বিষয়খালীর যুদ্ধে শহীদদের বেগবতী নদীর পাড়সহ কয়েকটি গণকবরে সমাহিত করা হয়। এখানে জেলা পরিষদ নির্মিত ভাস্কর্যে ২৮ শহীদের নাম রয়েছে।
Published : 07 Dec 2022, 08:49 AM
১৯৭১ সালের ১৪ এপ্রিল ঝিনাইদহ সদরের বিষয়খালীতে একটি সম্মুখযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হঠলে পাকসেনারা শহরে ঢুকে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল।
ওই যুদ্ধে সেদিন মুক্তিযোদ্ধা ও নারীসহ অনেকে শহীদ হন। বেগবতী নদীর পাড়সহ কয়েকটি গণকবরে তাদের সমাহিত করা হয়। বিষয়খালীতে জেলা পরিষদ নির্মিত ভাস্কর্যে ২৮ জন শহীদের নাম রয়েছে।
ঝিনাইদহ জেলা শহর থেকে আট কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত বিষয়খালী সেতু। এই সেতুতে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের বাধা দিলে সম্মুখযুদ্ধ হয়।
এর দুই সপ্তাহ আগে ৩০ মার্চ কুষ্টিয়ায় পাকিস্তানি সেনাদের দুটি অবস্থানে হামলা চালিয়ে দখল করে নেন মুক্তিযোদ্ধারা। সেখান থেকে তারা একটি বিদ্যালয়ে অবস্থান নেয়। পরে সেই বিদ্যালয়ে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করলে তারা পালাতে থাকে।
পালানোর পথে ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার গাড়াগঞ্জে তারা অ্যাম্বুশের শিকার হয় এবং মুক্তিযোদ্ধা ও এলাকাবাসীর হাতে সবাই নিহত হয়।
ঝিনাইদহের গাড়াগঞ্জ ও বিষয়খালীতে দুই সপ্তাহের ব্যবধানে দুটি ভয়াবহ সম্মখযুদ্ধ হয়।
ওই দুটি যুদ্ধ সম্পর্কে চুয়াডাঙ্গার ডা. আসাবুল হক, শৈলকুপা উপজেলার বেড়বাড়ি গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আনসার কমান্ডার গোলাম মোস্তফা, ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য জে কে এম এ অজিজ এবং শৈলকুপার বীর মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলি মন্টু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে কথা বলেন। এদের মধ্যে আসাবুল হক ও জে কে এম এ অজিজ এখন প্রয়াত।
স্মৃতিচারণে তারা বলেন, ২৫ মার্চ গভীর রাতে যশোর সেনানিবাস থেকে পাক সেনাদের একটি কনভয় ঝিনাইদহের উপর দিয়ে কুষ্টিয়া যায়। তারা কুষ্টিয়া মোহিনী মিল, জিলা স্কুল ও পুলিশ লাইনসে ঘাঁটি গাড়ে।
চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ ও রাজবাড়ি জেলার ছাত্র-জনতা, আনসার, পুলিশ, ইপিআর ও প্রাক্তন সৈনিকদের সংগঠিত করে কুষ্টিয়ার পাকিস্তানি সেনাঘাঁটিগুলো আক্রমণের পরিকল্পনা করা হয়। চুয়াডাঙ্গায় দক্ষিণ পশ্চিম রণাঙ্গনের সদরদপ্তর স্থাপন করা হয়।
চুয়াডাঙ্গার ডা. আসাবুল হক মৃত্যুর কয়েক বছর আগে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফেঅর ডটকমকে বলেছিলেন, চুয়াডাঙ্গায় ইপিআরের উইং হেডকোয়ার্টার্স ছিল। কমান্ডিং অফিসার ছিলেন মেজর আবু উসমান চৌধুরী। তিনি তার বাহিনীর বাঙালি সৈনিক ও অফিসারদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। এতে মুক্তিযুদ্ধ আরও গতি পায়।
“২৯ মার্চ কুষ্টিয়ার পাকসেনা ঘাঁটিগুলো আক্রমণের সিদ্ধান্ত হয়। পরে একদিন পিছিয়ে ৩০ মার্চ করা হয়। ওইদিন ভোরে তিন দিক থেকে পাকসেনা ঘাঁটিগুলো আক্রমণ শুরু হয়।”
আসাবুল হক জানান, প্রথমে মোহিনী মিলের ঘাঁটি আক্রমণ করে দখল করেন মুক্তিযোদ্ধারা। পাকসেনারা পালিয়ে জিলা স্কুলে এসে জড়ো হয়। দুপুর নাগাদ পুলিশ লাইনস পাকসেনা ঘাঁটিরও পতন হয়। তখন কুষ্টিয়ার সব পাকসেনা জিলা স্কুলে অবস্থান নেয়।
মুক্তিযোদ্ধারা কুষ্টিয়া জিলা স্কুল আক্রমণের আগে পরিকল্পনা করে গাড়াগঞ্জে ফাঁদ পাতেন, যাতে পাকিস্তানি সেনারা পালানোর সময় আটকা পড়ে।
আসাবুল হক জানান, পাকসেনারা কুষ্টিয়া যাওয়ার পর গাড়াগঞ্জে কুমার নদের সেতুর দক্ষিণ পাশে গভীর খাদ কেটে তার উপর বাঁশের চাটাই বিছিয়ে আলকাতরার প্রলেপ দিয়ে নকল রাস্তা তৈরি করা হয়।
৩০ মার্চ রাতে কুষ্টিয়া জিলা স্কুলে পাকসেনাদের উপর আক্রমণ শুরু হয়। তখন তারা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে যশোর সেনানিবাসের দিকে পালাতে থাকে। রাত ৯টার দিকে গাড়াগঞ্জে পাতা ফাঁদে এসে পড়ে। প্রথম গাড়ি খাদে পড়ার পর অন্য গাড়িগুলো সেতুর উপর দাঁড়িয়ে যায়।
সেতুর পাশে বাংকারে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধারা চারদিক থেকে গুলিবর্ষণ করতে থাকেন। পাকবাহিনী দুটি মর্টারের গোলা ছুড়ে স্তব্ধ হয়ে যায়। চারিদিক থেকে হাজার হাজার মানুষ গগণবিদারি জয়বাংলা শ্লোগান দিতে থাকে। পাকসেনা দল পাশের গ্রামে ঢুকে বনজঙ্গলে আত্মগোপন করে। পরদিন ভোর হওয়ার পর হাজারো মানুষ দা, কুড়াল,বল্লম দিয়ে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে তাদের। দুপুরের মধ্যে পাকবাহিনীর পুরো দলটি ধ্বংস হয়; ৭০ থেকে ৮০ জন পাকসেনা নিহত হয়। তাদের অস্ত্র ও গাড়ি মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে।
এ ঘটনার পর ঝিনাইদহ-যশোর সড়কে বিষয়খালিতে বেগবতী নদীর উপর সেতুতে প্রতিরক্ষা গড়ে তোলে মুক্তিফৌজ, যাতে যশোর সেনানিবাস থেকে পাকবাহিনী আসতে না পারে।
শৈলকুপার বেড়বাড়ি গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আনসার কমান্ডার গোলাম মোস্তফা জানান, গাড়াগঞ্জে যুদ্ধ জয়ের পর বিষয়খালিতে শক্ত অবস্থান নেন মুক্তিযোদ্ধারা। পরাজয়ের বদলা নিতে ১ এপ্রিল সকালে যশোর থেকে পাকসেনারা শক্তি সঞ্চয় করে ফের ঝিনাইদহের দিকে এগিয়ে আসে। তখন তাদের বিষয়খালীতে বাধা দেওয়া হয়। এখানে প্রথম দিনের যুদ্ধে পাকসেনাদের ক্ষয়ক্ষতি হয়। তারা পিছু হটে যশোর সেনানিবাসে ফিরে যায়।
“এরপর ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর ও মাগুরা মুক্ত অঞ্চল হিসেবে ছিল।”
গোলাম মোস্তফা জানান, ১৪ এপ্রিল ভোরে যশোর সেনানিবাস থেকে পাকবাহিনী আরও শক্তিশালী হয়ে ঝিনাইদহ দখলে এগিয়ে আসে। ঝিনাইদহ থেকে আট কিলোমিটার দক্ষিণে বিষয়খালী ব্রিজে তাদের বাধা দেওয়ার পর শুরু হয় সম্মুখযুদ্ধ।
এ যুদ্ধ সম্পর্কে ঝিনাইদহ-৪ আসনের প্রয়াত সংসদ সদস্য জে কে এম এ আজিজ মৃত্যুর কিছুদিন আগে কথা বলেছিলেন।
তিনি বলেন, দুপক্ষের মুখোমুখি যুদ্ধ চলে ১৪ এপ্রিল বিকাল পর্যন্ত। পাকবাহিনীর মর্টার ও কামানের গোলার মুখে মুক্তিযোদ্ধারা বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারেনি। কৌশলগত অবস্থান নিয়ে তারা পিছু হটে।
এ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা ও নারীসহ বহু শহীদ হন। তাদের বেগবতী নদীর পাড়সহ আরো কয়েকটি গণকবরে সমাহিত করা হয়। বিষয়খালীতে জেলা পরিষদ নির্মিত ভাস্কর্যে ২৮ জন শহীদের নাম রয়েছে।
বিষয়খালীর এই যুদ্ধের খবর ভারতীয় গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার পায় বলে জানান আজিজ।
তিনি জানান, বিষয়খালী যুদ্ধের পর বিকালে পাকসেনারা ঝিনাইদহ শহরে ঢুকে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড শুরু করে। ক্যাডেট কলেজে শক্ত ঘাঁটি স্থাপন করে। যশোর সেনানিবাসের পর এটি ছিল তাদের দ্বিতীয় ডিফেন্স লাইন।
শৈলকুপার বীর মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলি মন্টু জানান, এলাকার ছাত্র-জনতা দলে দলে ভারতে গিয়ে ট্রেনিং নিয়ে আসে। ফিরে আসার পর পাকসেনাদের উপর চোরাগোপ্তা হামলা চালতে থাকে।
অগাস্টের মাঝামাঝিতে মুক্তিযোদ্ধারা শৈলকুপা থানা আক্রমণ করে দখল করে নেন বলে মন্টু জানান।