“আমি সবসময় চাই ছেলেরা ভালো থাকুক। আমি যে ওদের বাবা এটা স্বীকৃতি দিক, বাবা হিসাবে এখন এটুকুই চাই।”
Published : 18 Jun 2023, 03:09 PM
দুই ছেলে চিকিৎসক, দুজন প্রকৌশলী, মাকে নিয়ে তারা পাড়ি জমিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে; আর বাবা পড়ে আছেন মাতৃভূমিতে এক বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে।
রকিবুল ইসলাম (ছদ্মনাম) পেশায় ছিলেন চিকিৎসক, কাজ করেছেন ঢাকার বড় হাসপাতালগুলোতে। সন্তানদের বড় করে শেষ বয়সে যখন নাতি-নাতনিদের নিয়ে মেতে থাকার কথা, সেসময় একাকী তার দিন কাটছে গাজীপুর সদরের মণিপুর হোতাপাড়ার পুনর্বাসন কেন্দ্রে।
দেশে তার মত হতভাগ্য বাবাদের সংখ্যা কম নয়। তাদের কেউ সন্তাদের কাছে বোঝা মনে করে নিজেই চলে এসেছেন কোনো বৃদ্ধাশ্রমে, কিংবা সন্তান বা পরিবার ফেলে চলে যাওয়ায় কারও ঠাঁই হয়েছে এসব আশ্রয়স্থলে।
বিশ্ব বাবা দিবসে গাজীপুরের এই বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে কয়েকজন বাবার সঙ্গে কথা বলেছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম; যাদের বর্ণনায় উঠে এসেছে সংগীত শিল্পী নচিকেতার জনপ্রিয় ‘বৃদ্ধাশ্রম’ গানের মতই মর্মস্পর্শী চিত্র।
৬৭ বছর বয়সী রকিবুলের গ্রামের বাড়ি নারায়ণগঞ্জে, ঢাকায় থাকতেন আজিমপুরে। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আলাপে তিনি জানান, দুই ছেলেকে ঢাকায় এবং অন্য দুই ছেলেকে যুক্তরাষ্ট্রে পড়িয়েছেন। কিন্তু ব্রেইন স্টোক করে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি।
এরপর ছেলেরা তাকে যুক্তরাষ্ট্রে নেওয়ার কথা বললেও সেটি আর করেনি। পরে সন্তানরা মাকে নিয়ে চলে গেলেও ফেলে যায় অসুস্থ বাবাকে।
এই বৃদ্ধ বলেন, “আমার যত উপার্জিত সম্পদ ও নগদ টাকা নিয়ে চলে গেছে তারা। সব নিয়ে যাক কোনো আফসোস নেই, কিন্তু এই বাবার খোঁজখবর তো রাখবে, তাও রাখেনি।”
এসবের পরও বাবা চান তার সন্তানেরা ভালো থাকুক। তিনি বলেন, “আমি সবসময় চাই আমার ছেলেরা ভালো থাকুক। আমি চাই ওরা এসে আমাকে নিয়ে যাক। আমি যে ওদের বাবা, এই স্বীকৃতিটা দিক, বাবা হিসাবে এখন এটুকুই চাই।”
’একসময় অনেক বন্ধু-স্বজন থাকা রকিবুলের সঙ্গী এখন বৃদ্ধাশ্রমে তার মত অন্য বাবারা। সেখানে নামাজ, বই কিংবা পত্রিকা পড়েই তার সময় কাটে। স্ত্রী-সন্তানদের কথা মনে পড়লে চোখ ছলছল হয়ে ওঠে। এসব বিষয়ে তার পরিবারের কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।
গাজীপুরের এই পুনর্বাসন কেন্দ্রে ঠাঁই হয়েছে ১১০ জন পুরুষ ও ৯৭ জন নারীর, তাদেরই একজন ইসমাইল হোসেন (ছদ্ম নাম)।
কুশল বিনিময় করে আলাপে পরিবারের প্রসঙ্গ তুলতেই দু-চোখ ভিজে উঠল তার। জানালেন, তার ছেলে পোশাক কারখানায় চাকরি করতেন। ছেলে ও পুত্রবধূর সঙ্গে ভাড়া বাসায় একসঙ্গেই ছিলেন তিনি।
“কয়েক মাস পর একদিন হঠাৎ ছেলে আর ছেলের বউ দেখি বাড়িতে নেই। কয়েক মাসের ভাড়াও বাকি ছিল, সেগুলোও দিয়ে যায়নি। মাস পেরিয়ে গেলেও তারা ফিরে না আসায় মালিক বাড়ি ছেড়ে দিতে বলেন। পরে কিছুদিন একটি মসজিদে আশ্রয় নেই। সেখান থেকেও চলে আসতে হয়। কোথাও কোনো জায়গা না পেয়ে বাধ্য হয়েই এই বৃদ্ধাশ্রমে থাকা শুরু করি।
ছেলের কথা মনে পড়লেও আশ্রমে ‘ভালো আছেন’ জানিয়ে ইসমাইল বলেন, “আমি ওর বাবা ছিলাম। আমাকে একটু জায়গা দিলে ওদের কী এমন ক্ষতি হত। কত কষ্ট করে নিজে না খেয়ে সন্তানকে মানুষ করেছি। তারপরও ছেলে আমাকে ফেলে পালিয়ে গেল।”
জুন মাসের তৃতীয় রোববার বিশ্ব বাবা দিবস হিসেবে পালন করা হয়। এই দিবস উপলক্ষে গাজীপুরের সেই পুনর্বাসন কেন্দ্রে কথায় জনতা ব্যাংকের একসময়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা সিরাজ উদ্দিন চৌধুরী (ছদ্মনাম)। ৭১ বছর বয়সী এই বৃদ্ধের বাড়ি মানিকগঞ্জে।
তিনি জানান, দুই ছেলে চাকরি করেন, এক মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর বড় ছেলের বাসায় থাকতেন। কিন্তু সেখানে তার থাকা খুব বেশিদিন হয়নি।
পুরনো স্মৃতি মনে করতে গিয়ে নিজের আবেগকে সামলে নিতে পারছিলেন না সিরাজ। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, “স্ত্রী মারা যাওয়ার পর বড় ছেলের বাসায় থাকতাম। ছেলে ও ছেলের বউ দুজনেই চাকরি করত। আমাকে তাদের ঢাকার উত্তরার বাসায় রেখে তালা লাগিয়ে দিয়ে চলে যেত। আবার তারা আসলে খুলে দিত। সারাদিন বের হতে পারতাম না। ঘরের ভিতর দমবন্ধ হয়ে আসত।
“পরে খোঁজখবর নিয়ে নিজে থেকেই এই বৃদ্ধাশ্রমে চলে এসেছি। ছোট ছেলে বিদেশি একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করে শুনেছি, কিন্তু খোঁজখবর নেওয়া হয়নি। সৎভাবে জীবনযাপন করেছি। কখনও অবৈধ টাকা আয় করিনি। অবৈধ টাকা আয় করলে কোটি কোটি টাকার মালিক হতাম।”
সন্তানেরা মাঝেমধ্যে ফোন করে খোঁজ নেয় জানিয়ে তিনি বলেন, “সন্তানরা যদি এসে নিয়ে যায়, তখন তো যেতে বাধ্য। কিন্তু তারা তো দেখতেও আসে না, নিতেও আসে না। শুধু মাঝেমধ্যে ফোন দিয়ে জানতে চায় কেমন আছি।”
মনিপুর হোতাপাড়ার বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রটির যাত্রা শুরু হয়েছিল আশির দশকের শেষ দিকে। কয়েক বছর পর তা গাজীপুরে সরিয়ে নেওয়া হয়।
পুনর্বাসন কেন্দ্রটির তত্ত্বাবধায়ক মো. জাহাঙ্গীর আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গাজীপুর সদরের মণিপুর বিশিয়া এলাকার খতিব আবদুল জাহিদ ১৯৮৭ সালে ঢাকার উত্তরার আজমপুর এলাকায় ১২ কক্ষের একটি বাড়িতে কেন্দ্রটি স্থাপন করেন। ১৯৯৪ সালে সেটিকে মণিপুর বিশিয়ায় স্থানান্তর করা হয়। পরে শান্তিতে নোবেলজয়ী মাদার টেরিজা ১৯৯৫ সালে ২১ এপ্রিল কেন্দ্রটির সম্প্রসারিত অংশের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
ওই সময় থেকেই কেন্দ্রটিতে মাথা গোঁজার ঠাঁই মিলেছে কোথাও আশ্রয় না পাওয়া শতাধিক বৃদ্ধ বাবা-মায়ের। সেখানে অসহায় ও নিরুপায় বয়োজ্যেষ্ঠরা বিনা খরচে থাকতে পারেন বলে জানান জাহাঙ্গীর।