কুমিল্লায় জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠানেও শহীদ পরিবারের সদস্যরা উপেক্ষিত থাকেন বলে অভিযোগ স্বজনদের।
Published : 31 Mar 2024, 09:34 AM
স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ উপজেলার এক শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধার পরিবার যথাযথ সম্মান না পাওয়ার অভিযোগ তুলেছেন।
উপজেলার বাইশগাঁও ইউনিয়নের ফুলপুকুরিয়া গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ শামছুল হকের পরিবারের দাবি, মুক্তিযুদ্ধে জীবন উৎসর্গ করা এ শহীদের পরিবারের সদস্যরা পান না ন্যূনতম সম্মান। কেউই খোঁজও নেয় না তাদের। এমনকি জাতীয় দিসবগুলোতেও শহীদ শাসছুল হকের পরিবারের সদস্যরা থাকেন উপেক্ষিত।
শহীদ শামছুল হকের ‘ওয়ারিশ’ (স্ত্রী-সন্তান) না থাকায় পরিবারের অন্য কাউকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি বলে জানিয়েছেন মনোহরগঞ্জ উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল আজিজ।
শামছুল হকের স্বজনদের অভিযোগ, সবশেষ ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবসে মনোহরগঞ্জ উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে শহীদ মুক্তিযোদ্ধার পরিবার, যুদ্ধাহত ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সংবর্ধনা দেওয়া হলেও শহীদ শামছুল হকের পরিবারের কাউকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। এ ঘটনায় ওই শহীদ পরিবারের স্বজন ও এলাকাবাসীর মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।
শামছুল হক ওরফে সামছুল হুদা উপজেলার ফুলপুকুরিয়া গ্রামের মীর বাড়ির প্রয়াত বন্দে আলী মীরের সন্তান। চার ভাই-বোনের মধ্যে শামছুল হক ছিলেন সবার বড়। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন তিনি। সে সময় দেশের হয়ে তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় মনোহরগঞ্জ উপজেলা; এর আগে এটি লাকসাম উপজেলার অন্তর্গত ছিল।
লাকসাম উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা সফিকুর রহমান বলেন, “শামছুল হক ভাই ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। দেশের জন্য যুদ্ধ করে শহীদ হয়েছেন তিনি। তার মরদেহ কসবায় গণকবরে দাফন করা হয়।”
তিনি বলেন, দেশকে স্বাধীন করার জন্য শামছুল হক নিজের জীবনকে উৎসর্গ করার বিষয়টি নতুন প্রজন্মকে জানানো উচিত। এক্ষেত্রে স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন ও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ভূমিকা জরুরি। তবে স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও শহীদ পরিবারটি অবহেলায় থাকা দুঃখজনক।
শহীদ শামছুল হকের ছোট বোন সৈয়দা সায়েরা খাতুন বলেন, “আমার ভাই দেশের জন্য জীবন দিয়েছেন। স্বাধীনতার সময় ভাই ছিলেন পরিপূর্ণ যুবক। ওই সময় তিনি ছিলেন আমাদের পরিবারের প্রধান অবলম্বন। ভাইয়ের আয়ে আমাদের সংসার চলত। ভাই শহীদ হওয়ার পর আমার বাবার পরিবারের অনেক কষ্টে দিন কেটেছে। আমার ভাইয়ের কোনো সন্তান নেই। পরে তার স্ত্রীর অন্যত্র বিয়ে হয়ে গেছে।”
ক্ষোভ প্রকাশ করে সায়েরা খাতুন বলেন, “দেশ স্বাধীন হওয়ার ৫৩ বছর হতে চলল কিন্তু আজও আমরা ন্যূনতম সম্মানটুকু পাই না। এটা আমাদেরকে অনেক কষ্ট দেয়। যাদের জীবনের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে, তাদের পরিবারের সদস্যদের খোঁজ কেউ রাখে না। তাহলে আমার ভাই কাদের জন্য জীবন দিল?”
শহীদ শামছুল হকের ছোট ভাই আলী আকবর মীর বলেন, “২০২১ সালে আমাদের বাড়ির সামনে ভাইয়ের স্মৃতি হিসেবে একটি কবর নির্মাণ করেছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। ঠিকাদার সেটি নির্মাণ করে চলে গেছেন। কিন্তু উপজেলা প্রশাসন ও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কাউকে আজ পর্যন্ত দেখিনি।”
শহীদ শামছুল হকের ভাতিজা আবদুর রহমান বলেন, “আমি শহীদ পরিবারের সন্তান; এই পরিচয়ে আমি গর্ববোধ করি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য আজ পর্যন্ত উপজেলা প্রশাসন ও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কেউ শহীদ পরিবার হিসেবে আমাদের খোঁজ নেয়নি। এমনকি স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসের মত গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলোতে আমাদের পরিবারের কারো খোঁজ নেওয়া হয় না।
“সবশেষ ২৬ মার্চ শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে সংবর্ধনা দিয়েছে উপজেলা প্রশাসন; কিন্তু আমরা আমন্ত্রণ পাইনি। তাহলে কাকে সংবর্ধনা দেওয়া হল? আমার জানা মতে, পুরো উপজেলায় মাত্র চারটি শহীদ পরিবার রয়েছে; এরপরও আমরা উপেক্ষিত।”
তিনি বলেন, “শুধু এ বছর নয়, প্রতি বছরই এমন ঘটনা ঘটে। আমাদের খোঁজ কেউ রাখে না। যার কারণে দেশের জন্য শহীদ শাসছুল হকের ত্যাগের কথাও নতুন প্রজন্ম জানে না।”
জানতে চাইলে মনোহরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) উজালা রানী চাকমা বলেন, “এ উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবার ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আমন্ত্রণ জানানোর বিষয়টি উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আবদুল আজিজ সাহেব দেখেন। দাওয়াতে কোনো সমস্যা হয়েছে কি-না, বিষয়টি আমি তার সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হতে পারব।
“এ ছাড়া শহীদ মুক্তিযোদ্ধা শামসুল হকের পরিবারের লোকজন আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে বিষয়টি নিশ্চিত হতে পারব।”
মনোহরগঞ্জ উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল আজিজ বলেন, শহীদ শামসুল হকের কোনো ওয়ারিশ (স্ত্রী-সন্তান) আছে কিনা বিষয়টি আমি নিশ্চিত নই। যদি কোনো ওয়ারিশ থাকে তারা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। এতে করে পরবর্তী সব আয়োজনে তাদেরকে আমন্ত্রণ জানাব।”