।
তারা মনে করেন, যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হলে দেশের অর্থনীতিতে আরও ব্যাপক পরিসরে অবদান রাখতে পারবেন চরের মানুষ।