আইনে জলাশয় সেচে মাছ ধরার অভিযোগে ১ থেকে ২ বছর কারাদণ্ড, ৫ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে।
Published : 01 Apr 2024, 09:27 AM
ইজারা নীতিমালা ও মৎস্য আইন না মেনে সুনামগঞ্জের হাওরের জলাশয় সেচে মাছ আহরণ করা হচ্ছে। এতে মিঠাপানির মাছ বিলুপ্ত হওয়ার পাশাপাশি জলজ জীববৈচিত্রও হুমকির মুখে পড়েছে।
আইন ভেঙে সেচযন্ত্র লাগিয়ে মাছ ধরার এই মহোৎসব প্রকাশ্যে চললেও কার্যত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
মৎস্য বিভাগের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, নীতি ভঙ্গ করলে ইজারা বাতিলসহ আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান রয়েছে। জলাশয় সেচে মাছ ধরার অভিযোগে মৎস্য সুরক্ষা ও সংরক্ষণ আইনে এক থেকে দুই বছর কারাদণ্ড, ৫ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে।
তাছাড়া এই আইনের বলে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তারের ক্ষমতাও রয়েছে।
কিন্তু সুনামগঞ্জ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. শামসুল করিম বলেন, “এই অপরাধের জন্য সুনামগঞ্জে কখনো কোনো ইজারাদারকে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসার কোনো তথ্য আমার কাছে নেই।”
চলতি বছরও অন্তত পাঁচ শতাধিক জলমহালে সেচযন্ত্র লাগিয়ে মাছ ধরার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে অন্তত ২০টির মতো লিখিত অভিযোগ পাওয়া গেলেও একটির বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছে মৎস্য বিভাগ।
হাওরে মাঘ থেকে পুরো চৈত্র মাস পর্যন্ত মাছ আহরণের মৌসুম চলে। এ সময় জলমহাল না শুকিয়ে জলাশয়ে ৪ ফুট পানি রেখে ভাসা ভাসা মাছ আহরণ করার কথা।
তাছাড়া মাছ বৃদ্ধির জন্য খনন, বৃক্ষ লাগানোসহ আরও কিছু কাজ করার নির্দেশনা রয়েছে।
তবে মৎস্যজীবী ও হাওরের সচেতন কৃষকদের অভিযোগ, ইজারাদাররা এসবের কিছু না করে বরং জলাশয় শুকিয়ে মাছ ধরে মাছের নির্বংশ করছে।
সম্প্রতি শাল্লা উপজেলার মাউতি গরালিয়া বিল সেচে মাছ ধরেছে ইজারাদারের লোকজন। উন্নয়ন প্রকল্পের এই জলাশয়টি খনন, বৃক্ষ রোপণ, পরিকল্পিত মাছ আহরণের কথা থাকলেও সেটা মানেননি তারা।
এই উপজেলার রোয়াইল, ভিতর চাপ্টা, বৈশাখীসহ বেশ কিছু বিলেও সেচযন্ত্র লাগিয়ে মাছ ধরা হয়েছে বলে জানিয়েছেন কৃষকরা।
জামালগঞ্জ উপজেলার বেহেলি ইউনিয়নের কসমা, ছিছরাবনি, দিরাই চাতল, লম্বা, বালুচরা, চন্দ্রগোণা, দিঘা বিলসহ গুরুত্বপূর্ণ জলাশয়গুলোতেও সেচযন্ত্র লাগিয়ে শুকিয়ে মাছ ধরেছে ইজারাদারের লোকজন।
দিরাইয়ের চাতল, ধর্মপাশার জয়ধুনা এবং শান্তিগঞ্জ উপজেলার লাউগাঙ বিলেও একইভাবে মাছ ধরা হয়েছে।
এসব ঘটনায় এলাকাবাসী ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য স্থানীয় প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগও দিয়েছেন। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
তবে মৎস্য বিভাগ জানিয়েছে, বর্ষা মৌসুমে হাওরে এই আইনে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়। তখন চারদিকে পানিতে সয়লাব থাকে। মাছও থাকে প্রচুর।
বর্ষা মৌসুমে এমন অভিযানে মূলত প্রান্তিক ও হতদরিদ্র মৎস্যজীবীদের শাস্তি দেওয়া হলেও হাওরের মাছের নির্বংশ করে মৎস্য আহরণকারীদের বিরুদ্ধে রহস্যজনক কারণে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয় না।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, জেলায় ২০ একরের ঊর্ধ্বে ৪০৫টি বদ্ধ জলমহাল, ২০ একরের নিচে ৬২৫টি জলমহাল ও ৭৩টি উন্মুক্ত জলমহাল রয়েছে। এ ছাড়া প্রকল্পভুক্ত আরও কয়েকটি বিশেষ জলমহাল রয়েছে।
এসব জলমহাল প্রতি বছর চৈত্র মাসে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য মৎস্যজীবী সমবায় সমিতিকে ইজারা দেওয়া হয়।
কিন্তু মৎস্যজীবীদের অভিযোগ, কাগজে-কলমে সমিতিকে ইজারা দেওয়া হলেও মূলত পূঁজির অভাবে ‘ওয়াটার লর্ড’রাই নেপথ্যে থেকে জলমহাল শাসন করেন। তারা আইনেরও পরোয়া করেন না।
এমনকি অনেকে জলাশয় শুকিয়ে বিশেষ বিষ প্রয়োগ করে মাটির নিচের মাছও বের করে নিয়ে আসছে। এ কারণে হাওরে মাছের উৎপাদন কমেছে এবং মূল্যও অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ছাড়া বিষ প্রয়োগে কেবল মাছই নয়; ধ্বংস হচ্ছে হাওরের অন্যান্য জীব এবং প্রাণবৈচিত্র।
হাওর আন্দোলনের নেতা নির্মল ভট্টাচার্য্য বলেন, “এই মৌসুমে প্রতিদিনই জলমহাল শুকিয়ে মাছ ধরায় মিঠাপানির মাছের নির্বংশ হচ্ছে। প্রকাশ্যে এই বিনাশী কার্যক্রম চললেও আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না।
“ওয়াটার লর্ডদের এই অপরাধের জন্য কখনো ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে কোনো শাস্তির নজিরও নেই হাওরে। কিন্তু বর্ষাকালে গরিব মৎস্যজীবীদের বিরুদ্ধে মাছ ধরার অপরাধে ঠিকই এই আইন প্রয়োগ করা হয়।”
হাওর আন্দোলনের নেতা সালেহীন চৌধুরী শুভ বলেন, “জলাশয় ইজারা দেওয়ার সিস্টেমেই গলদ আছে। টাকা দিয়ে অনেকে মৎস্যজীবী পরিচয়পত্র নিচ্ছেন। প্রকৃত মৎস্যজীবীরা কখনো জলাশয় ইজারা পায় না। পেলেও টাকার অভাবে ওয়াটার লর্ডদের হাতে জলমহাল বিক্রি করে দেয়।
“ক্ষমতা ও অর্থের দম্ভে ইজারাদাররা জলাশয় শুকিয়ে, প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র ধ্বংস করে মাছ ধরছে। হাওরের কৃষকদের মাধ্যমে আমরা খবর পেয়েছি এবার অন্তত পাঁচ শতাধিক জলাশয় শুকিয়ে মাছ ধরা হয়েছে। যা হাওরের জীববৈচিত্র্যের জন্য বিরাট হুমকি।”
পরিবেশ নিয়ে কাজ করা সেন্টার ফর ন্যাচারাল রিসোর্স স্টাডিজের (সিএনআরএস) কর্মকর্তা শাহ কামাল বলেন, জলাশয় শুকিয়ে মৎস্য আহরণে কেবল মাছই বিলুপ্ত হচ্ছে না; এর সঙ্গে পানিতে বসবাসকারী অন্যান্য জীববৈচিত্রও ধ্বংস হচ্ছে।
“মৎস্য সুরক্ষা আইনে এসব জলজ জীব ও প্রাণ-বৈচিত্রেরও সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু হাওরে যুগ যুগ ধরে প্রকাশ্যে সেচযন্ত্র লাগিয়ে মৎস্য নিধন চলছে। এটা থামানো না গেলে হাওর একদিন মাছশূন্য হয়ে যাবে।”
শাল্লা উপজেলা হাওর বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক জয়ন্ত সেন বলেন, “আমাদের পাশের মাউতি গরালিয়া জলাশয় সেচে মাছ ধরা হয়েছে কিছু দিন আগে। আমরা বাধা দিলেও ইজারাদাররা মানেনি। উল্টো কৃষকদের হুমকি-ধমকি দিয়েছে।”
তিনি বলেন, “এই মৌসুমে প্রশাসন ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে ইজারাদারদের শাস্তি দিলে এই প্রবণতা কমতো। কিন্তু সেটা না করে ইজারাদারের স্বার্থে বর্ষায় গরিব মৎস্যজীবীদের বিরুদ্ধে এই আইন ব্যবহার করা হয় যা খুবই দুঃখজনক।”
শান্তিগঞ্জের বড়মোহা গ্রামের তানভির আহমদ বলেন, “আমাদের গ্রামের লাউগাঙ জলাশয় শুকিয়ে মাছ ধরেছে ইজারাদার। আমরা লিখিত অভিযোগ দেওয়ায় আমাদের হুমকি-ধমকি দিয়েছে।”
তিনি বলেন, “জলাশয় শুকিয়ে মৎস্য আহরণের বিরুদ্ধে কথা বললেই ইজারাদাররা জলমহাল লুটপাটের মামলার ভয় দেখায়। তাদের ভয়ে কেউ কথা বলে না।”
তবে লাউগাঙ জলাশয়ের ইজারাদার আজম আলী বলেন, “আমরা জলাশয় শুকিয়ে মাছ ধরিনি। ক্ষেতে পানি সেচের জন্য সেচযন্ত্র লাগিয়েছিলেন কৃষকরা। আমরা কোনো অনিয়ম করিনি।”
পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) সিলেট বিভাগীয় আঞ্চলিক সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট শাহ শাহেদা বলেন, গত ২২ জানুয়ারি সুনামগঞ্জে হাওর নিয়ে মতবিনিময় সভায় ভুক্তভোগী এমনকি জেলা প্রশাসকসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের লোকজনও স্বীকার করেছিলেন এই মৌসুমে জলাশয় শুকিয়ে মাছের নির্বংশ করা হচ্ছে।
তাপরও কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, “আমরাও বারবার হাওরের প্রাণ, প্রকৃতি ও পরিবেশ সুরক্ষায় নজর দিতে সংশ্লিষ্টদের অবগত করে আসছি। কিন্তু তারা যথাযথভাবে নজর দিচ্ছেন না।”
সুনামগঞ্জ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. শামসুল করিম বলেন, মৎস্য সুরক্ষা আইন প্রয়োগ করতে হলে নির্বাহী হাকিম দিয়ে এই আইনের প্রয়োগ করতে হয়।
এই আইন মৎস্য আহরণের মৌসুমে প্রয়োগ হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই অপরাধের জন্য সুনামগঞ্জে কখনো কোনো ইজারাদারকে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসার তথ্য তার কাছে নেই।
তবে বর্ষায় এই আইন প্রয়োগের তথ্য রয়েছে বলে জানান তিনি।
হাওরের মাছের উৎপাদনে প্রভাব পড়েছে কি-না জানতে চাইলে শামসুল করিম বলেন, গত বছর বিলম্বে পানি আসায় হাওরে মাছ কিছুটা কমেছে। তাছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবেও মাছের উৎপাদনে প্রভাব পড়েছে।
“তবে এভাবে জলাশয় শুকিয়ে মৎস্য আহরণ করলে অবশ্যই উৎপাদনে প্রভাব পড়বে। এ ছাড়া অনেক দেশি প্রজাতির মাছ ও জীববৈচিত্র বিলুপ্তিরও আশঙ্কা আছে। আমরা এ বিষয়ে বিভিন্ন জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছি।”
সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল চৌধুরী বলেন, মৎস্য সুরক্ষা আইন সবসময়ই প্রয়োগ করার কথা। মৎস্য বিভাগ প্রসিকিউটর ও নির্বাহী বিভাগ বিচারের ভূমিকা পালন করবে।
“এবার সরাসরি কয়েকজন কৃষক আমার কাছে জলাশয় শুকিয়ে মাছ ধরার অভিযোগ করলে আমি ইউএনও পাঠিয়ে ব্যবস্থা নিয়েছি। তবে ইজারাদারদের না পাওয়ায় শ্রমিকদের বিরুদ্ধে দণ্ডমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ”
তিনি বলেন, হাওরের মিঠাপানির মাছের সুরক্ষা ও জীববৈচিত্র সুরক্ষায় সম্মিলিত উদ্যোগ দরকার।