৫৮ বন রক্ষা করছে পাহাড়ের পাড়াবাসী

অরুণ কান্তি চাকমা বলেন, “১৯৬৫ সাল থেকে আমরা বনটি রক্ষা করছি।”

সমির মল্লিকখাগড়াছড়ি প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 March 2023, 03:54 AM
Updated : 21 March 2023, 03:54 AM

প্রকৃতির প্রতি মমতা এবং বাঁচার তাগিদে ছয় দশকের বেশি সময় ধরে খাগড়াছড়ির বিভিন্ন উপজেলায় প্রাকৃতিক বন রক্ষা করে চলেছেন পাহাড়ের নৃ-গোষ্ঠীর মানুষেরা। তারা এই বন থেকে গাছ কাটেন না, ঝিরি থেকে মাছ-কাঁকড়াও ধরেন না। ফলে প্রতিটি ‘পাড়াবন’ এখনও শত প্রজাতির উদ্ভিদ, লতাগুল্ম, ঝিরি-ঝর্ণা, বিভিন্ন প্রজাতি পাখি, বন্যপ্রাণী ও প্রাণ-প্রকৃতির প্রাচুর্যতায় ভরা।

যখন সারাদেশে বন ও প্রকৃতিকে ধ্বংস করে উজার করা হচ্ছে জীব-বৈচিত্র্য; তখন পাহাড়ের পাড়াবাসীর এই ধরনের উদ্যোগ সুখবর বৈকি। এসব ঘন অরণ্যে মায়া হরিণ, বনমোরগ, শুকর, ময়না, টিয়াসহ নানা প্রজাতির পাখির দেখা মিলছে। বনের সুফল পাচ্ছে পাহাড়ের মানুষও।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খাগড়াছড়ি জেলা সদরে ১১টি, দীঘিনালায় ১৮টি, পানছড়িতে সাতটি, মহালছড়িতে নয়টি, লক্ষ্মীছড়িতে আটটি, মাটিরাঙায় দুটি এবং গুইমারায় তিনটিসহ মোট ৫৮টি পাড়াবন সংরক্ষণ করছে পাড়াবাসী। 

সাম্প্রতিককালে পাড়াবাসীর চিরায়ত এই উদ্যোগের সঙ্গে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাও যুক্ত হয়েছে। তারা পাড়াবাসীদের যুক্ত করে বনের আশপাশের জনগোষ্ঠীকে সচেতন করতে এবং প্রকৃতিকে অক্ষুন্ন রাখতে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। 

বন সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশের বনাঞ্চলের প্রায় ৪৩ শতাংশ পার্বত্য চট্টগ্রামে আর ২,৭,১৭,১৩১ একর সংরক্ষিত বনের মধ্যে এখানেই রয়েছে ৮,৮৬,১০১ একর।

তবে, বিগত কয়েক দশকে ব্যাপকহারে বন উজাড়ের ফলে বননির্ভর জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা হুমকিতে পড়ে গেছে। ১৯৬৪ সালে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের ফলে পার্বত্য অঞ্চলের ২৫ হাজার হেক্টর কৃষিজমি নদীতে বিলীন হয়ে যায়। ফলে লক্ষাধিক মানুষ তাদের কৃষিজমি ও বসতি অপেক্ষাকৃত উঁচু পাহাড়ের স্থাপন করতে বাধ্য হয়েছিল।

পার্বত্য চট্টগ্রামের বন রক্ষায় ২০২০ সালের ১ জুলাই ইউএসএআইডির অর্থায়নে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও ইউএনডিপির উদ্যোগে একটি প্রকল্পের আওতায় ভিলেজ কমন ফরেস্ট (ভিসিএফ) বা গ্রামীণ সাধারণ বন বা পাড়াবন রক্ষায় উদ্যোগ নেওয়া হয়।

সম্প্রতি খাগড়াছড়ির মহালছড়ির কায়াংঘাট ইউনিয়ন পরিষদের উল্টাছড়ি বিহারপাড়া বন বা ভিসিএফে গিয়ে প্রকৃতির প্রাচুর্যতা চোখে পড়ে। উল্টাছড়ি বিহারপাড়ার ৮০ পরিবার ১৯৬৫ সালে থেকে বনের রক্ষাবেক্ষণ করছে।  ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে পাড়ার মানুষের ভালোবাসায় প্রায় ২০০ একরের বনজুড়ে চিরহরিৎ বৃক্ষগুলো টিকে আছে।

বনে গর্জন, গামার, সিভিট, লম্বু, তেলসুর, চাপালিশ, বন জলপাই, উড়ি আম, খুদে জাম, হরতকি, বহেরসহ বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষ দেখা গেছে।

উল্টাছড়ি ভিসিএফ ব্যবস্থাপনা কমিটির কোষাধ্যক্ষ চন্দ্রা চাকমা বলেন, “আমাদের গ্রামে আগে ছিল ৬৪ পরিবার।  এখন প্রায় ৮০ পরিবার। বাসিন্দাদের বয়স অনুযায়ী আমরা দুটি কমিটি করেছি। পাড়ার বয়স্ক ব্যক্তিদের নিয়ে একটি কমিটি এবং তূলনামুলক কম বয়সীদের নিয়ে একটা কমিটি গঠন করি।

“কেউ যাতে বনের কাঠ বা বাঁশ কাটতে না পারে সেজন্য কমিটি কাজ করে। বন থেকে গাছ, বাঁশ কাটলে বা ঝিরি থেকে কাঁকড়া, মাছ ধরলেও অভিযুক্তদের শাস্তি দেওয়ার বিধান রয়েছে। পাড়াবন রক্ষা পাওয়ায় ঝিরি-ঝর্ণাতে আমরা অনরবত পানি পাচ্ছি। ভিসিএফে বড় বড় গাছ, বাঁশ থাকায় তা পানি উৎস হিসেবে কাজ করছে। পাহাড়ি ঝিরিতে সারা বছরই পানি থাকে। এ কারণে মানুষ চাষাবাদ করতে পারছে।“

উল্টাছড়ি বিহারপাড়া ভিসিএফ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি অরুণ কান্তি চাকমা বলেন, “১৯৬৫ সাল থেকে আমরা বনটি রক্ষা করছি। বনে বিভিন্ন ধরনের গাছপালা আছে, বাঁশ আছে। বানর, হরিণসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণী আছে। এখান থেকে কেউ গাছ কাটতে পারে না। তিন বছর পর পর ভিসিএফ ব্যবস্থাপনা কমিটির মাধ্যমে বাঁশ কাটা হয়।”

মহালছড়ি উপজেলার কনজার্ভেশন ফ্যাসিলিটর নকুল ত্রিপুরা জানান, “আমরা প্রকল্পের মাধ্যমে পাড়াবাসীর মাঝে বন রক্ষার গুরত্ব তুলে ধরি। পাড়াবনের বৃক্ষসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় সচেতনতা বৃদ্ধি করি। বনজুড়ে বিভিন্ন প্রজাতি চিরহরিৎ বৃক্ষ রয়েছে।”

প্রকল্পের জেলা কর্মকর্তা মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন ফরায়েজী বলেন, “মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে- ‘বন বাঁচলে, থাকবে পানি’। বন সংরক্ষণের জন্য পাড়াবাসীকে আমরা এককালীন আর্থিক সার্পোট দেই।”

প্রকল্পের ফোকাল পার্সন ও খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) টিটন খীসা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে পাড়াবনের গুরত্ব রয়েছে। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই গুরুত্ব আরও বেড়েছে। এখানে শুষ্ক মৌসুমে পানির সংকট দেখা দেয়। তবে পাড়াবন সৃষ্টি হওয়ার কারণে ছড়া, ঝিরি-ঝর্ণাসহ পানির উৎসে প্রবাহ স্বাভাবিক হয়েছে। এখন পাহাড়ের লাগায়ো জমিগুলোতে পানির প্রবাহ সৃষ্টি হওয়ায় চাষাবাদ করছে।”