পদ্মা নদীর দুর্গম চরাঞ্চলে অবস্থিত ফরিদপুর সদর উপজেলার নর্থচ্যানেল ও ডিক্রিরচর ইউনিয়নের মানুষদের কাছ থেকে খেয়া পারাপারের জন্য নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি টাকা আদায়ের অভিযোগ উঠেছে ইজারাদারদের বিরুদ্ধে।
চরাঞ্চলের এই মানুষদের ১০-১২ কিলোমিটার দূরত্বের জেলা শহরে আসার জন্য চড়তে হয় ঘোড়ার গাড়ি, মোটরসাইকেলে। তারপর খেয়া নৌকায় পাড়ি দিতে হয় পদ্মা নদী। এতে সময় লাগে কয়েক ঘণ্টা, আর খরচ করতে হয় ৩০০ থেকে সাড়ে ৩০০ টাকা।
এর মধ্যে টেপুরাকান্দি ও ধলার মোড় নামের দুটি খেয়া ঘাট থেকে যাতায়াতসহ মালামাল পরিবহন করে থাকেন নর্থচ্যানেল ও ডিক্রিরচর ইউনিয়নের মানুষরা। সেজন্য ২২টি ইঞ্জিনচালিত নৌকা আধাঘণ্টা পর পর সদর উপজেলার সিঅ্যান্ডবি নদী বন্দরের পাশ থেকে যাতায়াত করে।
তবে নদী পারাপারে জনপ্রতি সরকার নির্ধারিত ১০ টাকা হারে ভাড়া আদায়ের শর্ত থাকলেও তা মানছে না ইজারাদার কর্তৃপক্ষ। গত কয়েক বছরে এই দাম বাড়তে বাড়তে এখন জনপ্রতি ৫০ টাকা নেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ এই পথের যাত্রীদের।
দুই ইউনিয়নের পদ্মায় জেগে উঠা এসব দুর্গম চরে বসবাস করছে কয়েক হাজার পরিবার। তাদের জীবিকার অন্যতম মাধ্যম কৃষিকাজ, পশুপালন ও মাছ ধরা।
নিত্য প্রয়োজনে শহরে আসা-যাওয়ায় ভাড়া দিতে এমনিতেই হিমশিম খাচ্ছেন সুবিধাবঞ্চিত চরবাসী। এখন তাদের যাতায়াত খরচে ‘বোঝার ওপর শাকের আঁটি’ হয়ে উঠেছে নদী পারাপারের এই অতিরিক্ত ভাড়া। তাই এমন ভাড়া বৃদ্ধিতে ক্ষুব্ধ স্বল্প আয়ের মানুষেরা।
যদিও প্রতিটি ঘাটে সরকার অনুমোদিত ভাড়ার তালিকা টাঙানোসহ নির্ধারিত টোলের বাইরে অর্থ আদায় করলে ইজারাদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা প্রশাসনের। কিন্ত তেমন কোনো পদক্ষেপও দেখা যায়নি।
কবিরপুর চর থেকে জরুরি প্রয়োজনে শহরে এসেছিলেন রাকিব-লাভলী দম্পতি। পথে অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে ক্ষুদ্ধ রাকিব বলেন, “সরকার নির্ধারিত ভাড়া ১০ টাকা হলেও ক্রমান্বয়ে ২০, ৩০ টাকা হারে নিতে নিতে সেটা এখন নেওয়া হচ্ছে ৫০ টাকা করে।”
তিনি বলেন, “স্ত্রীকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাচ্ছি, আমাদের যাতায়াত খরচই লাগছে হাজার টাকার মতো। আমরা চরের মানুষ স্বল্প আয়ের, আমরা এত টাকা কীভাবে দেব?”
পদ্মার ৩৮ দাগের বাসিন্দা গফুর শেখ গবাদি পশুপালন করে জীবিকা নির্বাহ করেন। দুধ বিক্রয় করতে প্রতিদিন তাকে শহরে আসতে হয়।
তিনি বলেন, “দুধ বেঁচে যা পাই তার অর্ধেকের মতো চলে যায় যাতায়াতেই। কিন্তু আগে এমন হতো না, ১০ টাকায় নাও (নৌকা) পার হতাম।”
চরের মানুষের এই সমস্যার বিষয়টি সরকারের দেখা উচিত বলে আবেদন জানান গফুর।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক স্কুল শিক্ষক বলেন, “চরাঞ্চলে যারা বসবাস করি, আমরা স্বল্প আয়ের মানুষ। নিজেদের পণ্য বা স্বাস্থ্য সেবা নিতে শহরের যাতায়াতের জন্য এতো অধিক ভাড়া আমাদের ওপর জুলুম।”
নর্থচ্যানেল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তোফাজ্জেল হোসেন বলেন, “ঘাট দুটিতে ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায় করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করছেন যাত্রীরা। নৌ পথের যাত্রী, মালামাল, গরু-ছাগলসহ কোনো পণ্যের টোল বা ভাড়া নিয়ে সরকার নির্ধারিত চার্ট না থাকায় এভাবে বেশি টাকা নেওয়া হচ্ছে।”
তাই ঘাটে দ্রুত নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা টাঙিয়ে সে হিসাবে ভাড়া নেওয়ার দাবি করেন এই জনপ্রতিনিধি।
ফরিদপুর সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) লিটন ঢালী জানান, টেপুরাকান্দি ও ধলার মোড় ঘাট দুটি ইজারা পেয়েছেন মো. ফজল মোল্লা ও শেখ আমানত।
ইঞ্জিনচালিত নৌযানে সরকার নির্ধারিত একমুখী ভাড়া প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের জন্য ১০ টাকা, গরু ৫০ টাকা, ছাগল ১০ টাকা, মালামাল পরিবহন প্রতিমণ ২ টাকা মূল্য হারে টেন্ডারে অংশ নিয়ে ঘাটের ইজারা পান তারা।
অতিরিক্ত ভাড়ার বিষয়ে খেয়া ঘাটের ইজারাদারের প্রতিনিধি রুবেল মীর বলেন, অধিক মূল্যে ইজারা নেওয়া, তেল, মোবিল, মজুরিসহ সব জিনিসের দাম বেড়েছে, তাই ভাড়া বাড়ানো ছাড়া তাদের উপায় নেই।
খেয়াঘাটের ইজারাদার আমানত শেখ বলেন, “আমি ঘাটটি ইজারা নেওয়ার পর জাহাঙ্গীর হোসেন নামের এক ব্যক্তির কাছে বিক্রি করে দিয়েছি। তারা কত কী ভাড়া নিচ্ছে সে বিষয়ে আমার জানা নেই।”
অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়া প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, “উচ্চমূল্যে ইজারা নেওয়া হয়েছে, তেলের দাম এখন ডবল, শ্রমিকের দর অনেক বেশি; এজন্য বাধ্য হয়ে একটু বেশি ভাড়া নিতে হচ্ছে।
“তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিষয়টি নিয়ে তৎপর হলে আমরা ভাড়া এখন সহনশীল পর্যায়ে নিচ্ছি।”
আর একাধিকবার মোবাইলে কল দিয়েও অপর ইজারাদার মো. ফজল মোল্লার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
এ বিষয়ে ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক মো. কামরুল আহসান তালুকদার বলেন, “ঘাটে যাত্রীদের যাতায়াত ভাড়া বেশি নেওয়া ও কোনো ধরনের ভাড়া বা টোল নির্ধারণের চার্ট না থাকায় দ্রুত সরকার নির্ধারিত ভাড়া আদায়সহ ঘাট এলাকায় টোল চার্ট টানানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।”
এ ছাড়া ইজারায় উল্লেখিত শর্ত ভঙ্গ করলে তাদের ইজারা বাতিলসহ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও হুঁশিয়ার করেন তিনি।