গবেষণা প্রতিষ্ঠান বলছে, মেঘালয় থেকে ছড়া ও নদীর ঢলের সঙ্গে ভেসে আসা বালিতে প্রায় ৩০ শতাংশ ফসলি জমি নষ্ট হয়ে গেছে।
Published : 09 Aug 2023, 11:17 AM
মেঘালয় থেকে ঢলের সঙ্গে নেমে আসা বালুতে নেত্রকোণার কলমাকান্দা সীমান্তের গারো পাহাড়ের পাদদেশের অনেক জমি ভরাট হয়ে কৃষিকাজের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে; তাতে বিপদে পড়ছেন ওই এলাকার বাসিন্দা মান্দি ও হাজংরা।
প্রায় দুই দশক ধরে চলা এই বিরূপ পরিস্থিতির মধ্যে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে এসেছে বন্য হাতির উপদ্রব। বালু পড়ে জলা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় পানির সঙ্কট তো রয়েছেই।
জমি-জলা-জঙ্গল-পাহাড় আর প্রকৃতির উপর নির্ভর করে টিকে থাকা সীমান্তবর্তী এসব নৃগোষ্ঠীর মানুষেরা বিরূপ পরিস্থিতিতে টিকতে না পেরে বাস্তুচ্যুত হচ্ছেন। বাপ-দাদার ভিটেমাটির মায়া ছাড়তে না পেরে যারা পাহাড়ের কোলে রয়ে গেছেন, তাদের জীবন হয়ে উঠেছে কষ্টের।
কলমাকান্দা উপজেলার লেঙ্গুরা ইউনিয়নের তকলাইবাড়ি গ্রামের দিনমজুর জেমস সাংমা (৪০) বলছিলেন, সীমান্তের ওপারে ভারতীয় অংশের মেঘালয়ে পাহাড় কেটে রাস্তা করার পর থেকেই বালু আসছে বেশি। উজানের ঢলের সঙ্গে নদী ও ছড়া দিয়ে আসা বালুতেই দিনে দিনে জমি শেষ হয়ে যাচ্ছে। প্রায়ই আগাম বন্যা হচ্ছে।
“পাহাড়ের গাছ কাইট্যা শেষ। আদিবাসীরার জীবন তো এইবায় বালুতে, বন্যায় আর বন উজাড়ে আটকে যাচ্ছে। যতই দিন যাইতাছে ততই কঠিন অইতাছে। চোখের সামনেই দুই-তিন দশকে এই দশা হইছে। পাহাড়ে অহন টিকাডা কঠিন অইয়া পড়ছে।”
দুর্গাপুর খনিজ সম্পদ ও পরিবেশ রক্ষা কমিটির সাধারণ সম্পাদক এবং বিরিশিরি কালচারাল অ্যাকাডেমির সাবেক পরিচালক স্বপন হাজং বলেন, “গত দুই-তিন দশকে টিলার মাটি অবাধে ও অপরিকল্পিতভাবে কাটায় বিপিনগঞ্জ গ্রামের অর্ধশতাধিক হাজং পরিবার এলাকা ছেড়ে গেছে। পাহাড়ি বন-জঙ্গল বলতে যা বোঝায়, তা আর নেই। টিলাগুলো ন্যাড়া হয়ে আছে। বনজঙ্গল ঘিরেই আদিবাসীদের জীবন-জীবীকা। এ অবস্থায় আর কতটুকু ভালো থাকা সম্ভব।”
জীব-বৈচিত্র্য ও পরিবেশ বিষয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইন্ডিজেনাস নলেজ-বারসিকের তথ্য মতে, মেঘালয় থেকে ছড়া ও নদীর ঢলের সঙ্গে ভেসে আসা বালিতে প্রায় ৩০ শতাংশ ফসলি জমি নষ্ট হয়ে গেছে। দেখা গেছে, এরই মধ্যে গড়ে ১০০ শতাংশ জমির মধ্যে ২০ শতাংশ জমি বালিতে ঢাকা পড়ে গেছে।
তকলাইবাড়ি গ্রামটি মেঘালয় সীমান্তের জিরো পয়েন্ট লাগোয়া। এর ৫০ গজ দূরেই ওপারের গ্রাম চিরিংরে। তকলাইবাড়িতে ২২টি মান্দি (গারো) পরিবার আর পাশের নয়নকান্দিতে বসবাস করে ৭০টি হাজং পরিবার।
সম্প্রতি তকলাইবাড়ি গ্রামে গেলে সেখানকার বাসিন্দারা তাদের সেই বিরূপ পরিস্থিতির কথাই তুলে ধরেন। তারা জানান, শুধু তাদের এলাকাতেই নয়; পাশের রংছাতি ইউনিয়নের চন্দ্রডিঙ্গা, সন্ন্যাসীপাড়া, পাঁচগাঁও, চেংগ্নি, পাতলাবানসহ কিছু গ্রামেও জমি ভরাট হচ্ছে মেঘালয় থেকে আসা বালুতে। বালুর সঙ্গে আছে নুড়ি আর চুনাপাথর। ফলে জমি দিন দিন উর্বরতা হারাচ্ছে।
পরিবেশবাদীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভারতের মেঘালয়ে কিছু খনি এবং রাস্তাঘাটের কাজ হচ্ছে। এ কারণে পাহাড় কাটা পড়ছে। কখনও কখনও পাহাড়ে ধসও হচ্ছে। সেই মাটি পাদদেশে এসে জমির উর্বরতা কেড়ে নিচ্ছে।
এ অবস্থা শুধু যে কলমাকান্দা উপজেলাতেই তা নয়; পাশের উপজেলা দুর্গাপুরেও একই দশা। সেখানকার বিজয়পুর, ভরতপুর, গোপালপুর, বগাউড়া, আড়াপাড়া, ছনপাড়া, খুজিগড়াসহ অন্তত ২০টি গ্রামে যুগ যুগ ধরে বসবাস করে আসা মান্দি আর হাজং পরিবারের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে।
সেখানে সাদা মাটির টিলার খননে উচ্ছেদ হয়েছে অনেক পরিবার। যদিও কয়েকবছর ধরে সাদা মাটি খনন কাজ বন্ধ রয়েছে।
শুক্রবার বিকালে তকলাইবাড়ি গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, ববিতা রিছিল, সুজাতা হাজং, রিনুকা হাজং, অনন্যা রিছিলসহ কয়েকজন নারী একটি বারান্দায় বসে খোশগল্প করছেন। বাড়িটি ববিতা রিছিলের।
বারান্দার পাশের একটি ঘরে তার মুদি দোকান। দোকানে সদাই নিতে এসেছিলেন জেমস সাংমা ও দাদেল নকরেক। এদের অধিকাংশ আগে নিজেদের জমিতে কৃষিকাজ করলেও এখন জমি হারিয়ে দিনমজুর।
সুজাতা হাজংয়ের বাড়ি নয়নকান্দি গ্রামে। তার এক মেয়ে দশম শ্রেণিতে পড়ে। তার দিনমজুরির আয়েই সংসার চলে।
সুজাতা হাজং বলছিলেন, “আগে আমরার জমি আছিল। ধান অইতো। বন্যায় ফসল যায়গা। বন্যার সাথে ভাইস্যা আসা বালুতে জমি ভইর্যা যায়। এইবায় অনেক জমি চাষের থেইক্যা বাদ পড়ছে। দিন দিন বালুর লাইগ্যা জমিত ধানও কম অইতাছে। এইতার লাইগ্যা অভাবে পইর্যা জমি বেইচ্যা দিছি। অহন মানুষের জমিতে কাম কইর্যা খাই।”
সুজাতার পাশে বসা মধ্যবয়সী রিনুকা হাজংয়ের দুই মেয়ের একজন এবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে; অন্যজন পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী। দিনমজুরি করে দিনে তিনি তিনশ থেকে সাড়ে তিনশ টাকা আয় করেন।
তিনি বলেন, “আগে কিছু জমি আছিল। এইতা জমিতেও দিনে দিনে ফসল কম অইতাছিল। বালুতে জমি ভরাট অইতাছিল। আগে জঙ্গল আছিল। জঙ্গল তো আমরার জীবন। জঙ্গল তাকলেও আমরার চলতে-ফিরতে অসুবিদা অইলোয় না। আমরা এইহানে যত টিলা আছে একটাতেও জঙ্গল নাই। সব গাছ কাটা শেষ। এইবায় কি আর আদিবাসীর জীবন চলে?”
দাদেল মকরেক বলেন, “আমরা বেশিরভাগই গত বিশ-ত্রিশ বছরে গরিব অইছি। আগে নিজেরার জমি আছিল, বন-জঙ্গল আছিল। আমরার চলতে ফিরতে অসুবিধা হয় নাই। আমরা জমি বেহাত অইয়া গেছে।
“দিন যাইতাছে আর পাহাড়ি অঞ্চলে নতুন নতুন বসতি বাড়তাছে। নতুন বসতিরা আদিবাসী না। বেশিরভাগ জমি অহন হেরার হাতেই চইল্যা গেছে। আমরা অহন হেরার কাছে কাম কইর্যা খাই।”
দোকানি ববিতা রিছিলের সাড়ে ১২ কাঠা জমি আছে। তার তিন মেয়ে, এক ছেলে। দোকানের আয় আর জমির আয়ে সংসার চলে। অন্যদের তুলনায় তার আর্থিক অবস্থা কিছুটা ভালো।
তিনি বলেন, “যতই দিন যাইতাছে ততই আদিবাসীদের জন্যে পাহাড়ে টিকে থাকাটা দায় অইয়া পড়তাছে। সামনের দিনে যে কী অইবো জানি না। জমি বালুতে নষ্ট অইতাছে। পাহাড়ে আর জঙ্গল নাই। জঙ্গল আর জমিতেই আমরার চলার উপায়। এইডা কেউ দেহে না। এইবায় চলতে থাকলে কেমনে কি অইবো ভাইব্যা কুল কিনার পাই না।”
সুপেয় পানির অভাব
বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বারসিক জুলাই মাসে পাহাড়িদের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে ৪০টি গ্রামে যে জরিপ চালিয়েছে, তাতে জমির সমস্যা ছাড়াও পানির সংকট প্রবল বলে বেরিয়ে এসেছে।
প্রতিষ্ঠানটির নেত্রকোণা অঞ্চলের সমন্বয়কারী অহিদুর রহমান বলেন, “কলমাকান্দার চন্দ্রডিঙ্গা গ্রামের বাঘবেড় থেকে হাতিবেড় পর্যন্ত ৩ হাজার ৭৪০ ফুট একটি ছড়া খনন করা হয়েছে। সেখানকার ৭০০ একর জমি বালিমুক্ত হয়েছে। অর্থাৎ সীমান্তের ছড়া, পাহাড়ি নদীগুলো খনন করতে হবে। তাহলে অন্তত বালি বিপর্যয় থেকে সেখানের মানুষ রক্ষা পাবেন।
“পাহাড়ি এলাকায় সুপেয় পানির অভাব আছে। পাহাড়িরা দুই থেকে তিন কিলোমিটার দূর থেকে সুপেয় পানি সংগ্রহ করেন। তিন থেকে চারদিনে একবার গোসল করেন পানির সংকটে। এসব সংকট মোকাবেলা করে তাদেরকে টিকে থাকতে হচ্ছে।”
তিনি বলেন, তিন-চার বছর ধরে মেঘালয় থেকে দলে দলে হাতি খাবারের খোঁজে লোকালয়ে নেমে আসছে। এটা এখন সারাবছর ধরেই হচ্ছে।
“হাতিগুলো সময়ে সময়ে মানুষও মারছে। আহত করছে। বাড়ি-ঘর নষ্ট করছে। জমির ফসল খেয়ে যাচ্ছে। বাড়ির সবজি খেয়ে যাচ্ছে। এভাবে হাতির সাথে মানুষের একটা দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে।”
তবে মেঘালয় থেকে আসা বালুতে জমি নষ্ট হয়ে যাওয়ার বিষয়টিকে অহিদুর রহমান আন্তঃরাষ্ট্রীয় সমস্যা বলে মনে করেন। তিনি বলেন, দুই দেশের সরকারের মধ্যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এর সমাধান হতে পারে।
দুর্গাপুর বন বিভাগে রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. দেওয়ান আলী বলেন, “গাছ চুরির কারণে আগের বন আর নেই। আমরা আমাদের দুই হাজার ৫০০ একর বনকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে সামাজিক বনায়ন কর্মসূচি চালাচ্ছি। এলাকার মানুষদের অংশগ্রহণে এই কর্মসূচি চলছে।
এতে করে গাছ চুরি বন্ধ হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, “এখন বন বেড়েছে। বন বাড়ায় বন্যপ্রাণীও বেড়েছে। সেখানে খরগোশ, বনবিড়াল, অজগর, গুইসাপ, ময়না, টিয়াপাখির মত প্রাণী বেড়েছে।”
পাহাড়ি বালুতে জমি নষ্ট হয়ে যাওয়ার বিষয়ে অবগত আছেন জানিয়ে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ নুরুজ্জামান বলেন, যে সব জমিতে বালি পড়েছে সেসব জমিতে ধানের বিকল্প চাষের দিকে যেতে হবে। মিষ্টি কুমড়া, বাঙ্গি, তরমুজ, বাদাম, মিষ্টি আলু চাষ করলে ভালো ফলন হবে। তাছাড়া করলা, কুমড়া, শশাসহ বিভিন্ন সবজি আবাদ করা যেতে পারে।
তিনি বলেন, “হতাশ না হয়ে চেষ্টা চালাতে হবে। সব অবস্থাতেই আধুনিক কৃষির ব্যবহার করা সম্ভব।”