‘দুর্বল’ বেড়িবাঁধ নিয়ে দুর্ভোগে কয়রাবাসী

বাঁধ ভেঙে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন উপজেলার অন্তত ১৫ হাজার মানুষ।

শুভ্র শচীনখুলনা প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 August 2022, 07:03 AM
Updated : 16 August 2022, 07:03 AM

খুলনার কয়রা উপজেলার কপোতাক্ষ নদের বাঁধ রক্ষায় সরকারিভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। স্থানীয়রা নিজ উদ্যোগে বাঁধ রক্ষার চেষ্টা করেও টিকিয়ে রাখতে পারছেন না। ফলে দুর্যোগকবলিত সুন্দরবন উপকূলীয় জনপদ কয়রার মানুষের জীবন চলছে ভাঙা-গড়ার মধ্যে।

সোমবার ভোর থেকে উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের চরামুখা গ্রামের খালেরগোড়া এলাকার কপোতাক্ষ নদের ভাঙা বেড়িবাঁধ স্বেচ্ছাশ্রমে মেরামত করেছিলেন এলাকার কয়েক হাজার মানুষ।

বাড়ি ফিরে দুপুরে তারা জানতে পারেন, জোয়ারে বাঁধের আরেক পাশ ভেঙে গেছে; প্লাবিত হয়েছে বিস্তীর্ণ এলাকা।

এতে ইউনিয়নের চারটি ওয়ার্ডের অন্তত দশ গ্রামে সাগরের নোনাপানি প্রবেশ করেছে। গ্রামের যাতায়াতের পথ বিচ্ছিন্ন হয়ে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন অন্তত ১৫ হাজার মানুষ।

তবে মঙ্গলবার ভোর থেকে স্থানীয়রা আবারও বাঁধটি মেরামতের কাজে নেমেছেন বলে দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আবদুস সালাম খান জানিয়েছেন।

কয়রা উপজেলা চেয়ারম্যান এস এম শফিকুল ইসলাম বলেন, “উপকূলীয় জেলা খুলনা দেশের অন্যতম প্রধান জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা অঞ্চল। এ জেলার একেবারে দক্ষিণে অবস্থিত কয়রা উপজেলাটিকে ঘিরে রেখেছে কপোতাক্ষ, কয়রা এবং শাকবাড়িয়া নদী। আর উপজেলার ৬টি ইউনিয়নই সুন্দরবনের সীমানায় অবস্থিত।

“ফলে স্বভাবিকভাবেই উপজেলাটি প্রায়ই প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে। বৈরি আবহাওয়ায় নদীতে জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পেলে বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয় বিস্তীর্ণ এলাকা।”

শফিকুল জানান, ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলা দেশের উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানার পর গ্রামের পর গ্রাম জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যায় এবং অনেক পরিবার খোলা আকাশের নিচে জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়। সেবারও বাঁধ ভেঙে পড়ে এবং সেটি মেরামতের জন্য কর্তৃপক্ষ সময় নেয় দুই বছর। এই পুরো সময়ে বসবাসের জায়গাগুলো পানির নিচে ডুবে ছিল।

২০১১ সালে বাঁধ মেরামত করা হলে ক্ষতিগ্রস্তরা তাদের বাড়ির যতটুকু অবশিষ্ট ছিল, সেখানে ফিরে যান এবং আবারো শূন্য থেকে জীবন শুরু করেন। একটু দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই আঘাত হানে ইয়াস। গত ১০ বছরে তারা যতটুকু গড়েছিলেন ইয়াসে তার সবই আবার তলিয়ে যায়। এভাবেই চলছে কয়রাবাসীর ভাঙা-গড়ার দুর্বিসহ জীবন।

এদিকে বারবার একইস্থানে বাঁধ ভাঙার পেছনে পানি উন্নয়ন বোর্ডের গাফিলতিকে দুষছেন স্থানীয় লোকজন। তাদের অভিযোগ, এক মাস আগে রিংবাঁধ দেওয়া হলেও সেটি রক্ষণাবেক্ষণ বা মজবুত করার কোনো ব্যবস্থা নেননি তারা। ফলে দুর্বল বাঁধ বারবার ভেঙে যাচ্ছে।

দক্ষিণ বেদকাশি ইউপি চেয়ারম্যান সালাম বলেন, “গত ১৭ জুলাই ভোরে কপোতাক্ষ নদের ওই বাঁধের প্রায় ১৫০ মিটারের মতো ধসে নদীতে বিলীন হয়। দুদিন পর স্থানীয় হাজারো মানুষের প্রচেষ্টায় ভাঙা স্থানে রিং বাঁধ দিয়ে পানি আটকানো হয়। কিন্তু শনিবার দুপুরের জোয়ারে ওই রিং বাঁধটির ৫০ ফুটের মতো ভেঙে যায়।

“পরে তাৎক্ষণিকভাবে স্থানীয় কয়েক’শ মানুষের প্রচেষ্টায় তা মেরামত করা হলেও নদীর পানিতে তলিয়ে যায় শতাধিক মাছের ঘের। আশপাশের সবার বাড়িতেই কমবেশি পানি উঠে। রোববার আবারও সেই বাঁধের ১০০ মিটার ভেঙে যায়।”

সোমবার ভোর থেকে হাজারো মানুষ জড়ো হয়ে ওই ভেঙে যাওয়া বাঁধ স্বেচ্ছাশ্রমে মেরামত করেন। কিন্তু ওই কাজ শেষ হতে দুপুরেই জোয়ারে বাঁধের আরেক পাশ ভেঙে যায় বলে জানান তিনি।

“দুর্যোগকবলিত সুন্দরবন উপকূলীয় জনপদ কয়রার মানুষ ভাঙা-গড়ার মধ্যেই দিনাতিপাত করছেন। একটির ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই, আসে নতুন দুর্যোগ।” বলেন তিনি।

দক্ষিণ বেদকাশী উপজেলার সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ইউনিয়ন উল্লেখ করে এ জনপ্রতিনিধি বলেন, “প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণেই এলাকায় অভাব-অনটনে বিপর্যস্ত জীবন কাটাতে হচ্ছে তাদের। জীবিকার খোঁজে এলাকা ছেড়ে শহর ও নিকটবর্তী জেলামুখী হচ্ছে মানুষ।”

কয়রার দক্ষিণ বেদকাশী এলাকার স্বাধীন সমাজকল্যাণ যুব সংস্থার সভাপতি মো. আবু সাঈদ খান বলেন, “শনিবার ভোর থেকে গত তিনদিন গ্রামের বেশিরভাগ নারী-পুরুষ বাঁধ মেরামতের কাজে ব্যস্ত থাকায় ঘরের জিনিসপত্র রক্ষা করতে পারেন নি। আশপাশের সবার বাড়িতেই কমবেশি পানি উঠেছে। সবই আবার নোনাপানিতে তলিয়ে গেছে।

“সরকারিভাবে এখনও বাঁধ রক্ষায় ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ভাটার সময় পানি কমছে আবার জোয়ারে পানি বাড়ছে। বেঁচে থাকার তাগিদে গ্রামবাসীর উদ্যোগে বাঁধ রক্ষায় কাজ করেও বাঁধ টিকিয়ে রাখা যাচ্ছে না।”

সাঈদ আরও বলেন, “বাঁধ না ভাঙলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ঘুম ভাঙে না। বাঁধ ভেঙে যাওয়ার পর প্রতিষ্ঠানটির তোড়জোড় শুরু হয়। কিন্তু ততক্ষণে নিঃস্ব হয় সাধারণ মানুষ।

Also Read: কপোতাক্ষ নদের বেড়িবাঁধ ভেঙে খুলনায় ‘১০ গ্রাম’ প্লাবিত

দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ওসমান গণি জানান, বাঁধ ভেঙে পানি ঢুকে দক্ষিণ বেদকাশী, চরামুখা, হলুদবুনিয়া, বিনাপানি, পদ্মপুকুরসহ ১০টির বেশি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। প্রায় ১৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। এতে আমনের বীজতলাসহ চিংড়ি ঘেরের ক্ষতি হয়েছে।

এ বিষয়ে কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অনিমেষ বিশ্বাস বলেন, “স্বাভাবিক জোয়ারের তুলনায় নদীর পানি ৪ থেকে ৫ ফুট বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে দক্ষিণ বেদকাশীতে ভেঙে যাওয়া বাঁধটি মেরামত করা হচ্ছিল, তা আবার ভেঙে গেছে।

“উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করা হচ্ছে। আগামী ভাটার সময় আবারও পানি উন্নয়ন বোর্ড ও স্থানীয় জনগণের সহযোগিতায় ক্ষতিগ্রস্থ বাঁধ মেরামতের চেষ্টা করা হবে।”

তাছাড়া পানিবন্দিদের জন্য ত্রাণের ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

ওই এলাকা পড়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাতক্ষীরা বিভাগ-২এর আওতায়। বিভাগের পরিচলন ও রক্ষণাবেক্ষণের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শাহনেওয়াজ তালুকদার বলেন, “প্রথম বাঁধ ভেঙে যাওয়ার পর রিং বাঁধ দেওয়া হয়। কিন্তু সেটি মজবুত করা যায়নি। সেখানে মাটির মান খুব বেশি ভালো নয়।

“তাছাড়া জোয়ার-ভাটার কারণে বেশি সময় কাজ করা যায় না। এ কারণেই মূলত বাঁধটি বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

তিনি বলেন, “আপাতত পানি প্রবেশ বন্ধে করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এরপর রিংবাঁধ মজবুতের চেষ্টা করা হবে।”