জলবায়ুর পরিবর্তন, মাটির উর্বরতা হ্রাস, একই জমিতে পুনঃপুন চাষ এবং ফসলের উন্নত জাত ব্যবহার না করাকে এই বিপর্যয়ের জন্য দায়ী করেছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও জুমিয়ারা।
Published : 08 Oct 2023, 08:50 AM
এমনিতেই পাহাড়ে সনাতন পদ্ধতিতে জুম চাষের ওপর নির্ভরশীল পরিবারের সংখ্যা কমছে; তার মধ্যে এ বছর ফসল বিপর্যয়ের কারণে বিপাকে পড়েছেন খাগড়াছড়ির বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠীর জুম চাষিরা। তারা সারাবছরের ‘খোরাকি’ নিয়ে দুঃশ্চিন্তার মধ্যে আছেন।
জলবায়ুর পরিবর্তন, মাটির উর্বরতা হ্রাস, একই জমিতে পুনঃপুন চাষ এবং ফসলের উন্নত জাত ব্যবহার না করাকে এই বিপর্যয়ের জন্য দায়ী করেছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও জুমিয়ারা।
সবশেষ আদমশুমারি অনুযায়ী, ২০০ বছরের পুরনো জুম চাষ পদ্ধতির ওপর খাগড়াছড়ি জেলার নৃগোষ্ঠীর প্রায় পাঁচ হাজার পরিবার নির্ভরশীল। জুমের ফসল দিয়েই তারা দৈনিন্দিন জীবন-যাপনের ব্যয় বহন করে থাকেন। যদিও এ জেলায় চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাসহ প্রায় ৩ লাখ ২০ হাজার নৃগোষ্ঠীর মানুষের জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি মৌসুমে প্রায় ১ হাজার ৫৯ হেক্টর জমিতে জুম চাষ হয়েছে। এটি গত মৌসুমের তুলনায় প্রায় ৭০০ হেক্টর কম এবং তার আগের বছরের অর্থাৎ ২০২১-২২ অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ৯০০ হেক্টর কম।
জুম চাষে ধানের পাশাপাশি হলুদ, মারফা, আদা, মরিচ, কচু, মিষ্টি কুমড়ো, তিল, ভুট্টা, বরবটিসহ ৩৭ থেকে ৪০ জাতের ফসল গোলায় তোলেন চাষিরা। তারা বলছেন, এ বছর জুমে বীজ রোপণের সময় বৃষ্টি হয়নি। কিন্তু অসময়ে বৃষ্টি হওয়ায় ফসলের বিশেষ করে ধানের ক্ষতি হয়েছে বেশি।
দীঘিনালা উপজেলার আট মাইল এলাকায় চার একর পাহাড়ি টিলা ভূমিতে জুম চাষ করেছেন কৃষক ললিত ত্রিপুরা। তিনি বলছিলেন, “এবার ধানের উৎপাদন কম। জুমে চারা রোপণের সময় ঠিকমত বৃষ্টি হয়নি। পরে অসময়ে বৃষ্টিপাত বেশি হয়েছে। ধান পাকার পর অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতে অনেক ধান নষ্ট হয়ে গেছে।
“গত বছরের তুলনায় এবার অনেক কম ধান পেয়েছি। ধান ছাড়াও মারফা, মিষ্টি কুমড়া, তিলসহ অন্যান্য ফসলের উৎপাদনও কমেছে।”
খাগড়াছড়ি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কিশোর কুমার মজুমদার বলেন, “আগে এক পাহাড়ে জুম চাষ করার পর সেটি ১২ থেকে ১৫ বছর খালি রাখা হত। এতে মাটির উর্বরা শক্তি বাড়ত। আর এখন তিন-চার বছর পর পর একই পাহাড়ের পাদদেশে বা টিলাতে চাষ করা হচ্ছে। কোথাও কোথাও প্রতিবছর বা এক-দুবছর পর পরই চাষ হচ্ছে। এই অল্প সময়ের ব্যবধান জুম চাষের মাটির পুষ্টি উদ্ধারের জন্য যথেষ্ট নয়।
“পাহাড়ি ভূমি অতি ঘন ঘন কর্ষণের কারণে ক্ষয়ের পরিমাণ বেড়ে গেছে। এ প্রভাব পড়ছে ফসলের উৎপাদনে। প্রতি বছর ফসল কমছে।”
তিনি জুম চাষিদের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের গবেষণায় উদ্ভাবিত উন্নতমানের উচ্চফলনশীল বীজ ব্যবহারের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
সরজমিনে জুম চাষ এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, অনেক পাহাড়ের চূড়ায় পাকা ধানে হলুদ রঙ ধারণ করেছে। কোথাও কোথাও ধান কাটা শুরু হয়ে গেছে। ফসলও উঠছে স্থানীয় বাজারগুলোতে। তবে ফলন কম হওয়ায় হতাশ চাষিরা।
জুমের উৎপাদিত ফসল তুলনামূলকভাবে সতেজ ও নিরাপদ হওয়ায় বাজারে এই চাহিদাও রয়েছে। কিন্তু ক্রেতারা বলছেন, এবার জুমের ফসলের দাম গতবারের তুলনায় বেশি।
চাষিরা জানালেন, বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে জুমের মাটিতে একসঙ্গে নানা ফসলের বীজ বপন করা হয়। তিন-চার মাস ধরে এই ফসলের পরিচর্চা করা হয়। জুমের ফসল যেন হাতি বা অন্য কোনো প্রাণি নষ্ট করতে না পারে এজন্য জুম ক্ষেতের মধ্যে টঙ ঘর করে পাহারা দেন জুমিয়ারা। ভাদ্র-আশ্বিন মাস থেকেই জুমের ফসল কাটা শুরু হয়ে যায়। এখান থেকে পাওয়া ধান দিয়েই সারা বছর চলে নৃগোষ্ঠীর অনেক পরিবার।
দীঘিনালা উপজেলার নয় মাইল এলাকার বাসিন্দা হতেন ত্রিপুরা (৩৫)। তিনি এক দশকের বেশি সময় ধরে জুম চাষ করছেন।
তিনি বলছিলেন, “আগে এক পাহাড়ে জুম চাষ করার পর ১০ থেকে ১৫ বছর পর আবার আবাদ করা হত। তবে এখন মানুষের চাপ বাড়ার কারণে সেগুলোতে বিরতিহীনভাবে জুম চাষাবাদ হচ্ছে। প্রতিবছর চাষাবাদ হওয়ায় পাহাড়ের মাটির ক্ষয় বাড়ছে। এতে কমছে জুম ভূমির উর্বরতা।”
হতেন ত্রিপুরা জানালেন, এবার ধানসহ তার সব ফসলই কম হয়েছে। সারা বছরের খোরাকি নিয়ে তিনি দুঃশ্চিন্তায় রয়েছেন।
একই এলাকার কৃষক সোনাবাবু ত্রিপুরা বলেন, “আমি এ বছর স্থানীয় গ্যালুন জাতের ধান লাগিয়েছি। কিন্তু ফলন গত মৌসুমের চেয়ে এবার কম। দেরিতে বৃষ্টিপাত হওয়ার কারণে ধানের ফলন কম। ধান কিছু পাকছে কিছু পাকেনি।
“এবার আমাদের অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। কৃষি বিভাগের কাছে আমরা সহযোগিতা চাই কিন্তু কখনোই সহযোগিতা পাই না।”
খাগড়াছড়ির সীমানাপাড়া এলাকায় নিজের পাঁচ একর পাহাড়ি জমিতে টানা চাষাবাদ করে আসছেন নবীন ত্রিপুরা। তিনি বলেন, “চলতি মৌসুমে চার একরে জুমে ভুট্টা, ধান, মারফা ও পানের চাষ করেছি। যা উৎপাদন হয়েছে তা দিয়ে সংসার চলে না। জুমে ফসল রোপণের মৌসুমে বৃষ্টি কম হওয়ায় ফলন কম হয়েছে। আবার ধান মাড়াইয়ের সময়ে বেশি বৃষ্টি হওয়ায় অনেক ধান নষ্ট হয়ে গেছে।”
জুমের ফলন কম হওয়ার প্রভাব পড়েছে পাহাড়ি হাটগুলোতে। জুমে উৎপাদিত সবজি গত বছরের তুলনায় স্থানীয়দের কিছু চড়া দামের কিনতে হচ্ছে।
প্রবীর সুমন নামে এক ক্রেতা বলেন, “গত মৌসুমে এই সময়ে মারফা কিনেছিলাম ৩০ টাকায়। এ বছর হাটে জুমে উৎপাদিত ফসল কম দেখা যাচ্ছে। এ বছর প্রতি কেজি মারফা কিনতে হচ্ছে ৭০ টাকায়। মিষ্টি কুমড়াসহ জুমে উৎপাদিত অন্যান্য ফসলের দামও বেশি।”
জুমের ফলন বাড়াতে গবেষণা করছে পাহাড়ি কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট। তাদের উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল জাতের বীজ রোপণের পরার্মশ দিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা মো. আব্দুল্লাহ আল মালেক।
তিনি বলেন, “জুমে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে উদ্ভাবিত বিভিন্ন সবজির বীজ যদি রোপণ করি তাহলে জুমের উৎপাদন বাড়বে। সনাতন পদ্ধতিতে চাষাবাদ না করে আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করলে জুমের ফলন বাড়বে।”