‘বড় ধর্মপুর মানবিক উন্নয়ন সংস্থা’র ব্যবস্থাপক জানান, বন বিভাগ ১৫ বছরের জন্য ৫২ একর সম্পত্তি লিজ দিয়েছে; বাকি ৯ একর স্থানীয়দের কাছ থেকে বিভিন্ন মেয়াদে লিজ নেওয়া হয়েছে।
Published : 15 Jan 2024, 10:51 AM
কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার বড় ধর্মপুর গ্রাম। গ্রামটির প্রায় পুরো অংশই পড়েছে পাহাড়ি এলাকাজুড়ে। পাশেই কুমিল্লা সদর দক্ষিণ ও বরুড়ার উপজেলার সীমান্তে রয়েছে লালমাই পাহাড়ের চন্ডিমুড়া এলাকা।
চন্ডিমুড়ার পাহাড়ের মাথায় রয়েছে সনাতন ধর্মাম্বলম্বীদের তীর্থ স্থান।
পাশেই লালমাই পাহাড়ের অংশেই ৬১ একর জায়গার মধ্যে ৫২ একরের মালিক বন বিভাগ; বাকি ৯ একর জমি ব্যক্তি মালিকানাধীন বলে জানান ‘বড় ধর্মপুর মানবিক উন্নয়ন সংস্থা’র ব্যবস্থাপক মো. আবুল কাশেম।
তিনি জানান, বছর তিনেক আগেও দিনদুপুরেও মানুষজন ওই স্থানে যেতে ভয় পেতেন। পুরো এলাকাটি ছিল অপরাধী আর মাদক কারবারিদের অভয়ারণ্য।
যদিও গত কয়েক বছরের মধ্যেই পাল্টে গেছে পুরোনো দৃশ্যপট। লালমাই পাহাড়ের সেই পরিত্যক্ত জঙ্গলকে ঘিরে এখন খুলেছে সম্ভাবনার নতুন দ্বার। জীবনযাত্রায় পরিবর্তন এসেছে এলাকাবাসীর।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, এখানে বাণিজ্যিকভাবে হচ্ছে বিভিন্ন ফল-ফসলের চাষ। লাগানো হয়েছে ৭০ হাজারের বেশি বনজ ও ওষুধি গাছ। পাশাপাশি পাহাড় রক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগও নেওয়া হচ্ছে। সৃষ্টি হয়েছে বেকারদের কর্মসংস্থানের।
বন বিভাগের ৫২ একর আর স্থানীয়দের ৯ একর সম্পত্তি ইজারা নিয়ে পতিত জমির ব্যবহার ও বেকারদের কর্মমুখি করতে সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে ‘বড় ধর্মপুর মানবিক উন্নয়ন সংস্থা’ নামে সংগঠন। ওই সংগঠনের ৮১ সদস্যের মাধ্যমেই লালমাই পাহাড়ের সেই পরিত্যক্ত জঙ্গলকে ঘিরে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। সেখানে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, চন্ডিমুড়ার ওই তীর্থ স্থানের পূর্ব পাশ ঘেঁষে পাহাড়ে একটি ইট বিছানো সড়ক প্রবেশ করেছে। সড়কটি দিয়ে একটু সামনে এগুলেই ছোট-বড় পাহাড়ের দেখা মেলে।
সেখানেই এখন বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের জন্য বিভিন্ন ফলের গাছ লাগানো হয়েছে। রোপণ করা হয়েছে, হাজার হাজার বনজ ও ওষুধি গাছ।
পাহাড়ের দুটি টিলার মাঝখানে তৈরি করা হয়েছে কৃত্রিম লেক। সেখানে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ চাষ করা হচ্ছে। এছাড়া সেখানে চাষ হচ্ছে বিভিন্ন প্রকারের শাক-সবজিও। পুরো প্রকল্প এলাকাটিতে কাজ করেন স্থানীয়রাই। এতে দূর হচ্ছে বেকারত্বও।
আবুল কাশেম বলেন, “বড় ধর্মপুর মানবিক উন্নয়ন সংস্থার সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান গোলাম সারওয়ার। প্রকল্প এলাকাটিতে তার নিজেরও কিছু জায়গা রয়েছে। মূলত তার উদ্যোগের কারণেই সেই পরিত্যক্ত জঙ্গলকে ঘিরে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে।
“আগে এখানে দিনের বেলায়ও মানুষ আসতে ভয় পেত। পুরো এলাকাটি ছিল চোর-মাস্তান আর মাদক কারবারি-মাদকসেবীদের অভয়ারণ্য। অথচ এখন দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন সেখানে বেড়াতে আসছেন।”
তিনি আরও বলেন, “বন বিভাগ আমাদের ১৫ বছরের জন্য উপকারভোগী হিসেবে ৫২ একর সম্পত্তি লিজ দিয়েছে। বাকি ৯ একর সম্পত্তি স্থানীয়দের কাছ থেকে বিভিন্ন মেয়াদে লিজ নেওয়া হয়েছে। ৫২ একর জায়গার মধ্যে বন বিভাগ থেকে দেওয়া ৬৮ হাজার ফলজ ও বনজ গাছ লাগানো হয়েছে। পাহাড়ের দুটি টিলার মাঝখানে তৈরি করা জলাশয় থেকেই বিভিন্ন ফসলের গাছে পানি ব্যবহার করা হচ্ছে।”
সংস্থার সদস্যদের কাছ থেকে আরও জানা যায়, ওই এলাকায় ৪ একর ভূমিতে জেলায় প্রথমবারের মতো বাণিজ্যিকভাবে আনারসের চাষ হয়েছে। পাহাড়ের ঢালু ও মাঝের সমতল ভূমিতে ‘হানিকুইন’ জাতের আনারসের চারা বেড়ে উঠছে। সেখানে রোপণ করা হয়েছে ৭০ হাজার আনারসের চারা।
পাশেই করা হয়েছে ড্রাগন ফলের বাগান। ময়মনসিংহ থেকে এনে আম্রপালি গাছ লাগানো হয়েছে ১২ শতাধিক। এছাড়া দেশ-বিদেশি আরও বিভিন্ন প্রকার দেড় হাজার আম গাছ লাগানো হয়েছে। ৪ ফুট লম্বা গাছে ধরেছে আমড়া; এমন গাছ আছে তিন শতাধিক। কাঁঠাল গাছ লাগানো হয়েছে হাজারের বেশি। বিভিন্ন প্রজাতির লেবুগাছ লাগানো হয়েছে ৮ শতাধিক; ওষুধি গাছ লাগানো হয়েছে হাজারের বেশি।
এ ছাড়া রয়েছে বিভিন্ন প্রকারের বাঁশের ঝাড়। আছে বিদেশি ত্বিন ফল, খেজুর গাছও।
পুরো এলাকাটিতে রাতে আলোর জন্য স্থাপন করা হয়েছে সৌর বিদ্যুতের বাতির।
এলাকার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছেন সংগঠনের সদস্যরাই। শীতকালে পানি শুকিয়ে গেলে বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে বসানো হয়েছে গভীর নলকূপ।
‘বড় ধর্মপুর মানবিক উন্নয়ন সংস্থা’র সাধারণ সম্পাদক বাচ্চু মিয়া বলেন, “গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর আমাদের এই প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। যদিও আমরা ২০২০ সাল থেকেই এনিয়ে কাজ করছি। আমাদের এই প্রকল্পের কারণে পাহাড়ও রক্ষা হচ্ছে। আমরা পাহাড় রক্ষা করেই সকল গাছপালা রোপণ করছি। আমাদের উদ্যোগের কারণে মাটি খেকোরা পাহাড়ের দিকে আসার সাহস পাচ্ছে না। পুরো এলাকায় এখন জীবনমান বদলে গেছে। মানুষ এখানে ঘুরতে আসেন। আমাদের সংস্থা থেকে কিছু মানবিক কাজও করা হচ্ছে। এরই মধ্যে আমরা দুটি অসহায় পরিবারকে ঘর করে দিয়েছি।”
বড় ধর্মপুর এলাকাটি পড়েছে কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার বারপাড়া ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডে।
সংশ্লিষ্ট এলাকার উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তা এমএম শাহারিয়ার ভূঁইয়া বলেন, “আমরা প্রতিনিয়ত এই এলাকাটি পরিদর্শন করছি।তাদের পরামর্শ দেওয়াসহ বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করা হচ্ছে। এই উদ্যোগের কারণে এলাকায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে।”
কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জোনায়েদ কবির খান বলেন, “২/৩ বছর আগেও স্থানটি ছিল পরিত্যক্ত জঙ্গল। আর এখন সেখানে সৃষ্টি হয়ে সম্ভাবনার নতুন দ্বার। এটি একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। এই উদ্যোগের কারণে এলাকায় বেকারত্ব দূর হচ্ছে। অনাবাদি জমিতে বিভিন্ন ফল ও শাক-সবজির চাষ হচ্ছে। আমার জানা মতে, কুমিল্লা জেলায় প্রথমবারের মতো এখানেই বাণিজ্যিকভাবে আনারসের চাষ হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন ফল বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আমরা উদ্যোক্তাদের পরামর্শ দিয়ে সার্বিক সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছি। আশা করছি, এখানে ভালো ফলন হবে। এরই মধ্যে গ্রীষ্মকালীন টমেটোসহ বিভিন্ন সবজির চাষ করে উদ্যোক্তারা লাভবান হয়েছেন।”
‘বড় ধর্মপুর মানবিক উন্নয়ন সংস্থা’র সভাপতি ও কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান গোলাম সারওয়ার বলেন, “বড় ধর্মপুর এলাকার পতিত জমি ব্যবহার ও বেকারদের কর্মমুখি করতে আমরা ‘বড় ধর্মপুর মানবিক উন্নয়ন সংস্থা’ নামে ৮১ সদস্যের একটি সংগঠন করি। সংগঠনের সদস্যদের এবং বন বিভাগ থেকে লিজ নেওয়া জমিতে পরিকল্পিতভাবে আমরা ফলজ ও বনজ বৃক্ষ রোপণ করেছি।
“পাহাড়ের দুটি টিলার মাঝখানে কৃত্রিম লেক করেছি। লেকে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ চাষ করেছি। নিচু জমিতে টমেটোসহ বিভিন্ন সবজি চাষ করেছি। আমি আশা করছি, কয়েক বছরের মধ্যে লালমাই পাহাড়ের এই অংশটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠবে। এটির পাশেই রয়েছে ঐতিহ্যবাহী চন্ডি মন্দির ও দুতিয়া দিঘি। আমরা পাহাড়ের সৌন্দর্য বাড়াতে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছি।”